আমি ‘ইসরাত জাহান’ এই মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী। আমার জন্মস্থান ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ থানায়। বাবা একজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। আর আমার মা একজন গৃহিণী। আমি মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির মেয়ে। আমরা এক বোন, দুই ভাই। ভাইবোনের মধ্যে আমি সবার বড়। আমার মা, যিনি আমার দেখা পরিশ্রমী মানুষদের মধ্যে অন্যতম।
তার প্রতিভার কোনো কমতি ছিল না। তিনি ভালো রান্না করেন। কিন্তু কখনো চিন্তা করেননি এই সেক্টরেও কিছু করা যায়। হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক কোনো যোগ্যতা ছিল না, তাই। আমার অনুপ্রেরণার মূলেই ছিলেন আমার মা। ছোটবেলা থেকে আমার মাথায় একটা চিন্তা কাজ করত- আমাকে কিছু একটা করতে হবে। আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।
যেহেতু আমার মায়ের প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও উনি কিছু করতে পারেননি তাই আমার মা মনেপ্রাণে চাইতেন তার ছেলেমেয়েরা ভালো কিছু করুক, নিজের পায়ে দাঁড়াক। আমি এসএসসি কলাতিয়া উচ্চ বিদ্যালয় এবং এইচএসসি কলাতিয়া ডিগ্রি কলেজ থেকে পাশ করেছি। তারপর অনার্স কমপ্লিট করেছি লালমাটিয়া মহিলা কলেজ থেকে।
আর মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে। এছাড়াও জবস এ-ওয়ান থেকে নিউজ প্রেজেন্টারের কোর্স করি, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। সবকিছু করার পাশাপাশি সবসময় একটা জিনিস খুব ভাবাত আমাকে, যে আমাকে উপার্জন করতে হবে সৎভাবে।
হ্যাঁ, আমি নারী, চেষ্টা আর সততা থাকলে আমিও পারি। আমার এক ম্যাম বলেছিলেন, নারীদের চলার পথ হচ্ছে কাঁটা বিছানো। একজন নারী নির্ধারণ করবে সে কি ওই কাঁটা বিছানো পথে চলবে নাকি কাঁটা উঠিয়ে গোলাপ বিছিয়ে সেই পথে চলবে। কোনো কিছুই গোছানো থাকে না, গুছিয়ে নিতে হয়।
আমার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া আর আমার অনেক বাধাবিপত্তি আসা সত্ত্বেও আমি কোনোদিন পিছপা হয়নি। বিসিএস পরীক্ষার জন্য কোচিংয়ে ভর্তি হই। ভর্তি হওয়ার আগে একবার পরীক্ষা দেই তখন কোনো প্রস্তুতি ছিল না কিন্তু পরে ভালোভাবে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করি। ২০১৭ তে আমার বিয়ে হয়ে যায়। তারপর আর বিসিএস পরীক্ষা দেয়া হয়নি। আমার আব্বু সব সময় চাইতেন আমি নিজে কিছু করি।
সমাজে নিজের পরিচয়ে পরিচিতি হোক। আমার সব চাহিদা পূরণ করেছেন কখনো কোনো কিছুর অভাব বুঝতে দেননি। আমি সব সময় আমার আব্বু আর আমার হাজবেন্ডের সাপোর্ট পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ্। তাদের সাপোর্ট ছাড়া আমি কিছুই না। একজন নারীর সফলতা অনেকাংশে তার পরিবারের সাপোর্টের ওপর নির্ভরশীল। কিছুদিন ঘরে বসে থাকা, তারপর ২০১৯-এ দেশের বাইরে চলে যাওয়া হাজবেন্ডের কাছে।
সেইখানে গিয়ে লকডাউনে আটকে যাওয়া, শেষে কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরে আশা ২০২০-এ। তারপর আবার কিছুদিন ঘরে বসে থাকা। ২০২০-এ আমার বেবি হয়। তখন আমার অনেক সময় দিতে হতো আমার বেবিকে। চাইলেও নিজের জন্য কোনো সময় বের করতে পারতাম না। হতাশ হয়ে পড়ি।
তখন ভাবলাম কি কাজ করলে বেবিকেউ সময় দিতে পারব। আবার আমার নিজের একটা পরিচয়ও হবে। হ্যাঁ, জব করতে পারতাম। তাহলে তো বেবিকে সময় দিতে পারতাম না। ওর ওপর দায়িত্বে অবহেলা হতো। তাই ভাবলাম, রান্নাবিষয়ক কিছু একটা করি যেহেতু আম্মু অনেক ভালো রান্না করেন। আমিও শিখেছি তার কাছে। দুইজনে মিলে ভালো কিছু করা যাবে ইনশাআল্লাহ।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু করি হোমমেইড খাবার নিয়ে অনলাইন বিজনেস। আলহামদুলিল্লাহ্ ভালোই সারা পাচ্ছিলাম। এর মধ্যে ফেসবুকে একটা পোস্ট দেখি- বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ঝবরঢ় প্রজেক্টের অধীনে নারী উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্যে ফুড এন্ড বেভারেজ প্রডাকশন অ্যান্ড এন্টারপ্রেনারশিপ ডেভেলপমেন্ট কোর্সটির।
৩ মাসের কোর্স ভাইবা দিয়ে উত্তীর্ণ হই। তারপর অনেক সংগ্রাম করে এক বছরের বেবিকে নিয়ে কোর্সটি সফলতার সাথে সম্পন্ন করি। সাথে Seip লেভেল ১-এও কমপিটেন্ট হই। কুকিং অ্যান্ড ক্যাটারিং কোর্স সেশন ১৮ নারীর স্বনির্ভরতায় ই-প্রশিক্ষণ কর্মসূচি থেকে অনলাইনে কোর্সটি সম্পন্ন করি। আবার নতুন করে প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার সাথে সামনে চলা শুরু করি।
এ সময় বড় বোনের মতো অনেক আপুই আমাকে সঠিক গাইড লাইন দিয়েছেন। সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ্। তাদের প্রতি আমি চির কৃতজ্ঞ। যার কথা না বললেই নয়, সোনিয়া সিমরান আপু। আমার পরিচিতি বাড়ানোর জন্য এবং উচ্চতর দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আপু অনেক পরিশ্রম করেছেন।
আপুর মাধ্যমেই আমি ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে দি একাডেমি অব কালিনারি অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট কর্তৃক আয়োজিত একদিনের ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করি। আপু ছাড়া অনেক কিছুই সম্ভব ছিল না। ধন্যবাদ আপু সব সময় এভাবেই ভালোবেসে আগলে রাখবেন আশা করি।
ফেসবুকের বদৌলতে Manager এর সাথে আমার কমিউনিকেশন শুরু হলো। ওরা আমার সাথে কমিউনিকেট করল এবং আমাকে অফার করল আমার নিজস্ব ওয়েবসাইট এক বছরের জন্য সম্পূর্ণ ফ্রি তে আমাকে ওপেন করে দিতে চাচ্ছে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করার জন্য। এদিকে ওদের সাথে কাজ করা শুরু।
আমার নিজের একটা পেজ ওপেন করা হলো যার নাম রেইনবো মার্ট। আমি কাজ শুরু করি, সেল হয় অনেক। ভালো রিভিউ পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। আমি সবসময়ই চেয়েছি আমার ফুড এবং আমার নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে আমি নিজেও একজন ডেজার্ট লাভার এবং কুক লাভার। এই ভালোবাসাটাই এক সময় নেশা এবং পেশাতে পরিণত হয়ে গেল।
ফুড নিয়ে আমার কাজ করা শুরু হলো পুরোদমে। আমি চেয়েছি প্রফেশনাল শেফ হতে, নিজেকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে। ‘রেইনবো মার্টে’র সিগনেচার ডেজার্ট অরেঞ্জ চকলেট আমার নিজের রেসিপি। আমার কাছে মনে হয় জানার এবং শেখার কোনো বয়সসীমা এবং সময়সীমা নেই। নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে বলব- সততা এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে এগিয়ে যান সফলতা আসবেই ইনশাআল্লাহ।