logo
আপডেট : ১৩ মার্চ, ২০২২ ১২:০৩
মহানায়কের বাংলাদেশ
নিজস্ব প্রতিবেদক

মহানায়কের বাংলাদেশ

এ মার্চ মাসেই সূচনা হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতার মূল চালিকাশক্তি-দেশ স্বাধীনের ঘোষণা

একটি স্বাধীন পতাকা ও মানচিত্রের জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন যিনি, তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি মুহূর্ত আবর্তিত হয়েছে বাংলার সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে তিনি সুদীর্ঘ ২৩ বছর সংগ্রাম করেছেন। বাঙালির কাছে বঙ্গবন্ধু হলেন ইতিহাসের মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালি যুুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, জীবন দিয়েছে দেশকে স্বাধীন করতে। বঙ্গবন্ধুই ছিলেন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নির্দেশদাতা। তার নাম উচ্চারণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে প্রতিষ্ঠা করেছে।


বিশ্বের বঙ্গবন্ধুই বোধ করি একমাত্র অনুকরণীয় ব্যক্তি যিনি পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বেই তিনি বাঙালিদের সংগঠিত করে লক্ষাধিক মানুষের জনস্রোতে পরিণত করে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে কালজয়ী ভাষণ প্রদান করেন। সেই ৭ই মার্চের ভাষণে জাতির পিতা বলেছেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, এদেশের মানুষের অধিকার চাই’। তিনি সব সময় বাংলার মানুষের স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টায় ছিলেন বদ্ধপরিকর। তিনি পরিবার-পরিজন থেকেও এদেশের মানুষকে বেশি ভালোবাসতেন। তাইতো তিনি সকলকে সংগঠিত করে সুদীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ছিনিয়ে এনেছেন লাল সবুজের বাংলাদেশ। ইউনেস্কো ২০১৭ সালের ৩০শে অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটিকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভাষণটিকে ইউনেস্কো ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ অন্তর্ভুক্ত করেছে। বিশ্বজুড়ে যেসব তথ্যভিত্তিক ঐতিহ্য রয়েছে সেগুলোকে সংরক্ষণ এবং পরবর্তী প্রজন্ম যাতে তা থেকে উপকৃত হতে পারে সে লক্ষ্যেই এ তালিকা প্রণয়ন করে ইউনেস্কো। যা বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের জন্যও গর্বের ও গৌরবের।


একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ঠান্ডা মাথায় নিরস্ত্র, নিরপরাধ ও ঘুমন্ত সাধারণ বাঙালির ওপর যেভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, তা বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন। তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনকে চিরতরে মুছে দিতে ঢাকায় চালানো ওই হত্যাযজ্ঞের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। কাজেই তিনি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ঘোষক। একাত্তরের ২৫ মার্চের গণহত্যা শুধু একটি রাতের হত্যাকা-ই ছিল না, এটা ছিল মূলতঃ বিশ্বসভ্যতার জন্য এক কলঙ্কজনক-জঘন্যতম গণহত্যার সূচনা মাত্র। একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার দিনটি জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দিয়ে ২০১৭ সাল হতে দিবসটিকে ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে।


মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বের ইতিহাস শুরু হয় ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর। পদে পদে মুক্তিবাহিনীর হামলায় পাকিস্তানি হানাদাররা দিশেহারা হয়ে পড়ে। ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত হয় মিত্রবাহিনী। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর বিকেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার এক জনসভায় ভাষণদানকালে ভারতের বিমানবাহিনীর স্থাপনা ও রাডার স্টেশনগুলোতে বিমান হামলা চালায় পাকিস্তান বিমান বাহিনী। এতে করে ভারতজুড়ে জারি হয় জরুরি আইন। সে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্তপর্ব।


১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আসন্ন বিজয়ের বেলায় কাপুরুষ হানাদাররা এদেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকদের ধরে নিয়ে যায়। নিষ্ঠুর নির্যাতনের পর তাদের হত্যা করা হয়। পাকিস্তানিরা তো বটেই, পিশাচ রাজাকাররাও টের পেয়ে গিয়েছিল বাংলার নিশ্চিত বিজয়ের কথা। তাই এদেশের ভবিষ্যৎকে নড়বড়ে করে দিতে বুদ্ধিজীবী শ্রেণির প্রতি তারা বন্দুুক তাক করে। যাকে যেখান থেকে সম্ভব ধরে নিয়ে আসে হানাদার ও রাজাকার বাহিনী। রাতের অন্ধকারে চোখ বেঁধে পাকবাহিনী নিয়ে যায় জাতির গৌরবোজ্জ্বল সন্তানদের।


১৪ ডিসেম্বরের পৈশাচিক বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞে স্থবির হয়ে পড়ে সমগ্র বাংলা। হত্যার পর রাজধানীর মিরপুর, রায়েরবাজার ও বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের মরদেহ ফেলে দেওয়া হয়। ১৬ ডিসেম্বর দেশ বিজয় হলে মিরপুর ও রাজারবাগ বধ্যভূমিতে প্রিয়জনের মরদেহ খুঁজতে আসেন স্বজনরা। কিন্তু মরদেহগুলো অজস্র গুলি আর আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়ায় অনেকের পক্ষেই মৃতদেহ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মরণে ঢাকায় নির্মাণ করা হয়েছে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। এছাড়াও সারাদেশে মোট ৯শ ৪২টি বধ্যভূমি শনাক্ত করা গেছে। ১৯৭২ সালে বুদ্ধিজীবী দিবসের জাতীয় সঙ্কলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন নিউজ উইকের তথ্য অনুযায়ী শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট এক হাজার ৭০ জন।


জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন। মার্চ মাস বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গৌরবের মাস। এ মাসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন স্বাধীনতার মহান স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান। আর এ মাসেই সূচনা হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতার মূল চালিকাশক্তি-দেশ স্বাধীনের ঘোষণা। বঙ্গবন্ধু রেখে গেছেন স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন তারই যোগ্য উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বে আজ ‘উন্নয়নের রোল মডেল’। মহানায়কের জন্মশতবর্ষের হাত ধরে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে।

লেখক : সংস্কৃতিকর্মী ও সাহিত্যিক