বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে অনেকদূর। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান, শিল্প-প্রযুক্তি, সংস্কৃতি প্রভৃতি খাতে অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করে আমরা এখন চালকের আসনে। একটা সময় ছিল যখন আমাদের দেশের মানুষগুলোর আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, পুরুষরা এক টুকরো কাপড় জড়িয়ে থাকত, আর আমাদের মা-বোনদের অনেকেরই শুধু শাড়িটাই ছিল প্রধান অবলম্বন। অন্যান্য আনুষঙ্গিক প্রয়োজনীয় জিনিস ছিল ধারণারও বাইরে। গোসলের জন্য সুগন্ধি সাবান দূরে থাক, মাঝে মাঝে কাপড় কাঁচা ৫৭০ সাবানও পাওয়া কঠিন হয়ে যেত। সময় বদলেছে। এখন অনেক কিছুই মিলছে। শিল্পে, বিশেষত গার্মেন্টস সেক্টরে বাংলাদেশ আজ শীর্ষস্থানীয়।
রাস্তাঘাট কল-কারখানা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণে এসেছে অভূতপূর্ব সাফল্য। বিশেষ করে, বিগত দেড় দশকে যে অসামান্য পরিবর্তন সূচিত হয়েছে তা উল্লেখ করার দাবি রাখে। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ধর্মীয় রাজনীতির নামে যে প্রতারণার খেলা চলছিল তার থেকে একটা বিরাট জনগোষ্ঠীর মোহভঙ্গ করতে সক্ষম হয়েছে। একটা বিষয় অত্যন্ত ভালো লেগেছে যে, মানুষের ভেতরে কুসংস্কার অনেকটাই কমে এসেছে। আজকাল আর বৈদ্য, তান্ত্রিক, ওঝা, ঝাঁড়ফুক করা লোকজন খুব একটা দেখা যায় না।
উন্নত দেশে গিয়ে পড়াশোনার প্রতি যে একটা অলিখিত আতঙ্ক বা অনীহা কাজ করত তার থেকে অনেকটাই বেরিয়ে আসতে পেরেছে আমাদের তরুণ সমাজ। তারা আজ উন্নত শিক্ষার জন্য পৃথিবীর যেকোনো দেশে যেতে প্রস্তুত। এটা ভীষণ ভালো একটা দিক।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে একটার পর একটা বিতর্কে জড়ানো হয়েছে দেশটাকে। বোঝাই যায়, অসৎ উদ্দেশ্য নিয়েই এসব করা হয়েছিল। পাকিস্তান-আমেরিকা এরাই এসবে বড় ভূমিকা রেখেছিল। সময় বদলেছে। আজ আমেরিকার মিত্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী রাশিয়া ভ্রমণ করেন; ‘পাশে আছি’Ñ এই কথার জানান দিতে। পৃথিবী একটা অদ্ভূত জায়গা। এখানে ‘অপেক্ষা’ অনেক কিছুর সমাধান দেয়। সবকিছু জানা-বোঝার জন্য দার্শনিক হতে হয় না।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের জটিল পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু অসাধারণ সাহসী মানুষ পেয়েছিলাম। সবার আগে যার নাম বলব তিনি জহির রায়হান। ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে তিনি নিখোঁজ হন।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর আমরা দেখি কাদের সিদ্দিকীকে। নব্বইয়ের গণআন্দোলনের সময় সরকারের চাকরি করা সত্ত্বেও মহিউদ্দীন খান আলমগীর রেখেছিলেন অসাধারণ ভূমিকা। সচিবালয়ের বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে রাজপথে এসে তিনি যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা সত্যিই অসাধারণ ছিল।
আমাদের হতাশা অনেক। না পাওয়ার তালিকাও বেশ দীর্ঘ। এর মধ্যে কিছু কিছু অর্জন মন ভরিয়ে দেয়। ক্রিকেট তেমন একটি জায়গা। বিশেষ করে, মাশরাফি বিন মর্তুজা আর সাকিব আল হাসানসহ অন্যরা। বলতে গেলে সমগ্র দেশবাসীর মন জয় করেছে ক্রিকেট। এদের সম্মান করতে হবে। এরা আমাদের জাতীয় বীর।
অর্থনীতির কথা বলতেই হবে। অতীতে মাথাপিছু আয় যা ছিল তা উল্লেখ করার মতো নয়। এখন এটা গর্ব সহকারে উল্লেখ করার মতো। ঋণ সক্ষমতা বাড়ার কারণে সম্ভব হচ্ছে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল, ঢাকার মেট্রোরেল, উড়াল সেতু, ইত্যাদি ইত্যাদি বদলে দিয়েছে দেশের চেহারা।
পিছু টানার লোকের অভাব ছিল না কখনোই। পরাজিত শক্তি শকুনের মতো বারবার খামচে ধরেছে জাতির পতাকা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জাতির জনকের সপরিবারে হত্যার বিচারসহ অনেক বিতর্কিত হত্যাকাণ্ডের বিচার গ্লানিমুক্ত হতে সাহায্য করেছে এক্ষেত্রে। শান্তি আর স্বস্তি এসেছে অনেকের অন্তরে।
এমন একটা সময় এসেছিল মুক্তিযোদ্ধা হওয়াটাই যেন ছিল একটা অপরাধ। কিন্তু আজ সে অবস্থার অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে। তবে এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, অজস্র ভুয়া সনদধারী মুক্তিযোদ্ধার দৌরাত্ম্যে পুরো জাতিকেই অনেক সময় বিভ্রান্ত হতে হয়। এর সমাধান হওয়া জরুরি।
প্রচুর ভালো কাজ হচ্ছে। তবে এর পাশাপাশি এটাও প্রত্যাশিত যে, দুদক আর এনবিআর আরো কার্যকর ও শক্তিশালী হবে। তাছাড়া শুধু কোনো একটা অন্যায়ের ঘটনা জানাজানি হলেই যে শুধু সেটার ব্যবস্থা নিতে হবে তা নয়। প্রতিটি সেক্টর থেকে দুর্নীতি নির্মূল করার জন্য বদ্ধ পরিকর হতে হবে।
একটা সভ্যতা গড়ে ওঠার জন্য পঞ্চাশ বছর খুব একটা বেশি সময় না। তার মধ্যে এর বেশিরভাগ সময়টাতেই যারা ক্ষমতায় ছিল তাদের উদ্ভট ভাবনার কারণে আরো পশ্চাতে যেতে হয়েছে। সেই গভীর খাদ থেকে দেশটাকে টেনে তোলা সহজ কথা নয়। তবে সজাগ থাকতে হবে। কোনো মোহ সৃষ্টিকারী জাদুকর যেন তাদের মোহ সৃষ্টিকরা কথা দ্বারা মোহাচ্ছন্ন করে আবার সর্বনাশ করতে না পারে।
একটা দেশের শক্তিশালী অবস্থানের জন্য এর দরকার একটা শক্তিশালী মিডিয়া। এদিক দিয়ে আমরা আজও অনেকটা পিছিয়ে। আমাদের যেমন কোনো বিশ্বমানের টিভি স্টেশন যেমন- সিএনএন, বিবিসি, আলজাজিরার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, তেমনি নেই নিউ ইয়র্ক টাইমস, হেরাল্ড ট্রিবিউন বা দ্য ডন-এর মতো কোনো পত্রিকাও। এই ব্যাপারটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অন্ততঃ আজকের সময়টাতে। তবে, বেশকিছু গণমাধ্যম উদ্যোমী মনোভাব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে- বলাই যায়।
আমাদের শিশুরা কিভাবে বেড়ে উঠছে তা ভেবে দেখতে হবে। তাদের শৈশব তাদের হক। তা তাদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে। তবেই তারা গড়ে উঠবে চমৎকার কিশোর-কিশোরী হিসেবে। আর এরাই গড়ে তুলবে আগামীর নতুন প্রজন্ম। কাজেই, এদের শুরুটা ভালো হওয়া দরকার।
একটা বিপর্যস্ত ইতিহাসের ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। ইংরেজদের ১৯০ বছর সময়কালে এই ভূ-খণ্ডের প্রতি চরম অবহেলা এবং পরবর্তীতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিমাতাসুলভ আচরণ আমাদের বিধিলিপির যে করুণ চিত্র এঁকে দিয়েছিল, তাকে মনের মতো করে সাজানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন একজন রাখাল রাজা। তিনি আর কেউ নন- বাঙালির বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তার আজীবনের সাধনায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে আমাদের জন্য একটা স্বাধীন ভূ-খণ্ডের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হন। কিন্তু অকৃতজ্ঞ আমরা সেই বিরাট হৃদয়ের মানুষটিকেই স্বাধীনতার মাত্র ৩ বছর ৮ মাসের মাথায় সপরিবারে হত্যা করেছিলাম। এর ঠিক কিছুদিন পরই আমরা হত্যা করেছিলাম জেলখানায় বন্দি জাতীয় চার নেতাকে। তাদের সেই রক্ত ঋণ হয়তো কোনোদিন শোধ হবে না।
মাত্র এক যুগ হচ্ছে, সুষম উন্নয়নের ধারা শুরু হয়েছে। তার সুফল ইতোমধ্যে পেতে শুরু করেছে পুরো দেশ। ঘরে ঘরে ভাতার টাকা পৌঁছে যাচ্ছে। এটা যদিও শেষ কথা নয় তবে, এটা অবশ্যই গুরুত্বের দাবি রাখে যে, সর্বস্তরে একটা গণজাগরণের সৃষ্টি হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামটা অশান্ত ছিল। এর ফায়দা অনেকেই অনেকভাবে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে দীর্ঘদিন পর ক্ষমতায় এসে পাহাড়ে শান্তি এনে দিয়েছিল।
সে তো এক মহাকাব্যিক অর্জনের গল্প। সাম্প্রতিক সময়টাতে সমুদ্র সীমা বিজয়ও আমাদের একটা বড় সাফল্য। এসব অর্জন আমাদের দিন দিন সমৃদ্ধ করছে। অশিক্ষা বাঙালির সবচেয়ে বড় অভিশাপ ছিল। আর এই অশিক্ষার কারণেই সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরেই তথাকথিত ‘গড অব স্মল থিংস’ তৈরি হয়েছিল। হাল আমলে এই অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। মানুষ সচেতন হয়েছে।
হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব বলতে মূলতঃ কিছু নেই। কোনো ধর্মেই অন্য ধর্মের প্রতি কোনো বিষ বা বিদ্বেষ ছড়ানো হয়নি। শুধু পার্থিব সুযোগ-সুবিধা, তা সে পারিবারিক, সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক, দেশীয় কিংবা আন্তঃদেশীয়- যাকে আমরা জাতীয় বা আন্তর্জাতিক বলে থাকি, হাসিলের জন্যই এসব ছড়িয়ে থাকি। এসব ঘৃণ্য প্রচেষ্টা শুরুতেই রুখে দেওয়া উচিত।
স্বাধীনতার পর থেকেই সড়কের অবস্থা বেহাল। বঙ্গবন্ধু খুব কমই সময় পেয়েছিলেন। এর মধ্যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন- বন্যা, দুর্ভিক্ষ এসবের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র সবই একাকার অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। তিনি শেষ রক্ষা করতে পারেননি। সপরিবারে নিহত হয়েছেন। এরপর যারা এলেন তারা মতবাদ নিয়ে এতটাই মাতলেন যে, জনগণকে ‘গিনিপিগ’ বানিয়েই ক্ষান্ত হলেন। তাতে লাভও হলো। আমরা দু-দুটো নতুন রাজনৈতিক দল পেলাম। পাশাপাশি পেলাম যুদ্ধাপরাধের কারণে বাদ পড়া নর্দমার কীটদের। উপর্যুক্ত পরিবেশে তারাও শুরু করল বংশ বিস্তার। সব মিলিয়ে আমরা একটা আজব দেশে পরিণত হলাম। খুব ঠান্ডা মাথায় ওখান থেকে দেশটাকে টেনে তুলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মাথায় রাখতে হবে তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা। এদেশের মাটি তার মহান পিতা আর সব আপনজনদের রক্তে ভেজা।
বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে একটি ক্ষুদ্র আয়তনের দেশ। জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ। দুর্বল অর্থনীতির কারণে বিশ্ব দরবারে একসময়ের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ তার সৃজনশীল চিন্তাভাবনা ও দূরদর্শিতার কারণে আজ বিশমঞ্চে সম্মানের আসনে আসীন। এই অর্জন অবশ্য অনেকের গাত্রদাহ সৃষ্টি করছে। করারই কথা। যাদের হৃদয় পড়ে থাকে অন্যত্র, এ দেশের মুক্তি তথা উন্নয়নে তাদের গাত্রদাহ হবে- এটাই স্বাভাবিক।
লেখক : সাহিত্যিক ও কলাম লেখক