logo
আপডেট : ১২ মার্চ, ২০২২ ১১:০১
ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতি
দরজা খুলুন আমরা ডিবির লোক...
রুদ্র মিজান

দরজা খুলুন আমরা
ডিবির লোক...

সম্প্রতি র‌্যাবের অভিযানে সাতক্ষীরা থেকে আটক করা ভুয়া ডিবি পুলিশ

অভিযানের আগে কয়েকবার রেকি করা হয়। ঘটনাস্থলের আশপাশে সিসি ক্যামেরা, পাহারাদার আছে কিনা। ওই বাসায় বা পাশের ফ্ল্যাটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো কর্মকর্তা বা কোনো সাংবাদিক থাকেন কিনা। এসব বিষয় নিশ্চিত হয়েই অভিযান শুরু করে তারা।

এ এক ভিন্ন রকম অভিযান। ‘দরজা খুলুন আমরা ডিবির লোক, মিন্টো রোড থেকে আসছি...’ পরিচয় দিয়েই বাসায় ঢোকেন তারা। তারপর ঘটে লাগামহীন কাণ্ড।

শুরুতেই হুমকিধমকি আর মারধর করে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়। মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। বেঁধে ফেলা হয় পরিবারের পুরুষ সদস্যদের।

বাসায় থাকা সবাইকে জিম্মি করে শুরু হয় লুটপাট। এভাবেই বাসায় ঢুকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতি করে চক্রের সদস্যরা।

এই চক্রের পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের পর ৬ মার্চ একদিনের রিমান্ডে নেয় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে এই পাঁচ নকল ডিবি পুলিশ। পুলিশ সদস্যদের মতোই র‌্যাংক ব্যবহার করে চক্রের সদস্যরা।

আটকদের মধ্যে জাহিদুল ইসলাম সোহাগ নিজেকে সহকারী কমিশনার হিসেবে পরিচয় দিতেন। চক্রের অন্যরা তাকে স্যার বলে সম্বোধন করে।

পুলিশের মতোই অভিন্ন কায়দায় স্যালুট দেন উচ্চপদস্থকে। চক্রের সদস্যদের মাথার চুল পুলিশের মতোই ছোট করে ছাঁটা। এই নকল এসি থাকেন ফরমাল পোশাকে।

অন্যদের পরনে শার্টের ওপরে থাকে ডিবি লেখা জ্যাকেট। তাদের ব্যবহৃত গাড়ির সামনেও কখনো কখনো ডিবি লেখাসংবলিত কাগজ লাগানো থাকে।

তাদের সঙ্গে থাকে ওয়াকিটকি, সিগন্যাল লাইট। এমনকি পিস্তলসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র থাকে চক্রের সদস্যদের। নকল কনস্টেবলের হাতে থাকে হ্যান্ডকাফ।

কাউকে জিম্মি করতে ব্যবহার করা হয় এই হ্যান্ডকাফ।

গোয়েন্দারা জানান, চক্রের সদস্যরা অনেক বাসাবাড়িতে ডাকাতি করেছে। ডিবি পুলিশ পরিচয়ে বাসায় ঢুকে সর্বস্ব লুটে নেয় চক্রের সদস্যরা।

বাসার লোকজনকে বেঁধে, অনেক সময় মুখে স্কচটেপ দিয়ে তবেই বাসা থেকে বের হয় এ চক্রের সদস্যরা।

তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতন এই চক্রের সদস্যরা। যে কারণে এসব বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করে। সিসি ক্যামেরার ক্ষেত্রেও সচেতনতা অবলম্বন করে তারা।

সর্বশেষ গাজীপুরের একটি বাসায় ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ঢুকে সর্বস্ব লুটে নিয়েছে এই চক্রের সদস্যরা। গোয়েন্দারা জানান, বাসাবাড়ি ছাড়াও রাস্তায় প্রকাশ্যে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে অর্থ লুটে নেয় এই চক্রের সদস্যরা।

এক্ষেত্রেও আসা-যাওয়ার রাস্তা রেকি করে তারা। যারা ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের টাকা উত্তোলন করেন তাদের টার্গেট করা হয়।

তারপর ডিবি লেখাসংবলিত গাড়ি নিয়ে অনুসরণ করা হয় ওই ব্যক্তিকে। শত শত লোকের সামনেই চালানো হয় এই অভিযান। প্রথমে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে বহনকারী যানবাহনের গতিরোধ করা হয় তাদের গাড়ি দিয়ে।

তারপর নিজেদের পরিচয় দিয়ে ‘আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে’ বলেই টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে বাইরে আসতে বলা হয়। না এলে তারা নিজেরাই দ্রুত ওই গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে টেনেহিঁচড়ে বের করে গাড়ি থেকে।

তারপর নিজেদের গাড়িতে তোলে নির্জন স্থানে নিয়ে অস্ত্র দেখিয়ে জিম্মি করা হয়। প্রয়োজনে বেদম মারধর করা হয়। মারধর করে সর্বস্ব লুটে নেওয়া হয় এভাবেই। তারপর হাত, মুখ বেঁধে নির্জন স্থানে ফেলে চলে যায় নকল ডিবি পুলিশের এই দল।

সূত্রমতে, চক্রের সদস্যরা ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে প্রতিদিন মাঠে নামে। কখনো কখনো নির্জন স্থানে দেহ তল্লাশির নামে পকেটে মাদক পেয়েছে বলে হুমকি দিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।

এভাবেই টাকা-পয়সা ও মূল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নেয় তারা। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকা থেকে অস্ত্র-গুলিসহ এই ভুয়া ডিবি পুলিশের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা রমনা বিভাগ।

গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছে মো. জাহিদুল ইসলাম সোহাগ, মো. বাপ্পী মিয়া, মো. রুহুল আমিন, মো. রাজু আহম্মেদ ও মো. মাসুদ মিয়া।

গত ৫ মার্চ সন্ধ্যায় যাত্রাবাড়ীর কাজলা ফুটওভার ব্রিজের পশ্চিম পাশের ফুটপাত থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, পাঁচ রাউন্ড গুলি, তিনটি চাকু, একটি ওয়াকিটকি, এক জোড়া হ্যান্ডকাফ, একটি ব্যাগ, একটি গামছা ও দুটি ডিবি লেখা জ্যাকেট জব্দ করা হয়।

এ ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় অস্ত্র ও ডাকাতির অভিযোগে দুটি মামলা হয়েছে। অভিযানকালে পুটয়াখালীর রাঙ্গাবালীর কাজিকান্দা গ্রামের শোয়েব হাওলাদার ও আশরাফ নামে দুজন পালিয়ে যায়।

ডিবি রমনা বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার নাজিয়া ইসলাম জানান, চক্রের সদস্যরা ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ঢাকা ও গাজীপুরে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সর্বস্ব লুটে নেয়।

তাদের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় দুটি মামলা করা হয়েছে। ডাকাতির বিষয়ে রিমান্ডে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে তারা। তিনি জানান, এই চক্রটি গাজীপুরের কাশিমপুর ও কেরানীগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় ডিবি পরিচয়ে ডাকাতি করেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছে চাঁদপুরের হাইমচরের চড়কুরালিয়া গ্রামের জাহিদুল ইসলাম সোহাগ (৩৫), নরসিংদীর শিবপুরের দক্ষিণ সাদারচরের বাপ্পী মিয়া (৩৮), একই এলাকার রুহুল আমিন (৩৪), গাজীপুরের কাশিমপুর থানা সদরের হাতিমারা গ্রামের রাজু আহমেদ (২৪) এবং চাঁদপুরের হাইমচরের চরভৈরবী গ্রামের মাসুদ মিয়া (২৭)।