নতুন ইসি গঠনের পরপরই ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, রক্ষা করব ভোটাধিকার’- এই শ্লোগানে পালিত হলো এবারের ভোটার দিবস। দিবসটি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভোটাধিকার রক্ষার অঙ্গীকার করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। খুবই দৃঢ়তার সঙ্গে তাকে বলতে দেখেছি, ‘ভোটাধিকার রক্ষা করব, এটা ফাঁকা বুলি নয়।’ আগামী সংসদ নির্বাচনে মুক্ত ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন; একরকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। এটা সত্যিই আশার কথা। যদি শেষটা ভালো হয় তবে তার দৃঢ়তা কোনো শক্তির কাছে মাথানত করেনি; তাই প্রমাণিত হবে।
নানা বিতর্কের মধ্যে মেয়াদ পার করেছে হুদা কমিশন। কেমন করবে হাবিবুল আওয়াল কমিশন? এ নিয়ে এখন আলোচনা বিস্তর। হুদা কমিশনও শুরুতে চমক দেখিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সফলতা ধরে রাখতে পারেনি। বিতর্ক হয়েছে পুরো মেয়াদেই। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে না পারায় সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটি নানা ব্যর্থতায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
বিগত ৩০ বছরের বেশি সময়ে নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে বলা যায়, নতুন ইসির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্চ হলো ভোটারদের আস্থা অর্জনের মধ্য দিয়ে কেন্দ্রে ফিরিয়ে আনা। এর আগে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। এছাড়া বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি, সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলেই নির্বাচন নিয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়বে। প্রতিষ্ঠিত হবে আইনের শাসন। সাংবিধানিকভাবে এ-সবকিছুই করতে পারে ইসি। কারণ আইনে ক্ষমতা দেয়া আছে।
এটা সবারই কমবেশি জানা, বিনা ভোটে নির্বাচিত হলে গণতন্ত্রের ভিত দুর্বল হয়। জনপ্রতিনিধিদের ভোটারদের প্রতি দায়বদ্ধতা কমে যায়। তাছাড়া গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন মানেই প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ। অর্থাৎ মানুষ আগামীর প্রতিটি নির্বাচন প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ, সহিংসতামুক্ত ও নিরপেক্ষ আশা করে। নতুন ইসির এই উপলব্ধি না থাকার কারণ নেই। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য চার কমিশনার একটি অগ্নিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছেন, এটি তারাও জানেন। অর্থাৎ আগামীর চলার পথ এতটা মসৃণ নয়, যদি সবার আশা পূরণ না হয়। তবে অপবাদ নিয়ে ঘরে ফিরতে হবে।
এ জায়গা থেকে একটু একটু করে সবার আস্থা অর্জনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে নতুন কমিশনকে। সামনে কতটি নির্বাচন? সেই তালিকা আগে তৈরি জরুরি। একটির চেয়ে আরেকটি নির্বাচন ভালো করা হবে, এমন মানসিকতা জরুরি। একটি নির্বাচন শেষে দুর্বল দিকগুলোকে চিহ্নিত করে- আগামীর আরেকটি নির্বাচনে তা কাটিয়ে ওঠা মানেই মানুষের আস্থা তৈরি হওয়া। আস্থা অর্জনে নতুন ইসির প্রথম চ্যালেঞ্চ হলো আগামী ১৬ মে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের শুরুর কথাবার্তায় মনে হয়েছে তিনি চ্যালেঞ্চ নিতে চান। অর্থাৎ নির্বাচন নিয়ে যেসব বিতর্ক রয়েছে সেগুলো কাটিয়ে ওঠার চিন্তা আছে মাথায়। তাই হয়তো বলেছেন, ‘পায়রাকে যেভাবে খাঁচা থেকে মুক্ত করে দিয়ে শান্তির বার্তা দেওয়া হয়, ঠিক সেইভাবে আগামী সংসদ নির্বাচনে মুক্ত ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন’।
কথায় আছে- বৃক্ষ তোমার নাম কি ফলে পরিচয়। নতুন ইসি কতটুকু পারবে তা দেখার জন্য ২০২৩ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষার মনে হয় প্রয়োজন হবে না। এর আগেই প্লে গ্রুপ, নার্সারি শ্রেণির ক্লাস রয়েছে। শুরুর ক্লাসের ফল ইঙ্গিত দিবে ওয়ানে ভর্তি পরীক্ষা কেমন হবে।
২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এ নির্বাচনের পর থেকে ভোটের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক আরো বাড়ে। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময়েও নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন উদাহরণ হয়ে আছে। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর টানা ১৩ বছর ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দল। তার কন্যা বর্তমানে দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার সুনাম অনেক। বদলে দেয়া বাংলাদেশের কারিগর তিনি।
তিনি নির্বাচন নিয়ে কেন এত বদনাম নিতে যাবেন। এটা অনেকেই আশা করেন না। নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক দায় ইসির হলেও ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্ব আছে। বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দল বা জোটগুলো নির্বাচনে নিরপেক্ষতার প্রশ্নে ইসির চেয়ে বেশি দোষে আওয়ামী লীগকেই। তাই সামনের দিনে সব দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার দায় আরো বেড়ে গেল।
২০১৪ সালের পাঁচ জানুয়ারি ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫৩ জন বিনা ভোটে নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনেও ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর স্থানীয় সরকার বা বিভিন্ন উপ-নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি আরো কমতে থাকে। ২০২০ সালের ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয় বিএনপির বর্জনের মধ্য দিয়ে। তখন সব মিলিয়ে মাত্র ৩০ ভাগ ভোট পড়ে। ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে একদিনে ভোট হয়। ব্যালটে তখন মাত্র ৪০ ভাগ ভোট পড়েছিল। এর আগে চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপ-নির্বাচনে ২২ ভাগ ভোট পড়েছিল।
সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৩৮৯ জন চেয়ারম্যানসহ দেড় হাজার প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ৭ম দফা ইউপি নির্বাচনে দেখা গেছে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া। সহিংসতায় দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণের বিনিময়ে চার হাজার ১১১টি ইউপি নির্বাচনের পরিবেশ ও ফলাফলে মানুষ সন্তুষ্ট হতে পারেনি। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ এমন ভোট চাননি, যেখানে উৎসবের আমেজ ছাপিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করে।
২০১৯ সালের জুন মাসে ৪৩৭টি উপজেলার মধ্যে ১০৯টিতে বিনা ভোটে প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। সবশেষ পৌর নির্বাচনে ২৩৪টির মধ্যে মেয়র পদে ৬ জন ও কাউন্সিলর পদে ৯৪ জন বিনা ভোটে পাশ করেছেন। ১৯৮৮ সালের পর এ রকম বিনা ভোটে পাশ করার পরিসংখ্যান ইসিতে নেই। নির্বাচন কমিশনের পরিসংখ্যানে এরশাদের আমলে ১৯৮৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ভোটে সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হয়েছে। সেদিন সহিংসতায় ৮০ জন নিহত ও ৪৭৬ জন আহত হয়েছিল।
এ রকম নানা ত্রুটির উদাহরণ সামনে রেখে কিভাবে বর্তমান ইসি আগের সব ধরনের দোষ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে পারে এ ব্যাপারে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন। পূর্ব অভিজ্ঞতা অনুযায় তাঁর মতে নবগঠিত ইসির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, ‘এই যে বাংলাদেশি নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে বলে কথা উঠেছে, সেই জায়গায় রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি, ভোটার- সবাইকে আশ্বস্ত করতে হবে যে, তারা এই অবস্থা থেকে বের হতে পারবেন। বের হওয়ার জন্য যা করা দরকার, সেটা দ্রুত করবেন। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের আস্থা অর্জন করতে পারাটাও বড় চ্যালেঞ্জ হবে।’
একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরাও মনে করি তিনি সঠিক বলেছেন। মানুষের আস্থা অর্জনেই নতুন ইসির মূল চ্যালেঞ্জ। নির্বাচন নিয়ে সব রকম প্রশ্নের অবসান হবে কর্মের মধ্য দিয়ে গ্রহণযোগ্যতার রায়ে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সরকারের চাপ থাকবে, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সবকিছু ছাপিয়ে তবুও ইসি ঘুরে দাঁড়াবে, মেরুদণ্ড সোজা হবে এটাই প্রত্যাশা।
একটি ভালো নির্বাচন অর্থাৎ ১৯৭০ এর নির্বাচন আর গণতন্ত্র- এ দুটোই বাংলাদেশের অন্যতম ভিত। একে রক্ষা করতেই হবে যেকোনো মূল্যে। ভোটাররা যদি ভোটকেন্দ্রে না যান, সুষ্ঠু ভোট না হয়, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যদি বিজয় বাড়তে থাকে, ভোট যদি উৎসবের না হয়ে আতঙ্কের হয়, মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের যদি অধিকার না থাকে, নির্বাচন যদি গুরুত্বপূর্ণ দলগুলো বর্জন করে তাহলে সামনের দিনগুলো সুখকর হবে না। যা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে আরো বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলবে। তাই প্রত্যাশা- সবাই যেন নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগে উৎসাহী হন সে ব্যবস্থাই করবে ইসি। আর সবকিছু ঠিকঠাক করে এগিয়ে যেতে পারা মানেই ভোটার দিবস পালনের সার্থকতা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক