logo
আপডেট : ১৭ মার্চ, ২০২২ ০৯:৩৬
মুক্তির নায়ক: শুভ জন্মদিন
প্রফেসর ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ

মুক্তির নায়ক: শুভ জন্মদিন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফাইল ছবি

মার্চ- বাঙালির জাতীয় জীবনে এক বিশেষ গুরুত্ববহ মাস। এই মাসে বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, রাজনীতির মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ মাসে সেই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্বের জন্মদিনও। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেন বাঙালির মুক্তির মহানায়ক শেখ মুজিব।

আবহমান গ্রামবাংলার আর দশটা গ্রামের মতই টুঙ্গিপাড়া। গ্রামের বিভিন্ন কোণে এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে বাইগার নদী; যা পতিত হয়েছে মধুমতিতে। এই গ্রামের ধূলিকণায় খেলে বেড়ে ওঠেন সবার প্রিয় ‘খোকা’। ‘খোকা’ থেকে যিনি রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের কাছে হয়ে ওঠেন ‘প্রিয় মুজিব ভাই’। ছাত্রজনতার ‘বঙ্গবন্ধু’ থেকে ‘গণমানুষের মুক্তির মহানায়ক’।

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা থেকে এক স্বাধীন জাতির পিতা। ৫১ বছর বয়সে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আর ৫৫ বছর বয়সে বিয়োগান্ত হত্যাকাণ্ডে জীবনাবসান। উত্তাল এই জীবনের মহামান্বিত পুরুষ শেখ মুজিবুর রহমানকে জানাই জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

পাঁচ দশক আগে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের এমনই এক মার্চে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন তিনি। সে ডাকে সাড়া দিয়ে মাত্র ৯ মাসে ৩০ লাখ মানুষ বুকের তাজা রক্ত ঢেলে নিয়ে আসে স্বপ্নের স্বাধীনতা। এর জন্য মানুষকে তিলে তিলে তৈরি করেছেন তিনি। নিজেও তিলে তিলে সয়েছেন শত যন্ত্রণা। জীবনের ১৪টি বছর কাটিয়েছেন কারাগারে। এভাবেই তার হাত ধরে বিশ্ব মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ।

৭ই মার্চ জনসমুদ্রে ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা’ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এরপর ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে আটক হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় প্রতিরোধযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ।

২৫শে মার্চের রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে সাংবাদিক ডেভিড লোশাক দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় লেখেন, ‘অন্ধকার নেমে আসার কিছুক্ষণ পর, সরকারি মালিকানাধীন পাকিস্তান রেডিওর তরঙ্গের কাছাকাছি একটি তরঙ্গের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। শেখ মুজিবুর পূর্ব বাংলাকে গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ বলে ঘোষণা করেছেন। তার বাণী নিশ্চয়ই ইতিপূর্বে রেকর্ড করা হয়েছিল এবং তার কণ্ঠস্বর শুনে তাই মনে হয়েছে।’ (তথ্যসূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র : তৃতীয় খণ্ড, সম্পাদক : হাসান হাফিজুর রহমান)

বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর নির্যাতিত মানুষের নেতা, বিশ্বনেতা। গরিব-দুঃখী মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও তাদের দুঃখ দূর করার প্রতিজ্ঞা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানসিকতা তাকে রাজনীতিতে নিয়ে আসে। মানুষের অধিকার আদায় করতে গিয়ে সেই স্কুলজীবনেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। গ্রামের স্কুলে তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি।

১৯২৭ সালে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন এবং এখানেই ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৪১ সালে অসুস্থ শরীর নিয়েই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন। ছাত্রজীবনেই মানুষের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করেন তিনি। আর এভাবেই সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে যান রাজনীতিতে।

রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর পিতা লুৎফর রহমান কখনো তাকে বাধা দেননি। যা নিজেই লিখেছেন তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। বাবা লুৎফর রহমানের কথা উল্লেখ করে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘বাবা রাজনীতি করো আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছো- এ তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রেখো, ‘Sincerity of purpose and honesty of purpose’ থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না। এ কথা কোনোদিন আমি ভুলি নাই।’’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-২১)


ম্যাট্রিক পাসের পর কিশোর মুজিব ভর্তি হন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে। সেখানকার ছাত্র থাকা অবস্থায় তার রাজনৈতিক জীবনের বড় পরিবর্তনগুলো শুরু হয়। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় হন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমের মতো নেতাদের সান্নিধ্যে আসেন।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর শেখ মুজিব ঢাকায় চলে আসেন। নতুন রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা নিয়ে ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ গঠন করেন। ১৯৪৯ সালে নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনে অংশ নেন।

এর মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৮-এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন এবং ১৯৬৬-এর ঐতিহাসিক ছয় দফাভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা।

১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ছাত্র জনতা তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করে।

’৪৭ থেকে ’৭১ সাল পর্যন্ত ২৪ বছরে বঙ্গবন্ধু ১২ বছর কারান্তরীণ ছিলেন। আর ১২ বছর কাটিয়েছেন পুলিশি নজরদারিতে। স্বাধীনতাযুদ্ধর নয় মাসও ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে। অনুপস্থিত থেকেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালির অন্তরে। তার কালজয়ী ভাষণ শুনে শুনে উজ্জীবিত হয়েছে বাংলার দামাল ছেলেরা, বীর মুক্তিযোদ্ধারা। বঙ্গবন্ধুর নামে এভাবেই হাসতে হাসতে দেশমাতৃকার ডাকে তারা বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের জীবন।

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এরপর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পান বঙ্গবন্ধু। সেখান থেকে ইংল্যান্ড যান। এরপর সেখান থেকে দিল্লি হয়ে স্বদেশের মাটিতে তিনি পা রাখেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি।

স্বাধীনতার স্থপতিকে বরণ করতে সেদিন লোকারণ্য ছিল ঢাকার পথঘাট। পিতাকে কাছে পেয়ে বর্ণনাতীত কষ্টের মাঝেও নতুন করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে সব হারানো বাঙালি জাতি। বিজয়ের উল্লাসে আনন্দাশ্রু ঝরেছিল।

তাই তো দেশে ফিরেই রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) তার ভাষণে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটি নতুন করে গড়ে তুলতে সবার সহযোগিতা চান বঙ্গবন্ধু। জানান তার পরিকল্পনার কথা। পাশাপাশি তার ডাকে মানুষ যে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, সে জন্য সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান তিনি।

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ ...বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র। বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে, বাংলাদেশকে কেউ দমাতে পারবে না। বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে লাভ নাই। আমি যাবার আগে বলেছিলাম- ও বাঙালি এবার তোমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, আমি বলেছিলাম- ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল; তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে সংগ্রাম করছো। আমি আমার সহকর্মীদের মোবারকবাদ জানাই। আমার বহু ভাই, বহু কর্মী, আমার বহু মা-বোন আজ দুনিয়ায় নাই তাদের আমি দেখব না।’

‘ ... আমি আজ বাংলার মানুষকে দেখলাম, বাংলার মাটিকে দেখলাম, বাংলার আকাশকে দেখলাম, বাংলার আবহাওয়াকে অনুভব করলাম। বাংলাকে আমি সালাম জানাই, আমার সোনার বাংলা তোমায় আমি বড় ভালোবাসি- বোধ হয় তার জন্যই আমায় ডেকে নিয়ে এসেছে।’

স্বাধীনতার পর অল্প সময় পেয়েছিলেন জাতির পিতা। তিনি ঠিক শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন। সম্পদ বলতে তার কিছুই ছিল না। ছিল শুধু জনগণ। জনগণের ঐক্য। আর তা নিয়েই শুরু করেছিলেন পথচলা। আর সেই জনগণকেই দেশ গড়ার কাজে নেমে পড়ার আহ্বান জানালেন তিনি।

বললেন, ‘আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম- ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়। আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের যুবক যারা আছে তারা চাকরি না পায়। মুক্তিবাহিনী, ছাত্রসমাজ তোমাদের মোবারকবাদ জানাই, তোমরা গেরিলা হয়েছো তোমরা রক্ত দিয়েছো, রক্ত বৃথা যাবে না, রক্ত বৃথা যায় নাই।’

সত্যিই শহীদের রক্ত বৃথা যায়নি। বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে অন্তর্ভুক্তির জন্য জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ অর্জন করেছে। যা সম্ভব হয়েছে কেবল তারই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে।

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন অর্থাৎ ১৭ মার্চ দেশে ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। তিনি শিশুদের প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। ওই দিনটিতে তিনি আনুষ্ঠানিক জন্মদিন পালন না করে শিশুদের নিয়ে আনন্দঘন সময় কাটাতেন। বাংলাদেশে শিশুর কল্যাণ ও উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট চারটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

এক. শিশুকল্যাণের জন্য মায়েদের সম্পৃক্ত করে প্রতিষ্ঠা করেন মা ও শিশুকল্যাণ অধিদপ্তর।

দুই. শিশুর সার্বিক উন্নতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় শিশু একাডেমি। উল্লেখ্য, এ দুটো প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত ভাবনা-পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধুর সব সময়ই ছিল।

তিন. শিশুর শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়। বাংলাদেশের সে সময়ের সার্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্তটি ছিল সাহসী ও যুগান্তকারী।

চার. ১৯৭৪ সালের ২২ জুন শিশুআইন জারি করা হয়। এ আইন শিশু অধিকারের রক্ষাকবচ।

বিশাল হৃদয়ের অধিকারী বঙ্গবন্ধু ছিলেন শিশুর মতো সরল। তার এই সারল্যকে কাজে লাগিয়েছে ঘাতকচক্র। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পর ব্রিটিশ এমপি জেমস ল্যামন্ডের খেদোক্তি ছিল এমন- ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশই শুধু এতিম হয়নি, বিশ্ববাসী একজন মহান সন্তানকে হারিয়েছে।’

বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মাঝে নেই। তার আদর্শ রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় চেতনা ও আদর্শে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাঙালিকে আর দাবায়া রাখতে পারবে না কেউ।

লেখক: উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়