logo
আপডেট : ১২ মার্চ, ২০২২ ১৪:২৬
ফুটবল পাগল চার কিশোরীর গল্প
জুয়েল রানা, টাঙ্গাইল

ফুটবল পাগল চার কিশোরীর গল্প

নানা প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে এগিয়ে চলেছেন টাঙ্গাইলের নারী ফুটবলাররা। তবে তাদের চলার পথ এখনো সহজ নয়। আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে সমাজ ও পরিবার দুদিক থেকেই বাধা পায় মেয়েরা। প্রান্তিক অঞ্চলে পুরুষদের সমানতালে ফুটবলার হতে চাওয়া মোটেই সহজ কথা নয় নারীদের জন্য।

প্রতিটি নারীর গল্পই যেন তাই একেকটি জীবনযুদ্ধের অনুপ্রেরণাদায়ী কাব্য। ফুটবলার হওয়ার নেশায় তাদের কেউ ঠেকিয়েছেন বাল্যবিয়ে, কেউ হয়েছেন পরিবার বিতাড়িত। সামাজিক বঞ্চনার চিত্র যেন আরো ভয়াবহ।

এমন চার ফুটবলারের সঙ্গে কথা হয় দৈনিক ভোরের আকাশের প্রতিবেদকের। সবকিছু ছাপিয়ে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) ক্যাডেট ফুটবলার হিসেবে সুযোগ পেয়েছেন তারা।

খুদে এসব ফুটবলারের গল্পগুলো দৈনিক ভোরের আকাশের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
বাল্যবিয়ে ঠেকাতে চুল কেটে ফেলেছিল মিলি ফুটবলার হওয়ার নেশায় বিভোর টাঙ্গাইলের মিলি (১৩)। বাল্যবিয়ে এড়াতে মাথার চুল কেটে ফেলে এ খুদে ফুটবলার।

প্রাথমিকে পড়া অবস্থায় বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা জেলা পর্যায়ের ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ পায় সে।

ভালো পারফরম্যান্স করে। এতে খেলার প্রতি আকৃষ্টতা বাড়ে তার। সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নিজ পরিবারই। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় মিলিকে বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লাগে পরিবার। বিয়ে এড়াতে কৌশলে মাথার চুল কেটে ফেলে ফুটবল খেলায় মনোনিবেশ করে সে।

ধীরে ধীরে ফুটবলে ভালো করতে থাকে। ভর্তি হয় মোনালিসা উইমেন্স স্পোর্টস একাডেমিতে। পরে অবশ্য মিলির পরিবারও বুঝতে পারায় এখন তাকে সহযোগিতা করছেন তারা।

মিলি জানায়, ‘জাতীয় দলে ফুটবল খেলার স্বপ্ন আছে। সেই স্বপ্ন থেকে খেলায় এত মনোযোগ। ছোট থাকতেই পরিবার থেকে বিয়ে দিতে চাওয়ায় মাথার চুল কাটতে বাধ্য হয়েছিলাম।

এখন বিকেএসপিতে চান্স পেয়েছি। পরিবারও এখন আমাকে সহায়তা করছে। বিয়ের জন্য আর চাপ দিচ্ছে না।’ খেলাধুলা করলে মেয়ের বিয়ে হবে না- সেলিনা

ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর টাঙ্গাইলের সেলিনা। সে জানায়, ‘প্রতিবেশী অনেক মানুষই আমার বাবা-মাকে বলত মেয়েকে খেলাধুলা না করানোর জন্য। খেলাধুলা করলে মেয়ের বিয়ে হবে না বলত। এক পর্যায়ে পরিবার থেকেও খেলাধুলা করতে নিষেধ করা হয়।’

‘এরপর অনেক কষ্ট করে খেলাধুলা ধরে রেখেছিলাম। দু’বছর পর যখন আরো একটু বড় হলাম, তখনো মানুষজন ভিন্নভাবে কটূ কথা শোনাত। এখন বড় হয়ে গেছি।

সবাই বলে, এখন খেলাধুলা করতে হবে না। হাফপ্যান্ট পরে খেলি, এটা পছন্দ করে না অনেকেই’, যোগ করেন তিনি।

আমার খরচ চালানো নাকি হারাম- আম্বিয়া
আম্বিয়া নামের আরেক স্বপ্নাতুর ফুটবলার জানায়, তার বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই। পরবর্তী সময়ে কাকার কাছে মানুষ হয়েছে।

বাড়ি থেকে কোনো সহযোগিতা পায়নি। বিয়ের জন্য পরিবার অনেকবার চাপ দিয়েছে। কৌশলে বাড়ি থেকে চলে আসে সে। সে জানায়, ‘বাড়িতে সম্প্রতি ফোন করে খরচ চেয়েছিলাম, দেয়নি।

তারা বলেছে, আমার জন্য খরচ চালানো নাকি হারাম।’ সবার অমতে খেলাধুলা করায় পরিবার থেকে কোনো সহায়তা পাইনি। বাড়িতে গেলেই তারা আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিবে। আমি খেলাধুলা করতে চাই।’
‘খেলাধুলায় ভালো করে দেশের জন্য গৌরব অর্জন করতে চাই’
মিলি, সেলিনা, আম্বিয়ার মতো আরো এক নারী ফুটবলার ঋতু (১৬)। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ফুটবলের প্রতি নেশা জন্মায় তার। মা মারা যাওয়ায় নানির কাছে মানুষ হয় ঋতু।

নানি অন্যের বাড়িতে কাজ করে যে রোজগার করেন, সেই টাকায় সংসার চালিয়ে তার পড়াশোনার খরচও জোগান। এসএসসিতে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলাও চালিয়ে যাচ্ছে ঋতু। সম্প্রতি বিকেএসপিতে ক্যাডেট ফুটবলার হিসেবে ভর্তি হয়েছে।

ঋতুর স্বপ্নও নিয়ে জানায়, ‘ছোটকালেই মাকে হারিয়েছি। বাবাও অন্যত্র বিয়ে করেছে। সেও অসুস্থ। পরে নানির কাছে মানুষ হয়েছি। নানি অন্যের বাসায় কাজ করে আমাকে মানুষ করেছে। এখন বিকেএসপিতে পড়াশোনা করছি। খেলাধুলায় ভালো করে দেশের জন্য গৌরব অর্জন করতে চাই।’

শুধু মিলি, ঋতু, সেলিনা, আম্বিয়া নয়- টাঙ্গাইলে হাজারো জয়িতা ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে এগিয়ে চলেছে।

মেয়েদের খেলাধুলা করতে দেয়ায় সামাজিকভাবে অনেক কটূকথা শুনতে হয় বলে জানান অনেক অভিভাবক। তারপরও অনেক পরিবার এগিয়ে আসছে। যাতে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও ভালো করতে পারে।

টাঙ্গাইলের মোনালিসা উইমেনস স্পোর্টস একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা কামরুন্নাহার খান মুন্নি বলেন, ‘পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার দূর না হলে নারীর চলার পথ সহজ হবে না। সামাজিকভাবে তাদের সহযোগিতা করতে হবে।

অর্থ-বিত্ত বা স্ট্যাটাস না দেখে অসহায় ও দরিদ্র এসব কিশোরীর সহায়তায় সবার এগিয়ে আসা উচিত। সরকারকে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আর্থিকভাবেও তাদের সহায়তা করা উচিত।’