যুদ্ধ মানেই জেদ। যুদ্ধ মানেই হিংসা-বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার ফল। যুদ্ধ মানেই বেপরোয়া আচরণ ও ঘোষিত সন্ত্রাস। যুদ্ধ শুরু হলেই জানমালের ক্ষয়ক্ষতি শুরু হয়, চারদিকে জন্ম নেয় হতাশা। যুদ্ধের অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে সৃষ্টি হয় শরণার্থী সমস্যা।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের তিন সপ্তাহের মাথায় শুরু হয়েছে চরম বিপর্যয়। রাশিয়ার আগ্রাসী আক্রমণে লণ্ডভণ্ড ইউক্রেনের শহর-নগর গ্রামীণ জনপদ। শুধু সামরিক স্থাপনায় আঘাতের কথা বলে রাশিয়া নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ি, সম্পদ গুঁড়িয়ে, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে বাস্তুহারা করেছে লাখ লাখ মানুষকে।জলে, স্থলে অন্তরীক্ষে মুহুর্মুহ: আক্রমণের মুখে ইউক্রেনকে বিধ্বস্ত করতে শুরু করলে ইউক্রেনও বসে থাকেনি। তারা নিজেদের আত্মরক্ষায় প্রতিরোধ গড়ে তুললে রাশিয়ান সৈন্যরাও নিহত হতে থাকে। ধ্বংস করা হয় ওদের বিমান, হেলিকপ্টার ও ট্যাংক। রাশিয়ার রাজপথে স্থানীয় যুদ্ধবিরোধী মানুষ প্রতিবাদে মিছিল নিয়ে নেমে পড়লে রাশিয়ান সরকার তাদেরকে গ্রেপ্তার শুরু করে। যুদ্ধের তেরো দিনের মাথায় কমপক্ষে সাড়ে সাত হাজার যুদ্ধবিরোধী মানুষকে ধরে কারাগারে প্রেরণ করে রাশিয়া। তার অর্থ রাশিয়ার মানুষও যুদ্ধ চায় না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট পুতিন বেপরোয়া। তিনি নানা অজুহাতে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন ইউক্রেনের মাটিতে।
মধ্যিখানে ইউক্রেনের বড় শহরগুলো থেকে সাধারণ নিরীহ মানুষকে দেশ ছেড়ে পালানোর পথ বের করে দেয়ার উছিলায় তিন দিনের যুদ্ধবিরতির কথা বললেও সেই সুযোগে বেশি বেশি সৈন্য ও গোলাবারুদ জমা করছে ইউক্রেনের তিন দিকের সীমান্তে।
কোনো কোনো জায়গায় যুদ্ধবিরতির মধ্যে আর্টিলারি গোলাবারুদের আঘাতে সীমান্তের গ্রামগুলোতে আগুন জ¦লছে। নারীর কান্না, শিশুর আর্তনাদ, অসুস্থ ও বয়স্ক মানুষের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠলেও এতটুকুও টলছে না পুতিনের পাষাণ হৃদয়। তার লক্ষ্য, ইউক্রেন দখলে নিয়ে সেখানে রাশিয়ান তাবেদারি সরকারকে ক্ষমতায় বসানো। পুতিনের মনমতো পুতুল সরকার যতদিন ইউক্রেনে বসানো হবে না ততদিন আক্রমণ চালিয়ে যাবেন তিনি।
ইতোমধ্যে প্রেসিডেন্ট পুতিনের কঠিন মনোভাবের বহির্প্রকাশ ঘটেছে তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের দামামা বাজানোর হুঙ্কারের মাধ্যমে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, ‘পরমাণু সন্ত্রাস চালাচ্ছে রাশিয়া’। একই সুর শোনা গেছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বক্তৃতায়। কারণ রাশিয়া পরমাণু অস্ত্র বের করে গুছিয়ে রাখার নামে ভয় দেখাচ্ছে ইউক্রেন তথা বিশ্ববাসীকে।
ইউক্রেনের পাঁচটি বড় শহর বেশি আক্রান্ত হয়েছে। রাজধানী কিয়েভ, খারকিত, সুমি ও মারিউপলের সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, বসতবাড়ির সিংহভাগ মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। রাস্তায় জমে আছে পরিত্যক্ত অবিস্ফোরিত বোমা, ভাঙাচোরা জিনিসের স্তূপ। মানুষ জীবন রক্ষার তাগিদে ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পোল্যান্ড, মলদোভা, বেলারুশ, হাঙ্গেরী, রুমানিয়া প্রভৃতি দেশের সীমান্তের দিকে ছুটে পালাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা রেডক্রস বলেছে, মারিউপলের পথে পথে মাইন ছড়িয়ে দিয়েছে রাশিয়ান বাহিনী। শরণার্থীরা মাইনের ভয়ে শহর ছেড়ে পালাতে ভয় পাচ্ছে। মার্চের ১০ তারিখে ইউক্রেনের তিনটি শিশু হাসাপাতালে বিমান দ্বারা বোমা হামলা করে ইতিহাসের ন্যক্কারজনক অধ্যায়ের সূচনা করেছে রুশ বাহিনী। নানা অজুহাতে দেশটিতে রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার শুরু করেছে বলে সংবাদে জানা গেছে। শত শত বেসামরিক মানুষের লাশের গণকবর দেয়া হচ্ছে একই গর্তের মধ্যে। নূরেমবার্গের পর এ যেন আধুনিক সভ্য মানবসভ্যতার ধ্বজাধারী নিষ্ঠুর মানুষদের এক অসভ্য ইতিহাস নতুন করে লেখা হয়ে যাচ্ছে।
ইউক্রেন ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। এ দেশটি প্রায় ছয়টি বাংলাদেশের সমান বড়। ইউক্রেনের আয়তন ৬ লাখ তিন হাজার পাঁচশত আটচল্লিশ বর্গকিলোমিটার হলেও এর জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে চার কোটি। আমাদের দেশের শুধু ঢাকা বিভাগেই পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষ বসবাস করে। দেশটিকে ‘ইউরোপের রুটির ঝুড়ি’ বলা হয়ে থাকে। খনিজসম্পদও প্রচুর। তাই এই দেশের মানুষকে যখন জীবনের ভয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে পালাতে বাধ্য করা হচ্ছে তখন সেখানকার অধিবাসীদের কিরূপ মনঃকষ্ট হচ্ছে তা বলাই বাহুল্য।
বলকান যুদ্ধের পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ সবচেয়ে বেশি শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টি করেছে বলে বিশ্লেষকগণ মতামত ব্যক্ত করেছেন। কামানের গোলা, বোমার আঘাতে রক্ত, ধোঁয়া ও কান্নার জলে ভেসে যাচ্ছে চারদিক। ইতোমধ্যে (০৮ মার্চ ২০২২) দেশ ছেড়েছেন ২০ লাখের অধিক মানুষ। আরো ছাড়বেন ৫০ লাখ মানুষ। জাতিসংঘ বলেছে, এই যুদ্ধের ফলে বাস্তুচ্যুত হতে পারেন ৭০ লাখের অধিক মানুষ।
দেশটির সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র জাফরজিগায় আগুন জ্বলছে। তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর ভয়ে আশপাশের মানুষ আতঙ্কে ঘরবাড়ি ছেড়ে শরণার্থী হয়েছেন। অজানার উদ্দেশ্য এক কাপড়ে ভিটেমাটি ছেড়ে তারা আজ শরণার্থী। যারা এখনো সীমান্ত পাড়ি দিতে পারেননি তারা নিকটস্থ রেলস্টেশনের সাবওয়েতে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু সেখানে অমানবিক পরিস্থিতির শিকার হয়ে বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। খাদ্য, পানীয়, ওষুধ, শৌচাগারের অভাবে তারা চরমভাবে বিপর্যস্ত।
রাশিয়ার পক্ষে আপাততঃ বেলারুশ ছাড়া আর কেউ নেই। তবে তারা সিরীয় ভাড়াটে সৈন্যদেরকে কিয়েভের রাস্তা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নিয়োগ দিয়েছে। এজন্য সিরীয়ায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে এবং বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বহু মানুষকে হতাহত করা হয়েছে। পরমাণু যুদ্ধের হুমকি ছাড়াও রাশিয়া সুখেই ও মিগ ২৯ বিমান দ্বারা নিরীহ মানুষের ওপর হামলা চালিয়েছে বলে সংবাদ হয়েছে। রাশিয়া জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ানসহ ৪৮টি দেশকে তার শত্রু তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।
শরণার্থীদের সহায়তায় জাতিসংঘ সেন্ট্রাল ইমার্জেন্সি ফান্ডের মাধ্যমে ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করছে। ইউএনএইচসিআর শরণার্থীদের রক্ষায় ১.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করছে। হলিউড অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি ও অভিনেতা অ্যাস্টন ইউক্রেনের শরণার্থীদের জন্য ৩০ লাখ মার্কিন ডলার সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
ন্যাটো ইউক্রেনে যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়ে কিছুটা নিরুত্তাপ। ন্যাটো হেডকোয়ার্টারের মুখপাত্র শুধু ‘আমরা সন্ত্রাস মোকাবিলায় প্রস্তুত’ শীর্ষক বিবৃতি দিয়ে খালাস। এ ছাড়া জাতিসংঘের পূর্বেকার সভাগুলোতে শুধু পক্ষপাতিত্বের সভা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়ে বিশ্ব নেতা ও সংস্থাগুলোর এমন ঢিলেমি মনোভাব গোটা বিশ্বকে অতি দ্রুত ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। মানুষের মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে নিত্যপণ্য পরিবহন ও ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলে সব দেশে হাহাকার শুরু হয়ে যেতে পারে। মলদোভা, বেলারুশ, হাঙ্গেরী, ভারত, বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের বাজারে এই প্রভাব ইতোমধ্যে লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। তার ওপর শরণার্থী সমস্যাকে মোকাবিলা করার সাহস ও সুযোগ হারিয়ে গেলে এবং করোনার নতুন কোনো ভেরিয়্যান্ট এসে হঠাৎ পুনরায় আক্রমণ শুরু করলে আরো ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে।
যুদ্ধের ফলে ইউক্রেনের মাটি, বাতাস, পরিবেশ নষ্ট করে, এত মানুষ হত্যা করে এবং লাখ লাখ মানুষকে বাস্তুহারা ও শরণার্থী করার দায় কি পুতিন নিতে পারবে? সামনের পৃথিবীটা কি এই মানবিক দায় নিতে পারবে? এই ভয়ঙ্কর অমানবিক দায় নেওয়ার জন্য পৃথিবীর কোনো নেতা বা কোনো সংস্থা কতটা প্রস্তুত তা কেউই মুখ ফুটে বলছেন না কেন?
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন