ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ ও অন্যান্য শহর ঘেরাও করে রেখেছে রুশ বাহিনী। সর্বত্র বাজছে বিমান হামলার সাইরেন। আগ্রাসনের ১৭তম দিনে এসে হামলার তীব্রতা বাড়িয়েছে রুশ বাহিনী। কিয়েভে বোমা বর্ষণ জোরদারের পর ইউক্রেনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আমরা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। প্রতিটি রাস্তা ও বাড়িকে দুর্গে পরিণত করা হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরা চলা এ যুদ্ধ একটি অকল্পনীয় ট্র্যাজেডিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। খোদ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও বলেছেন, আমরা আর কত দিন নিজ ভূমিকে মুক্ত রাখতে পারব তা জানি না। খবর : বিবিসি, সিএনএন, আলজাজিরা ও দ্য গার্ডিয়ানের।
একদিকে হামলা জোরদার হচ্ছে অন্যদিকে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কথা বলছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তার মতে, বেলারুশের গোমেল শহরে হওয়া আলোচনা ইতিবাচক দিকে মোড় নিচ্ছে। গত শুক্রবার বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার লুকাশেঙ্কোর সঙ্গে ভার্চুয়াল মাধ্যমে হওয়া বৈঠকে পুতিন বলেন, আমাদের প্রতিনিধিরা আমাকে এ ব্যাপারে নিশ্চিত করেছেন। পরে এ ব্যাপারে আরো বিস্তারিত জানাব।
ইউক্রেনকে যুদ্ধের ময়দানে একা ঠেলে দেওয়া পশ্চিমারা এখনো দূরে সরে আছে। তারা কেবল রাশিয়ার ওপর একের পর এক অবরোধ আরেপা করে যাচ্ছে। কিন্তু ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে তারা নারাজ। সর্বশেষ গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, তারা ইউক্রেনে কোনো সৈন্য পাঠাবে না। টুইটারে তিনি লেখেন, আমরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাই না। রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে সরাসরি সংঘাত তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের সূচনা করবে। তবে একটি ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী ন্যাটো পূর্ণ শক্তি নিয়ে সদস্যদেশগুলোর ভূখণ্ডের প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষা করবে।
কিয়েভের আরো কাছে রুশ বাহিনী
রুশ বাহিনী কিয়েভের খুব কাছে পৌঁছে গেছে। তারা বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় গুলি ছুড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি মহাকাশ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাক্সার টেকনোলজিস প্রকাশিত স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়, মূল বাহিনী কিয়েভের উত্তর দিকের সড়কগুলোতে অবস্থান নিয়েছে। তবে রাজধানীর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শহরগুলোতে রুশ সাঁজোয়া বাহিনীর গতিবিধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইউক্রেনের অন্যান্য কয়েকটি শহর ঘিরে রাখা রুশ বাহিনী ব্যাপক গোলাবর্ষণ করছে। পশ্চিমা দেশগুলোর সরবরাহ করা ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র ও কামান এবং ড্রোন ব্যবহার করে তাদের বাধা দিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেইনীয় বাহিনীগুলো। গতকাল সকালে কিয়েভ, লাভিভ, খারকিভ ও চেরকাসিসহ বিভিন্ন বড় শহরে বিমান হামলাজনিত আগাম সতর্কসংকেত শোনা যায়। শুক্রবার রাতেও কিয়েভে বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, শনিবার ভোরে কিয়েভের উত্তর-পূর্বে ব্রোভারি জেলায় কিয়েতনেভা গ্রামে রুশ বাহিনীর গোলাবর্ষণে হিমায়িত পণ্যের একটি গুদামে আগুন ধরে। তবে সেখানে হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি। ইউক্রেনের রাষ্ট্রায়ত্ত জরুরি বিভাগের (এসইএস) প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, একতলা একটি গুদাম পুড়ছে।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চাই না: বাইডেন
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, আমরা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চাই না। শুক্রবার টুইটারে তিনি লেখেন, ইউক্রেনে আমরা কোনো সৈন্য পাঠাব না। রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করার অর্থ হলো তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের সূচনা করা। একটি ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী ন্যাটো পূর্ণ শক্তি নিয়ে সদস্য দেশগুলোর প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষা করবে। কিন্তু আমরা ইউক্রেইনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে করতে যাচ্ছি না। এর আগেও বাইডেন একাধিকবার বলেছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই করার জন্য সেনা পাঠানোর কোনো পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। তবে ইউক্রেনে আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে একের পর এক কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে চলছে যুক্তরাষ্ট্র। শুক্রবার রাশিয়ার অ্যালকোহল, সিফুড, হীরা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পাশাপাশি দেশটির নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া অভিজাতদের তালিকা আরো বড় করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইতিবাচক মোড় নিচ্ছে বৈঠক: পুতিন
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, বেলারুশের গোমেল শহরে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সরকারি প্রতিনিধিদের আলোচনা ইতিবাচক দিকে মোড় নিচ্ছে। শুক্রবার বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার লুকাশেঙ্কোর সঙ্গে ভার্চুয়াল মাধ্যমে হওয়া বৈঠকে তিনি বলেন, আমাদের প্রতিনিধিরা আমাকে এ ব্যাপারে নিশ্চিত করেছেন। আমি এ ব্যাপারে পরে আরো বিস্তারিত জানাব।
লুকাশেঙ্কো বলেন, নিষেধাজ্ঞাকে ভয় পায় না। সবাই জানে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কীভাবে ব্যাপক শক্তিমত্তা নিয়ে টিকেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। জবাবে পুতিন বলেন, আপনি ঠিকই বলেছেন, জন্মের পর থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত হয়। তা সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়ন সামনে এগিয়ে গেছে এবং বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে।
পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ২০০৮ সালে কিয়েভ ন্যাটোর সদস্য হওয়ার আবেদন করার পর থেকেই সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে দুই দেশের মধ্যে। ন্যাটো ইউক্রেনকে পূর্ণ সদস্যপদ না দিলেও সহযোগী দেশ হিসেবে মনোনীত করার পর দ্বন্দ্বের মাত্রা বাড়তে থাকে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর নির্দেশ দেন রুশ নেতা পুতিন। এর পর থেকে এ পর্যন্ত প্রাণ বাঁচতে ইউক্রেন থেকে পালিয়ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র পোল্যান্ড ও রোমানিয়ায় প্রায় ২০ লাখ ইউক্রেনীয় আশ্রয় নিয়েছেন।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, সংঘাতে ইউক্রেনে সাড়ে ৪ শর বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। যুদ্ধবিরতি ও কূটনৈতিক পন্থায় সমস্যা সমাধানের জন্য গত ১ মার্চ বেলারুশের গোমেল শহরে প্রথম দফা বৈঠকে বসেন রাশিয়া ও ইউক্রেনের সরকারি প্রতিনিধিরা। বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দর লুকাশেঙ্কোর উদ্যোগে শুরু হয় এ বৈঠক।
টার্নিং পয়েন্টে ইউক্রেন: জেলেনস্কি
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, যুদ্ধ একটি কৌশলগত টার্নিং পয়েন্টে পৌঁছে গেছে। ইউক্রেনের ভূমিকে আর কত দিন মুক্ত রাখতে পারব তা জানি না। কিন্তু আমরা বলতে পারি, আমরা এটা করব। আমরা আমাদের লক্ষ্যের দিকে যাচ্ছি। শুক্রবারের সর্বশেষ ভিডিও বক্তৃতায় রুশ মায়েদের প্রতি তাদের সন্তানদের অন্যদেশে যুদ্ধে না পাঠানোরও আহ্বান জানান জেলেনস্কি।
এ সময় ইউক্রেনীয়দের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি। বলেন, গ্যাস, উষ্ণতা ও পানি সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় কিয়েভের মানুষ মানবিক বিপর্যয়ে পড়েছে। কিয়েভের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক (২০ লাখ) মানুষ শহর ছেড়ে গেছে বলে মেয়র ভিটালি ক্লিটস্কো জানিয়েছেন। যারা রয়ে গেছেন তারা প্রতিরক্ষার জন্য কাজ করছেন। প্রতিটি রাস্তা, ঘরকে দুর্গ বানানো হয়েছে। যেসব মানুষ কখনো পোশাক পাল্টানোর কথা ভাবতেন না তারাও উর্দি পরে মেশিন গান হাতে নিচ্ছেন।
গতকাল সকাল থেকে কিয়েভ ছাড়াও মাইকোলাইভ, নিকোলায়েভ ও ক্রোপিনিতস্কি ও ডনিপ্রো শহরে বিকট শব্দে বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মিখাইলো পোডোলিয়াক জানান, রাজধানী লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। শহরটি অবরোধের মধ্যে রয়েছে। শহরের চেকপয়েন্টগুলো প্রস্তুত এবং সাপ্লাই লাইন গড়ে তোলা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত লড়বে কিয়েভ।
জীবাণু অস্ত্রের প্রমাণ পায়নি জাতিসংঘ
জাতিসংঘ জানিয়েছে, ইউক্রেন জীবাণু অস্ত্র কর্মসূচি চালাচ্ছে বলে রাশিয়া যে অভিযোগ করেছে, তার পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। শুক্রবার নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে জাতিসংঘের নিরস্ত্রীকরণবিষয়ক প্রতিনিধি ইজুমি নাকামিৎসু এ কথা বলেন। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোও রাশিয়ার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
গত বৃহস্পতিবার রাশিয়া অভিযোগ করে, ইউক্রেনে জীবাণু অস্ত্র তৈরিতে অর্থায়ন করছে যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে আলোচনার জন্য নিরাপত্তা পরিষদকে জরুরি বৈঠকের অনুরোধ জানায় রাশিয়া। এতে সাড়া দেয় জাতিসংঘ। এদিন ১৫ সদস্যবিশিষ্ট নিরাপত্তা পরিষদে ইজুমি নাকামিৎসু বলেন, ইউক্রেনে কোনো ধরনের জীবাণু অস্ত্র কর্মসূচি চলছে বলে আমাদের জানা নেই।
ইউক্রেন ও রাশিয়া- দুই দেশই বায়োলজিক্যাল উয়িপনস কনভেনশন (বিডব্লিউসি) নামক আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। ১৯৭৫ সালে বিডব্লিউসি চুক্তি কার্যকর হওয়ার পর থেকে জীবাণু অস্ত্র নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বৈঠকে জাতিসংঘে রুশ দূত ভাসিলি নেবেনজিয়া দাবি করেন, ইউক্রেনে ৩০টি জীবাণু অস্ত্র পরীক্ষাগারের একটি নেটওয়ার্ক শনাক্ত করেছে মস্কো।
তবে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের দূত লিন্ডা থমাস গ্রিনফিল্ড এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, ইউক্রেন আগ্রাসনকে ন্যায্য প্রমাণের জন্য নিরাপত্তা পরিষদকে ব্যবহারের চেষ্টা করছে রাশিয়া। তারা ভুয়া তথ্যের বৈধতা আদায় এবং জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
উল্লেখ্য, অত্যাধুনিক জীবাণু অস্ত্র নির্মাণে যুক্তরাষ্ট্র ২০০৫ সাল থেকে ইউক্রেনকে অর্থ দিচ্ছে বলে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে শুক্রবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে দেশটির সংবাদমাধ্যম স্পুৎনিক। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি এ বিষয়ে দুটি নথি প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর কাউন্টার প্রোলিফারেশন সেন্টার থেকে এগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।