পূর্ণ উদ্যমে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গতকাল থেকে শুরু হয়েছে শিক্ষা কার্যক্রম। প্রায় দুই বছর পর সশরীরে সব স্কুল-কলেজে পাঠদান শুরু হলো। সকাল থেকেই শিক্ষার্থীদের কলরবে মুখরিত হয়ে ওঠে দেশের সব স্কুল-কলেজ প্রাঙ্গণ। উচ্ছ্বাস নিয়ে স্কুলে যায় ছাত্র-ছাত্রীসহ অনেক অভিভাবকরাও।
দীর্ঘদিন পর কোভিডের ধাক্কা কাটিয়ে উঠে বিদ্যালয়গুলো পরিণত হয়েছে মিলনমেলায়। স্কুলে ভর্তি হয়ে অনলাইন ক্লাসেই কেটে গেছে দুই বছর। সেসব শিক্ষার্থীদের অবশেষে পরিচয় ঘটল ক্লাস রুম, স্কুল বেঞ্চ, ব্ল্যাক বোর্ড আর বন্ধুদের সঙ্গে। তবে শুরুর দিনে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে অভিভাবকসহ শিক্ষার্থীরা ছিলেন বেশ সচেতন।
গতকাল মঙ্গলবার অফিসগামী ও সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সকাল থেকেই হাজারো শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের যাতায়াত শুরু হয়। তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তি মানুষের চলাচল রাজধানীর সড়কে যানজটে বাড়তি মাত্রা যোগ করে। বিকাল পর্যন্ত নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সব পথেই যানজট ছিল অনেক বেশি। তাই অলিগলিতেও অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ সময়।
পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরোদমে চালু হওয়ায় ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ বেড়েছে। তাই বিভিন্ন সড়কে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশের সড়কগুলোতে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত যানজট ছিল অসহনীয় মাত্রায়। যার প্রভাব পর্যায়ক্রমে অন্য সড়কগুলোতেও পড়ে।
সকালে আইডিয়াল স্কুলের মুগদা শাখায় গিয়ে দেখা গেছে, পুরোদমে পাঠদান চলছে। বাইরে অপেক্ষা করছেন অভিভাবকরা। একই চিত্র মতিঝিল আইডিয়াল, মডেল, গভ. বয়েজ ও গার্লস স্কুলেও দেখা গেছে। প্রাইভেট কারে করে শিক্ষার্থীদের আনাগোনা করায় কমলাপুর, মতিঝিল, শাহজাহানপুর, আরামবাগ, ফকিরাপুল এলাকাতেও যানজট ছড়িয়ে যায়।
সকালে অফিসগামী শাহীন রহমান জানান, আগে প্রতিটি সিগন্যালে আট মিনিট বিলম্ব হলেও আজ ১৫ মিনিটেও তা ছাড়া হচ্ছে না। তাই খিলগাঁও থেকে চারটি সিগন্যাল পার হয়ে দৈনিক বাংলা মোড়ে আসতে সময় লেগেছে দেড় ঘণ্টারও বেশি। এ ছাড়া রাজধানীর পল্টন, শাহবাগ, ফার্মগেট, তেজগাঁও, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, রামপুরা, ধানমন্ডি, ঝিগাতলা, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় বিকাল অবধি যানজট দেখা যায়।
সশরীরে পূর্ণাঙ্গ শ্রেণি কার্যক্রমে ফিরতে দুই বছরের অপেক্ষার অবসান হওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে অভিভাবকদের মনেও। তাদের আশা, পুরোদমে ক্লাস শুরুর পর মহামারিকালের শিখন ঘাটতি কিছুটা হলেও কাটিয়ে ওঠা যাবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে স্বাভাবিক নিয়মে প্রতিদিন ক্লাস শুরু হয়েছিল ২ মার্চ থেকেই। তবে মাধ্যমিকে ক্লাস হচ্ছিল সীমিতভাবে; মঙ্গলবার তারাও পুরোদমে শ্রেণি কার্যক্রমে ফিরেছে।
আর প্রাক-প্রাথমিকের, অর্থাৎ নার্সারি-কেজির মতো ছোট শ্রেণির ক্লাসগুলো শুরু হলো দীর্ঘ দুই বছর পর। মহামারি পরিস্থিতিতে অনলাইনেই বিভিন্ন স্কুলগুলো তাদের ক্লাস নিয়ে আসছিল। অর্থাৎ, এসব স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার পর মঙ্গলবারই প্রথম ক্লাসে যাওয়ার সুযোগ পায়। এইচএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার্থীরা এতদিন চারটি বিষয়ে এবং দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা তিনটি বিষয়ে প্রতিদিন ক্লাস করে আসছিল।
অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে সপ্তাহে দুই দিন তিন বিষয়ে এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে এক দিন তিন বিষয়ের ক্লাস হচ্ছিল। সব শ্রেণির ক্লাস একসঙ্গে শুরু হওয়ায় স্কুল এলাকাগুলোও ফিরে আসে চেনা চেহারায়।
২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। এরপর ব্যাপক বিধিনিষেধের মধ্যে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না আসায় দেড় বছর দফায় দফায় ছুটি বাড়াতে থাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়।
তবে সীমিত এই শ্রেণি কার্যক্রম আবার বন্ধ হয়ে যায় গত ২১ জানুয়ারি। করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের দাপটে এ দফায় এক মাস বন্ধ থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ২২ ফেব্রুয়ারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেও পুরোদমে ক্লাস শুরু করতে আরো অপেক্ষা করতে হয় শিক্ষার্থীদের। দুই বছর পর মঙ্গলবার শ্রেণিকক্ষে ফিরে সেই অপেক্ষা শেষ হলো তাদের।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ তেজগাঁও বিভাগের ট্রাফিক উপ-পুলিশ কমিশনার সাহেদ আল মাসুদ বলেন, স্কুলে আসা অনেক গাড়িই সড়কের পাশে পার্কিংয়ে রাখা হয়েছে। স্কুল-কলেজ পুরোদমে খোলায় সড়কে গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে, সেইসঙ্গে অফিসগামী মানুষের চাপতো আছেই। যে কারণে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র যানজটের। বিষয়টি সামাল দিতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে, তবে আমরা আমাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছি।
এদিকে সকাল থেকে বিভিন্ন সড়কে যানজটে আটক পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন অনেকেই। সাহিত্যিক আনিসুল হক তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘গুগল ম্যাপ বললো, নজরুল ইসলাম এভিনিউ ধরলে ৪ মিনিট বাঁচবে, লাগবে ২২ মিনিট। মগবাজার ফ্লাইওভার বাদ দিলাম ৪ মিনিট বাঁচাতে। সোয়া এক ঘণ্টা কেটে গেল...আমি অপার হয়ে বসে আছি...মাঝপথে... ওহে দয়াময়... পারে লয়ে যাও আমায়’।
মিরপুর ১২ নম্বরের রশীদ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাওহিদা ইসলাম প্রতিদিন ক্লাস শুরু হওয়ায় খুব খুশি। সে বললো, আমাদের সপ্তাহে দুই দিন ক্লাস ছিল। বাসায় তো সেভাবে পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না। স্কুলে বন্ধুবান্ধব, টিচারদের সঙ্গে দেখা হয়। সরাসরি ক্লাসের আনন্দটাই অন্যরকম।
ঢাকা আইডিয়াল প্রিপারেটরি স্কুলের অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রের মা বললেন, প্রতিদিন ক্লাস না থাকায় তার বাচ্চা পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়েছে। স্কুল খোলার পর থেকে বেশ কিছুদিন স্কুলে আসবে বলে সে আসেনি। বাইরে গেমস খেলেছে। আমাকে টিচাররা জানানোর পর আমি একদিন প্রমাণ পেয়েছি। স্কুল টাইমে বাইরে ঘুরে পরে সে বাসায় চলে আসে।
ঢাকা গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ ভূঁইয়া বলেন, আমাদের প্রতিটি ক্লাসই আজ এসেছে। মহামারির আগের মতোই শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করতে পেরেছি। বাচ্চারাও খুব উৎসাহী। আমরা যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাস নেওয়ার চেষ্টা করছি।