logo
আপডেট : ১২ মার্চ, ২০২২ ১৩:০৬
পারিবারিক সহিংসতায় বাড়ছে খুন
এমদাদুল হক খান

পারিবারিক সহিংসতায় বাড়ছে খুন

প্রতীকী ছবি

# নিরাপদ আশ্রয়স্থাল পরিবারও পরিণত হচ্ছে মৃত্যুকূপে # নৈতিকতার অবক্ষয়কে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা

পারিবারিক ও সামাজিক অপরাধ সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে। পারিবারিক সহিংসতায় প্রতিনিয়ত ঘটছে খুনের ঘটনা। পারিবারিক অস্থিারতা ও কলহের প্রভাব পড়ছে সমাজে।

আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে হত্যাকাণ্ড। নিরাপদ আশ্রয়স্থাল পরিবারও পরিণত হচ্ছে মৃত্যুকূপে। মা-বাবার হাতে সন্তান হত্যার ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনি সন্তানের হাতে জন্মদাতা মা-বাবার প্রাণহানিও ঘটছে।

পরকীয়ায় জড়িয়ে স্বামীর হাতে স্ত্রী এবং স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন হওয়ার ঘটনাও কম নয়। এক ভাই খুন করছে অন্য ভাইকে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, নানা কারণে সমাজে নৈতিকতার অবক্ষয় হচ্ছে।

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরছে। এ কারণে অবিশ্বাস ও অপ্রীতিকর ঘটনা বাড়ছে, যা অনেক সময় নৃশংস খুনে রূপ নিচ্ছে। যার মধ্যে পড়ে নিষ্পাপ শিশুরাও বলি হয়ে যাচ্ছে!
সম্প্রতি উইল করা সম্পত্তি নিজের আয়ত্তে নিতে গাজীপুরের শ্রীপুরে নিজের মাকে ভাড়াটে খুনি দিয়ে হত্যা করেছেন তার মেয়ে। ঘটনার ২১ দিনের মাথায় পুলিশের তদন্তে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

গ্রেপ্তার করা হয়েছে মেয়ে ও ভাড়াটে খুনিকে। গ্রেপ্তারের পর মেয়ে শেফালি জানান, মায়ের একমাত্র সন্তান শেফালি। বাবা মারা যান অনেক আগেই। তার মা তাকে আট গণ্ডা জমি উইল করে দেন।

তবে উইলে শর্ত থাকে, মায়ের জীবদ্দশায় এ জমি মা নিজেই ভোগ করবেন। এর মধ্যে শেফালি ও তার স্বামীর মধ্যে প্রায়ই সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। পুলিশ জানায়, শেফালি প্রায়ই বাবার বাড়িতে এসে থাকতেন।

এদিকে মীনারা বেগম তার নিজের গরু বিক্রি করে মামলায় জড়িয়ে যাওয়া ভাইকে টাকা দিয়ে সহযোগিতা করতে চান। এ নিয়ে মায়ের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা হয় শেফালির। মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে শেফালি স্বামীর বাড়িতে চলে যান।

সেখানে গিয়ে আবারো স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হয়। তিনি অসহায় বোধ করেন। এরপর তিনি মায়ের উইল করা সম্পত্তি নিজের আয়ত্তে নেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করেন। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মাকে হত্যা করতে তার একসময়ের সহকর্মী সোহেল রানার সঙ্গে চুক্তি করেন শেফালি।

এরপর শেফালি চাচার বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে মাকে নিয়ে রওনা হন। সঙ্গী হন সোহেল রানা। পথে মীনারাকে কোমল পানীয়ের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে নিয়ে যান নির্জন জঙ্গলে।

শেফালি ইট দিয়ে মাথায় আঘাত করলে তার মা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। শেফালি মায়ের বুকের ওপর বসে মাথা চেপে ধরেন। সোহেল রানা ছুরি চালান মীনারার গলায়।
এদিকে নেশার টাকা না পেয়ে নওগাঁর বদলগাছীতে মাকে খুন করার অভিযোগ উঠেছে ছেলের বিরুদ্ধে।

স্থাানীয় সূত্রে জানা যায়, ছেলে সবুজ নেশা করতেন। প্রতিনিয়ত টাকার জন্য মা-বাবার সঙ্গে এ নিয়ে ঝগড়া ও মারামারি হতো। টাকার জন্যই মা ছবিকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানান স্বজনরা। এ ব্যাপারে বাদলগাছী থানার ওসি আতিকুল ইসলাম বলেন, এটা পরিকল্পিত হত্যা বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।

টাকার জন্যই এ ঘটনা ঘটেছে। ছবির ছেলে সবুজকে আটক করা হয়েছে। ঠাকুরগাঁওয়ে নেশার টাকা না পেয়ে বাবাকে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে একমাত্র ছেলে। হত্যার শিকার বাবার নাম সাইফুল ইসলাম।

সম্প্রতি জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বড়বাড়ী ইউনিয়নের রূপগঞ্জ গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। স্থাানীয়রা জানান, নেশাগ্রস্ত মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলে রাসেল বাবার রুমে গিয়ে টাকার জন্যে উ”ৈচঃস্বরে চেঁচামেচি করে।

এ সময় বাবা শরিফুল ইসলাম বাধা দিলে রাসেল উত্তেজিত হয়ে কোদাল দিয়ে আঘাত করেন। পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়ে ঘটনাস্থালেই তার মৃত্যু হয়। নিহত সাইফুল ইসলামের স্ত্রী জানান, একমাত্র ছেলে রাসেল দীর্ঘদিন ধরেই এ সমস্যায় আক্রান্ত।

কথায় কথায় সে নেশার টাকার জন্য সবাইকে মারধর করত। ভোর রাতে সে নেশার টাকার জন্য চিৎকার-চেঁচামেচি করে। পরে এ ঘটনা ঘটে।

সম্প্রতি পরকীয়ার কারণে নিজের সন্তানকে হত্যা ও গুমের চেষ্টার অভিযোগে আমির হোসেন নামে এক ব্যক্তি ও তার চার সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। কুমিল্লার দেবিদ্বার ও রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

র‌্যাব জানায়, কুমিল্লার দেবিদ্বারের ট্রাক্টর চালক আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে পাশের বাসার লাইলির পরকীয়া সম্পর্ক চলছিল। কিছুদিন আগে শিশু ফাতিমা তার বাবা আমির ও লাইলিকে আপত্তিকর অবস্থাায় দেখে ফেলে।

তাদের অনৈতিক এ সম্পর্কের কথা তার মাকে বলে দিবে জানালে ওই নারী ফাহিমাকে হত্যার জন্য তার বাবাকে প্ররোচিত করে। পরে দুজনে মিলে ফহিমাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী শিশু ফাহিমাকে চকলেট কিনে দেওয়া ও ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে নির্জন স্থাানে নিয়ে হাত-পা বেঁধে প্রথমে ছুরিকাঘাত এবং পরে শ্বাসরোধের মাধ্যমে মৃত্যু নিশ্চিত করে।

অপরাধ ও সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, প্রতিদিন ঘটে যাওয়া এসব খুনের পেছনে রাজনৈতিক সহিংসতা, মাদক বাণিজ্য, অসহিষ্ণু আচরণ, ক্ষোভ, পরকীয়া, নৈতিকতার অবক্ষয় এবং জমি-সংক্রান্ত বিরোধই কারণ।

একটি মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় তার আপন ঘর। সেখানে কোনো না কোনো কারণে প্রতিদিন মানুষের বিশ্বাস, ভালোবাসা ও আস্থাার দূরত্ব বাড়ছে। এছাড়া বিভিন্ন তুচ্ছ ঘটনাকেও কেন্দ্র করে ঘটছে খুনের ঘটনা। কিশোরদের মধ্যে এ ধরনের অপরাধ প্রবণতাও দেখা দিয়েছে।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গ্রিন ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আহসান হাবীব বলেন, ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের মানুষের পারিবারিক মূল্যবোধ খুব শক্তিশালী। কিন্তু গত কয়েক বছরে পারিবারিক সহিংসতা মারাত্মকভাবে বেড়েছে।

বিশেষ করে শহুরে জীবন এখন ছোট পরিসরে সীমাবদ্ধ, যেটাকে বলা হচ্ছে ‘অ্যাপার্টমেন্ট কালচার। যেখানে অন্য মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে না। এ কারণে সামাজিকতাটা স্বাভাবিক থাকে না। তখন মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ কাজ করে।

আবার সবাই ব্যস্ত থাকায় কেউ কাউকে সময় দিতে পারছে না। সব মিলিয়ে পারিবারিক মূল্যবোধের জায়গা খুব হালকা হয়ে গেছে। তিনি আরো বলেন, এসব কারণে পারস্পরিক আস্থাার জায়গাটা দুর্বল হয়ে যায়।

পরিবারের মধ্যে সমস্যা সৃষ্টি হতে থাকে। কোনো কোনো পরিবারে যেটা খুনোখুনির মতো সহিংসতায় রূপ নেয়। পারিবারিক মূল্যবোধ শক্ত অবস্থাানে ফেরানোর ওপর জোর দিলেন এ শিক্ষক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, এসব ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে, কারণ দেশে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নই বলে যে যার মতো কাজ করছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সীমাবদ্ধতা এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও একটা বড় সমস্যা।

শাস্তি না হওয়ায় মানুষ অপরাধ করতে ভয় পায় না। তিনি আরো বলেন, অপরাধ করার আগে ভাবে আমার কিছু হবে না। আমার তো লোকজন আছে। কাজেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঠিক ভূমিকা জরুরি। একইসঙ্গে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, পারিবারিক বিভিন্ন বিষয়ের সূত্র ধরে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটনাগুলো বাড়ছে।

পরস্পরের বিশ্বাসের জায়গাগুলো যখন কেউ শতভাগ পূরণ করতে অথবা প্রত্যাশিত মাত্রা অর্জন করতে পারে না, তখন এ ধরনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে মাদককেরও সংশ্লিষ্টতা আছে। মাদক নিয়ন্ত্রণকেও কেন্দ্র করে খুনের ঘটনা বাড়ছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘যেকোনো খুনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক। খুনের ঘটনাগুলো কঠোরভাবে দেখা হয়। যেকোনো বিষয়ে শৃঙ্খলার ব্যত্যয় হতে পারে এরকম বিষয়গুলোকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখে পুলিশ।

আপন মানুষ বা স্বজন দ্বারা স্বজন খুন হচ্ছে কোথাও না কোথাও। এসব বিষয়ে বেশি করে সামাজিক মুভমেন্ট প্রয়োজন বলে মনে করি।’

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় আমরা সবসময় সতর্ক আছি। তুচ্ছ ঘটনাসহ নানা কারণে খুনের ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।’