সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিয়োগ হয়েছে। ফলে এই ইসির অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে কিনা, সেটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। তবে ইতোমধ্যে দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না বলে মতামত দিচ্ছে। এই ইস্যুতে রাজনীতির মাঠ কিছুটা গরম হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে লক্ষণীয় হলো, অনেকবার আন্দোলনে নামার হুঙ্কার দিয়ে আসা বিএনপি এবার আটঘাট বেঁধেই মাঠে নামতে চাইছে। এ কথা পরিষ্কার বলা যায় যে, আন্দোলন এবং নির্বাচনী প্রস্তুতি একই সঙ্গে দুই পথেই হাঁটছে বিএনপি। সবকিছু মিলে একদিকে রাজনৈতিক উত্তেজনা, অন্যদিকে নির্বাচনমুখী কৌশল। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিয়ে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিংবা সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখেছিল, সেটি মূলত বাস্তবায়িত না হওয়ায় তাদের রাজনৈতিক চিন্তার পরিবর্তন ঘটেছে। তারা এখন সংশয়বোধ করছেন যে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি নিয়ে অটল থাকার বিষয়টি কতটুকু সম্ভাবনাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
আবার দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব বলে আওয়ামী লীগের নেতারাসহ বিশেষজ্ঞ মহল মতামত দিয়ে যাচ্ছে। এখন এ সংক্রান্ত বিষয়ে যথেষ্ট পক্ষ-বিপক্ষ মতামত লক্ষ করা যাচ্ছে। বিগত জাতীয় নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে সর্বমহলে এক ধরনের বিতর্ক আছে। আগামীতে এমন বিতর্ক তৈরি হোক, সে ধরনের নির্বাচন আমরা কেউ চাই না। আমার মনে হয়, আওয়ামী লীগ তথা সরকারি দলও চায় না। তবে এক্ষেত্রে একটি কথা বলা যায়, যদি ইসির সদিচ্ছা থাকে তা হলে দলীয় সরকারের অধীনেও মানসম্পন্ন নির্বাচন আয়োজন সম্ভব। এর জন্য প্রথমত রাজনৈতিক সমঝোতার পরিবেশ তৈরি হতে হবে, দ্বিতীয়ত নির্বাচনী আইন আরপিওতে (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২) বেশকিছু পরিবর্তন করতে হবে।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে হবেÑ এটা ধরে নিয়েই বর্তমান ইসিকে এগোতে হবে। বিরোধী দলগুলো সরকারের কাছ থেকে কী আদায় করতে পারবে, অথবা বিরোধীদের নির্বাচনে আনতে সরকার আদৌ কোনো ছাড় দেবে কিনা, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। কোনো উইন-উইন পরিস্থিতির দিকে যেতে হলে সব রাজনৈতিক দলকেই বিশেষ ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে রাজনীতির মাঠে থাকতে হবে। উভয়পক্ষ থেকে ছাড় দিতে না পারলে কোনোভাবেই উইন-উইন পরিস্থিতি আশা করা যায় না। আওয়ামী লীগ এক পা এগোলে বিএনপিকেও আরো বেশি এগিয়ে আসতে হবে। মূলত সংবিধানের বিদ্যমান পরিস্থিতি মাথায় নিয়েই ইসিকে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে। আগের দুটি কমিশন (কাজী রকিব কমিশন ও নূরুল হুদা কমিশন) মোটেও কোনো সফলতা আনতে পেরেছে কিনা, সে বিষয়েও বিশ্লেষণ করতে হবে। আগে যে ধরনের ব্যর্থতা ছিল, সেটি নবগঠিত ইসিকে সব সময় মনে রাখতে হবে। অথবা অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে তাদের সামনে এগোতে হবে।
কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশন মাত্র যাত্রা শুরু করেছে। ভালো ভালো কথা বলছেন; কিন্তু কথা নয়, কাজে প্রমাণ করতে পারলেই দেশবাসী সন্তুষ্ট হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া আছে আইনে। নির্বাচনের সময় প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণ থাকার বিধান রয়েছে। ইসিকে রাজনৈতিক দলগুলোরও সর্বাত্মক সহযোগিতা করার কথা বলা আছে। এসব বিষয়ে কিছু সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করে, কী সংস্কার প্রয়োজন, তা বিশ্লেষণ করে সেটি নিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়া দরকার।
স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন আদর্শ ও কল্যাণের লক্ষ্য নিয়ে ক্ষমতাসীন ছিলেন, তখনো একটি বিরোধীশক্তি বঙ্গবন্ধুর শাসনকে মেনে না নিয়ে দেশে নানাবিধ নৈরাজ্য ও নাশকতার পরিবেশ তৈরি করে দেশকে অস্থিতিশীল পরিবেশের মুখাপেক্ষী করেছিল। দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশকে স্থিতিশীল এবং শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যেই সম্ভবত বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামে একটি একক জাতীয় দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন; কিন্তু তার এই উদ্যোগ ভূলুণ্ঠিত হয়ে যায় বিরোধীদের ষড়যন্ত্রে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও নানা প্রেক্ষাপটের উপসংহারে একটি গণতান্ত্রিক রীতি অনুসরণ করে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যেতে চাইছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিতে এমনই এক বাধ্যবাধকতায় একটি নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তিন বছর পার করেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে তার স্বপ্নকে ভূলুণ্ঠিত করার সুযোগ পেয়েছিল বিরোধীরা; কিন্তু শেখ হাসিনার উদ্যোগ এবং প্রচেষ্টা নানাবিধ ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করে সরকারের উন্নয়নমুখী সফলতা দেশে-বিদেশে সরকারের সুনাম আনতে সক্ষম হয়েছে।
সাধারণত যে কোনো রাজনৈতিক দল গঠিত হয় কতগুলো নির্দিষ্ট নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে। রাজনৈতিক দলের মূল লক্ষ্য হলো বৈধভাবে ক্ষমতায় যাওয়া। বাংলাদেশে সংবিধান মেনে বৈধভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র পথ হলো নির্বাচন। আর এই নির্বাচনে বড় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজেদের নীতি ও আদর্শের স্বার্থে নির্বাচনে অংশ নেবেÑ এমনটাই স্বাভাবিক। আর এ বিষয়টি সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো যেমন তাদের অবস্থান দৃঢ় করবে, তেমনি ইসিও বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
আমরা লক্ষ্য করেছি, ইতোমধ্যেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার প্রত্যাশা করেছেন। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা প্রয়োজন। একই সঙ্গে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোটের মাঠ না ছাড়ার আহ্বান জানান।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন হিসেবে সিভিল সোসাইটির সদস্যরা মতামত দিয়েছিলেন। আবার তারা বলেছিলেন, এই নির্বাচন ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিএনপির একতরফা নির্বাচনের কলঙ্ক মুছে দেবে; অন্যদিকে আওয়ামী লীগের পূর্ববর্তী বাকশাল গঠনের দুর্নামকে পাকাপোক্ত করবে। এ ছাড়াও প্রশ্ন উঠেছিল, আওয়ামী লীগ কি ইচ্ছা করে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, না কি বিএনপির রাজনৈতিক কৌশলে আওয়ামী লীগের জন্য রাস্তা পরিষ্কার করেছিল। বিএনপি ভেবেছিল পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে যাবে; আর আওয়ামী লীগ আবার কলঙ্কিত হবে। আর বিএনপির কলঙ্ক কিছুটা লাঘব হবে; কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিএনপির অজান্তেই তাদের ধরাশায়ী করেছিল।
সংবিধান অনুযায়ী পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচন হবে- এটিই খুব স্বাভাবিক এবং নিঃসন্দেহে ন্যায্য। এতে কোনো দল নির্বাচনে এলো আর কোনো দল এলো নাÑ সেটি বড় কথা নয়। কারণ, এক্ষেত্রে না বললেই নয় যে, সামরিক শাসকরা নির্বাচন ছাড়াই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে বছরের পর বছর ক্ষমতায় থেকেছেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অন্তরালে সামরিক শাসকদের ক্ষমতায় আসার প্রক্রিয়া যথাযথ নয়। তবু তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেছেন ততদিন, যতদিন পরিস্থিতি অনুকূলে রাখতে সক্ষম হয়েছেন।
বর্তমানে যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে সরকার বিএনপির দেওয়া কোনো দাবি না মানলে, আর বিএনপি নির্বাচনে না এলে নির্বাচিত নতুন সরকারকে কোনোভাবেই পেছনে তাকাতে হবে না। দশম সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ বরাবরই বিএনপিকে সংবিধানের অধীনে থেকে সর্বোচ্চ ছাড়ের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল; কিন্তু আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এমন কোনো মানসিকতা আওয়ামী লীগের তৈরি হবে কিনা, সেটি দেখার বিষয়। তবে এবার আওয়ামী লীগ নতুন করে কোনো বিশেষ আহ্বান করবে না- এমনটা বিএনপিকে ধরে নিয়েই এগোতে হবে। আর আওয়ামী লীগও তাদের অবস্থান থেকে একবিন্দুও সরে আসবে নাÑ এমনটাই বর্তমান রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত। কাজেই বিএনপির পক্ষ থেকে খুব বেশি এদিক-সেদিক ভেবে লাভ হবে না, বরং নির্বাচনী প্রস্তুতিতে থাকাই শ্রেয় হবে। আবার অন্যদিকে আওয়ামী লীগকে ধরে নিতে হবে, বিএনপি যে কোনো মূল্যেই নির্বাচনে যাবে।
বিএনপির মতো একটি জনপ্রিয় দলের নির্বাচনে না যাওয়াটা রাজনৈতিকভাবে বুমেরাং। এখন আর পরিস্থিতি তেমন নেই যে, আওয়ামী লীগকে আবার আরো একটি একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বিএনপি লাভবান হবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলকেই মনে রাখতে হবে, নির্বাচনের প্রশ্নটি প্রতিশোধের নয়; জনগণের কল্যাণের, সর্বোপরি গণতন্ত্রের। রাজনৈতিক কৌশলগত অবস্থান এবং প্রতিশোধ- যাই বলি না কেন, কোনোটিই জনগণের কিংবা রাজনীতিবিদদের কল্যাণ বয়ে আনবে না। সবকিছুই রাজনৈতিক বুমেরাং হিসেবে দেশকে বড় ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি করবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়