প্যারাসিটামল সিরাপ সেবনে শিশু মৃত্যুর ঘটনা বারবার আলোচনায় চলে আসছে। ১৯৯২ সালে ৭৬ শিশু এবং ২০০৯ সালে ২৮টি শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছিল। ৭৬ শিশুর মৃত্যু মামলার রায়ে সন্তুষ্ট হতে পারেনি ভুক্তভোগী পরিবার। ২৮ শিশুর মৃত্যুর মামলা ১২ বছর ধরে চলমান রয়েছে। এবার গত ১০ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে প্যারাসিটামল সিরাপ- নাপা সেবনে দুই শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনায় সারা দেশের পাইকারি ও খুচরা দোকান পরিদর্শন করে একটি ব্যাচের ওষুধ পরীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। ওষুধটি পরীক্ষা করে ন্যাশনাল কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিতে প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়েছে। ঘটনার পরই জেলায় এই সিরাপ বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতি। ঘটনার তদন্তে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে ওষুধ বিক্রেতার দোকানটি।
গত শনিবার ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ স্বাক্ষরিত এক আদেশে একথা বলা হয়েছে, ‘গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, বেক্সিমকো ফার্মাসিটিক্যালসের প্যারাসিটামল ১২০ মিলিগ্রাম ও ৫ মিলিগ্রাম সিরাপের (ব্যাচ নং ৩২১১৩১২১, উৎপাদন তারিখ ১২/২০২১, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ১১/২০২৩) ওষুধ সেবন করে একই পরিবারের দুই শিশু মারা গেছে। এমন পরিস্থিতিতে সারা দেশে বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়ে কর্মরত সব কর্মকর্তাকে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় অবস্থিত পাইকারি ও খুচরা ফার্মেসি পরিদর্শন করে ওই ব্যাচের নমুনা পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন ন্যাশনাল কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিতে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হলো’ বলে অধিদপ্তরের আদেশে বলা হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামে ইটভাটা শ্রমিক সুজন খানের দুই শিশু সন্তান ইয়াছিন খান(৭) এবং মোরসালিন খান (৫) জ্বরে আক্রান্ত হয়। গত বৃহস্পতিবার রাতে প্যারাসিটামল সিরাপ খাওয়ার পর দুই ভাইয়ের মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ করে তাদের পরিবার। দুই শিশুর পিতা সুজন খান ভোরের আকাশকে জানান, নাপা সিরাপ খেয়েই আমার দুই সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। তারা কয়েক দিন ধরে জ্বরে ভুগছিল। বৃহস্পতিবার বিকালের দিকে বাড়ির পাশের একটি দোকান থেকে নাপা সিরাপ এনে খাওয়ানো হয়েছিল। বিকেলে পাঁচটার দিকে দুজনকে একই সাথে একই বোতল থেকে এই সিরাপ খাওয়া হয়। এর কিছুক্ষণ পরই দুজনেই বমি করতে শুরু করে। বমি করার পর পরই তাদের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। প্রথমে আশুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখানে থেকে রেফার করা হয় জেলা সদর হাসাপাতালে। সেখান থেকে চিকিৎসা দিয়ে আনার পথে বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে ইয়াসিনের মৃত্যু হয়।
সন্তানদের মৃত্যুর পর আশুগঞ্জ থানায় লিখিত অভিযোগ দেন বাবা সুজন খান। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ রহমান জানান, অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, সিরাপ খাওয়ানোর কারণেই তার দুই ছেলের মৃত্যু হয়েছে। অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গত শুক্রবার বিকেলে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়। এদিন সন্ধ্যায় পুরো জেলায় হঠাৎ ওই সিরাপ বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতি।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থলে যায়। মৃত দুই শিশুর মা, বাবা, চাচা ও দাদির সাক্ষাৎকার নেয় তদন্ত কমিটি। পরে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ও তদন্ত টিমের প্রধান ডা. আকিব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, যে ওষুধটা নিয়ে কথা ওই ঔষধ ইতোমধ্যে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। পরীক্ষাও শুরু হয়ে গেছে। এখন সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ওই জাতীয় ওষুধের অন্যান্য যে ব্যাচ আছে সেগুলোও সংগ্রহ করে ঢাকা পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
ডা. আকিব হোসেন আরো বলেন, মৃত দুই শিশুর মা, বাবা, চাচা ও দাদির সাক্ষাৎকারে তদন্ত কমিটিকে তারা জানিয়েছেন, সিরাপ ঢেলে খাওয়ানোর জন্য প্রতিটি বোতলের সাথে যে কর্ক থাকে সেই কর্কের অর্ধেক পরিমাণ ঢেলে দুটি শিশুকেই খাওয়ান। খাওয়ানোর ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই বিষয়টি আমরা এখন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করব। আসলে কী হয় বা কী এমন জিনিস দিতে পারে যে, ১০ থেকে ১৫ মিনিটে একটা ওষুধ যে মানব সেবায় ব্যবহৃত হয়, মানুষের ক্লেস দুর করার জন্য সেটি এত তারাতাড়ি রিয়্যাক্ট করল- এটা আসলে একটা রহস্য জনক বিষয়। এই রহস্য উদ্ঘাটন করতে হয়তোবা সময় লাগবে।
২০০৯ সালের জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত রিড ফার্মার ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ সেবন করে সারা দেশে ২৮টি শিশু মারা যাওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। এরপর ওই বছরের ১০ অগাস্ট ঢাকার ওষুধ (ড্রাগ) আদালতে পাঁচ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয় । এ মামলায় বিচার শেষে ঢাকার ড্রাগ আদালত আসামিদের খালাস দেয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল আবেদন করে সরকার। এই আপিল এখনো বিচারাধীন। তবে মামলায় তদন্তে গাফিলতির কারণে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করে। এ রিট আবেদনটিও হাইকোর্টে বিচারাধীন বলে জানান সংশ্লিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।
গত ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ ও ওষুধ আদালতে ২৬ বছর ঝুলে থাকা এ মামলায় সংশ্লিষ্ট বিচারক সৈয়দ কামাল হোসেন রায় ঘোষণা করেন।
এদিকে, গতকাল রোববার রাজধানীতে বাংলাদেশে সোসাইটি অব মেডিসিন আয়োজিত সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ওই ঘটনা তদন্তে জেলার সিভিল সার্জনসহ কর্মকর্তাদের পাঠানো হয়েছে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে যে ফার্মেসি থেকে ওষুধ নেওয়া হয়েছে সেখানে ওষুধ বিক্রি বন্ধ রাখা হয়েছে। নাপার ওই ব্যাচের ওষুধ বাজার থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে কি না এমন প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর দেননি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, ‘ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর যা যা করা প্রয়োজন তা করছে। আমাদের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগও বিষয়টির ওপর কাজ করছে। ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে সেটা আপনারা দেখতেই পারবেন।’