আমি মৌসুমী আলম। ২০১০ সাল থেকে বুটিকস ও খাবার নিয়ে ব্যবসা করছি। পরিবারে দুই বোন তিন ভাইয়ের মধ্যে আমি সবার বড়। পড়াশোনায় সব সময় মনোযোগী ছিলাম। জীবনে প্রথম ধাক্কা খাই ক্লাস ফোর মানে চতুর্থ শ্রেণিতে। অংকে দুর্বল থাকায় রেজাল্ট মনঃপুত হয়েছিল না।
আব্বা বলে দিল- ‘অনেক হয়েছে, আর লেখাপড়ার দরকার নাই। বাসায় বসে সেলাই করো, রান্না শিখো আর হিসাব করা শিখো।’ আব্বার তিনটা কথাই রেখেছি; পাশাপাশি বাসায় বসে থাকা হয়নি। আব্বাই স্কুলে নিয়ে যায়। সেই থেকে আলহামদুলিল্লাহ, হিসাবেও আর আটকায়নি।
পড়াশোনা শুরু হয় রাজশাহীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সরকারি সাবিত্রী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে। দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে পড়াশোনা শুরু করি। কারণ আব্বা-মা প্রথম শ্রেণির সব পড়াশোনা বাসায় শেষ করিয়ে ছিলেন। ভর্তি পরীক্ষায় টপ করেছিলাম। তারপর পর্যায়ক্রমে একই স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী হয়ে স্কুলজীবন শেষ করি।
এইচএসসি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সরকারি সিটি কলেজ, রাজশাহী থেকে সম্পন্ন করি। তারপর রাজশাহী কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করি। শখ করে ল’ কলেজে ভর্তি হই। কারণ ক্লাসগুলো সব বিকেলবেলায় ছিল। পদ্মার পাড়ে কলেজ ছিল। পড়াশোনা ও প্রকৃতি আমার পক্ষে ছিল সব সময়। তারপর এশিয়ান ইউনিভার্সিটি থেকে বিএড সম্পন্ন করি এবং ঢাকা আহছানিয়া মিশন থেকে এমএড করি।
লেখাপড়ার পাশাপাশি (এইচএসসি) Summit school (An English medium school)-এ কম্পিউটার টিচার হয়ে জীবনের প্রথম চাকরিজীবন শুরু করি। একটানা ১৩ বছর কাজ করে যাই নিশ্চিন্তে। তারপর ২০০৭ সালে ঢাকায় আসি। লাইসিয়াম কিন্ডারগার্টেনে ইংরেজি শিক্ষক হয়ে কাজ শুরু করি। ২০০৮ সালের ১ জুন ঢাকা আহছানিয়া মিশনে জয়েন হই।
ইংরেজি শিক্ষক এবং সপ্তম শ্রেণির দায়িত্ব নিয়ে তৃতীয় চাকরি শুরু করি। এখনো দায়িত্বসহকারে কাজ করে যাচ্ছি। অনেকটা শখ করেই ব্যবসা শুরু করি। আমার দুই সন্তান। প্রথম সন্তান নুসাইবা আলম লুবান ও দ্বিতীয় সন্তান সাদাব সাফওয়ান মন্জুর। মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করি।
ছোটবেলায় হাতের কাজ শিখেছিলাম বিভিন্ন ক্যাটাগরির। তবে কুশির কাজটা খুব ভালোভাবে রপ্ত করেছিলাম। তাই ভালোলাগার কাজটা নিজের, মেয়ের ও ছেলের কাপড়ে করতাম। সবাই পছন্দ করত আর আমাকে করে দিতে বলত। ঠিক একই রকম মেয়ের স্কুলের টিচাররাও কাজ দিতে লাগল আর আমি করে দিতে লাগলাম।
প্রথম পারিশ্রমিক ছিল ১২০ টাকা। তখন মাথায় এলো যেহেতু সবাই পছন্দ করছে, তা হলে শুরু করি। যেই ভাবা, সেই কাজ- শুরু করলাম আমার বিজনেস। অনলাইনে ও অফলাইনে। আমার প্রথম পণ্য কুশির কাজ। আর যেহেতু আমি রাজশাহীর মেয়ে, তাই রাজশাহীর ঐতিহ্য রাজশাহী সিল্ককে আমার দ্বিতীয় পণ্য হিসেবে বেছে নিই।
ফেসবুকে পেজ ওপেন করি আর সততার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। পাশাপাশি ছোটবেলা থেকে রান্নার প্রতিও দুর্বলতা ছিল। খুব মনোযোগ দিয়ে রান্না করতাম। পর্যায়ক্রমে রান্নার কোর্স করি। রান্নার পেজও ওপেন করি আর আমার বিজনেসে অন্তর্ভুক্ত করি। শিক্ষকতার পাশাপাশি দুটো পেজেই কাজ করে যাচ্ছি।
ছোটবেলায় শেখা নিজের কাজটা সবাই যখন পছন্দ করে। আরো ভালো করার সাহস দেয়। সেখান থেকেই কাজের আইডিয়াগুলো পাই। পছন্দ, ভালোলাগা, ভালোবাসা, চাহিদা, কিছু চাওয়া-পাওয়া, কিছুটা আকাক্সক্ষা নিয়েই ব্যবসা শুরু করি। আমি কাজ করছি কুশিপণ্য, রাজশাহী সিল্ক ও ফুড নিয়ে।
শুরুটা ছিল অফলাইনে পরিচিতদের চাওয়া থেকে। প্রথমে বিজনেস শুরু করে প্রচুর সমস্যা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে নিজের কাজে বিশ্বাসী ও নিজেকে সৎ প্রমাণ করে কাজ করি। এতে পরিবার ও পরিজন বিপক্ষে থাকলেও তা পরে সহযোগী হয়ে ওঠে।
নতুনদের জন্য বলব- যদি বিজনেস করতে চান, তা হলে নিজেকে আগে প্রশ্ন করুন- আপনি বিজনেস করবেন কিনা। শখ করে বিজনেস শুরু করলেন- দু দিন পর বাদ দিলেন; সেটা না করাই উচিত বলে আমি মনে করি। এতে পণ্যকে অপমান করা বোঝায়। আপনি বিজনেস করলে বিজনেসের উপযুক্ত মানসিকতা তৈরি করুন।
কি পণ্য নিয়ে কাজ করতে পারবেন তা ঠিক করুন। পণ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে নিজেকে সময় দিন ও সততা বজায় রাখুন। আমার পরিচিত বোন, ভাবীরা আর সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন আমার স্বামী। উনি সহযোগিতা না করলে সংসার, সন্তান, চাকরি নিয়ে বিজনেস করা আমার জন্য অসম্ভব হতো হয়তো।
অফলাইন ও অনলাইনে খুবই ভালো রিভিউ পেতাম। তাই বিজনেস শুরু করার সাহস হয়েছিল। এভাবে সবার ভালোবাসা নিয়ে কাজ করে যেতে চাই। একটা শোরুমের স্বপ্ন দেখি। সেটা বাস্তবে রূপান্তরিত করার ইচ্ছা সব সময় মনে পুষে কাজ করে যাচ্ছি।