জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র ৩ বছর ৮ মাস। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু প্রথমে যান লন্ডনে। সেখান থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হন। এর পূর্বে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পেয়ে সহযোদ্ধাদের একত্র করে জরুরি অধিবেশন ডাকেন। অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পর মুহূর্ত থেকে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তোলার কাজে ব্যাপৃত হন। স্বাধীনতার পর দেশ পুনর্গঠনে মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এই সংক্ষিপ্ত সময়েই তিনি অদম্য বাংলাদেশের ভীত গড়ে দিয়ে যান।
স্বদেশ নির্মাণে বঙ্গবন্ধুর সে বিশাল কর্মযজ্ঞ যেন এক অবাক উপাখ্যান। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে ওঠে আসে দুর্মর বাংলাদেশ বিনির্মাণে তার বুদ্ধিদীপ্ত-প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
সংবিধান প্রণয়ন: বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, স্বাধীন দেশের জন্য একটি সুন্দর সংবিধান প্রয়োজন। যার মাধ্যমে দেশে আইনের শাসনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও আনুগত্য পুনরায় প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর হবে। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ১ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু ‘শাসনতন্ত্র আদেশ-৭২’ জারি করেন। ২৩ মার্চ সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে জারি করেন গণপরিষদ আদেশ। নির্বাচনের পর ১৬ তারিখে মাত্র ১১ মাসের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন করতে সক্ষম হন। এই শাসনতন্ত্রের মূল স্তম্ভ ছিল জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
জাতীয়করণ কর্মসূচি: ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ইশতেহারে বঙ্গবন্ধু সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এছাড়া ১৯৬৯ সালে ছাত্রদের ১১ দফা দাবির ৫নং দাবিতে পাট, বস্ত্র, চিনিকল ও ব্যাংক বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মতি জ্ঞাপন করেন। সেই প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রদত্ত ভাষণে জাতীয়করণ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তাছাড়া, জাতীয়করণ নীতি সফল করতে সরকার ব্যাংক, জীবন ও সাধারণ বীমা, পাট-বস্ত্র-চিনি শিল্পসহ পরিত্যক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো, বাংলাদেশ বিমান ও জাহাজ কর্পোরেশন প্রভৃতিকে চিহ্নিত পূর্বক সরকারিকরণ করেন।
কৃষিক্ষেত্রে পদক্ষেপ: জন্মের সময় বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ ছিল। দেশের শতকরা ৮৫ জনই কোনো না কোনোভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত ছিল। দেশের রাজস্ব আয়ের বড় অংশ আসত কৃষি থেকে। কৃষক সমাজের দুর্দশা দূর করে চাষিদের স্বল্পমেয়াদি সাহায্য দানের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা তিনি মওকুফ করেন।
সারা বছর ধরে সেচের কাজ চালানো, উন্নতমানের বীজ বপন, সার, কীটনাশক, ওষুধ এবং প্রতিটি চাষিকে পর্যাপ্ত ঋণদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকার। কৃষকদের মধ্যে ১ লাখ ৫০ হাজার গাভী ও ৩০ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়। তামাদি ঋণ বাবদ ১০ কোটি টাকা রিলিফ হিসেবে বিতরণ করা হয়। লবণের ওপর থেকে কর তুলে নেওয়া হয়। সরকারিভাবে খাদ্য মজুতের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে ১০০টি খাদ্যগুদাম তৈরি করা হয়।
কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণের জন্য জাতীয় পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়। ভূমিহীন ও স্বল্প জমির অধিকারী চাষিদের মাঝে ঋণ দানের ব্যবস্থা করা হয়। ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পকে বেকার সমস্যা সমাধানের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়।
অর্থনৈতিক সংস্কার: ১৯৪৭ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির অন্যতম লক্ষ্য ছিল পূর্ব বাংলাকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করা। এ কারণে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনে আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন তিনি। ৬৬ সালে ৬ দফা কর্মসূচিতে বঙ্গবন্ধু এই বৈষম্যের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা তুলে ধরেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু প্রথমে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিবর্তন ও সমাজ ব্যবস্থাতেও কৃষি অনাদিকাল ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কৃষির উন্নতির জন্য বঙ্গবন্ধু গ্রাম-প্রকল্প প্রণয়ন করেছিলেন।
গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নতির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং বগুড়ায় পল্লী উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধু অর্থনীতির ক্ষেত্রে গতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে শিল্প ঋণ সংস্থা ও বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় তিনি কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। কৃষি ব্যাংকের ৩৩৫টি শাখা স্থাপন করেন। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের ১০৫০টি শাখা দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করেন। সে সময় ঘোড়াশাল সার কারখানা, আশুগঞ্জ কারখানার কাজ, নতুন শিল্প ও কারখানা চালু এবং পুরোনো শিল্প-কারখানা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়।
যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পদক্ষেপ: মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশে সড়ক, রেল ও নৌ যোগাযোগ প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ধ্বংসপ্রাপ্ত সব সড়ক সেতু পুনঃনির্মাণ করা হয়। ৯৭টি সড়ক সেতু নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে যমুনা নদীর (টাঙ্গাইল-সিরাজগঞ্জ) ওপর যে বঙ্গবন্ধু সেতু রয়েছে, তা ১৯৭৪ সালের ৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু সরকার সেতুর সপ্তাব্যতা রিপোর্ট প্রণয়ন করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত রেলওয়ের বিভিন্ন ব্রিজসহ ভৈরব সেতু এই সরকার মেরামত করে চলার উপযোগী করে। তাছাড়া নির্মাণাধীন রেলসেতুগুলো ১৯৭৩ সালের মধ্যে কাজ সম্পন্ন হয়। বঙ্গবন্ধুর সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম সরাসরি রেল যোগাযোগ চালু হয়।
বঙ্গবন্ধুর আমলে শিপিং কর্পোরেশন চালু হয়। খাদ্য ও মালামাল পরিবহনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ নৌকা ও কার্গো তৈরি করা হয়। ১৯৭৪ সালের মধ্যে ১৪টি সমুদ্রগামী জাহাজ সংগ্রহ করা হয়। তাছাড়া নদীতে সারা বছর নাব্য ধরে রাখার জন্য নদী খনন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর সময় ১৯৭২ সালেই দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান যোগাযোগ চালু হয়। এ সময় তেজগাঁও ও যশোর বিমানবন্দর চালু হয়। ১৯৭৩ সালের ১৮ জুন ঢাকা-লন্ডন আন্তর্জাতিক রুটে বিশ্বমানের প্রথম ফ্লাইট চালু হয়। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক (বর্তমানে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর) বিমানবন্দরের কাজ শুরু হয়।
যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের বিদ্যুতের ভগ্নদশা ছিল। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ লাইন বিনষ্ট হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণের ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করে।
শিক্ষাক্ষেত্রে পদক্ষেপ: ১৯৭২ সালের ১৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সরকার এক ঘোষণায় যুদ্ধকালীন ৯ মাসের (মার্চ-ডিসেম্বর) সব শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের বেতন মওকুফ করে। একই সঙ্গে শিক্ষকদের ৯ মাসের বেতন পরিশোধ করা হয়। ২০ জানুয়ারি (১৯৭২) শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠনের লক্ষ্যে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দেন। এ সময় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতের চেয়ে শিক্ষা খাতে ৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়। সে সময় মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য ১.২৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে ১৭নং অনুচ্ছেদে সর্বজনীন শিক্ষার কথা বলা হয়।
১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই বঙ্গবন্ধু ড. মুহাম্মদ কুদরত-এ-খুদাকে সভাপতি করে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। এই শিক্ষা কমিশনের ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে আমুল পরিবর্তন সাধিত হয়। এই কমিশনের অর্ডিন্যান্সের ফলে ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। ফলে স্বাধীন চিন্তা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার পথ সুগম হয়।
বঙ্গবন্ধু ৩৬,১৬৫টি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ১,৫৭,৭৪২ জন শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ করেন। এ সময় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ মিলিয়ে ১ হাজার ৩০০ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। সে সময় নতুন শিক্ষা বোর্ড গঠন করা হয়। একই সঙ্গে ৯০০ কলেজ ভবন ও ৪০০ হাই স্কুল পুনঃনির্মাণ করা হয়। বঙ্গবন্ধু সরকার জাতিসংঘের সহায়তায় ৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকার পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করে। বঙ্গবন্ধু প্রচলন করেন সদ্য স্বাধীন দেশে গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থার।
খাদ্য ঘাটতি পূরণে পদক্ষেপ: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কৃষি ও শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। ফলে এ সময় দেশে খাদ্যদ্রব্যে অপ্রতুলতা দেখা দেওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল না। সে সময় বঙ্গবন্ধু সরকার খাদ্য সমস্যা দূরীকরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এ সময় আমদানি করা হয় ২৭ লাখ টন খাদ্যশস্য। ওই সময় প্রায় ২৩ লাখ ১০ হাজার ৭২১ টন খাদ্য বণ্টন করা হয়। রেশনে প্রায় ৯৫ জনকে খাদ্য সরবরাহ করা হয়। ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৩ লাখ টন খাদ্য সরবরাহ করা হয়। এতসব উদ্যোগ সত্ত্বেও দেশি-বিদেশি চক্রান্ত, মজুতদার, মুনাফাখোর, অসাধু চোরাচালানি গোষ্ঠীর কারসাজি এবং পাকিস্তানপন্থী আমলা ও অন্যান্য গোষ্ঠীর অসহযোগিতার কারণে বঙ্গবন্ধু গৃহীত পরিকল্পনা নানাভাবে বিঘ্নিত হয়েছে।
ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম: মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদারদের অত্যাচারে লাখ লাখ নর-নারী বাস্তুহারা হয়। প্রায় ৫০ লাখ বাড়ি-ঘর আগুনে ভস্মীভূত করা হয়। তখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকদের বাড়ি-ঘরও ভাংচুর ও ভস্মীভূত করা হয়। প্রায় ১ কোটি মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ত্রাণ ও পুনর্বাসন সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা।
বঙ্গবন্ধু সরকার বাস্তুহারাদের পুনর্বাসনের জন্য ১৯ কোটি ০৮ লাখ ৭২ হাজার টাকা, ১ কোটি ৪১ লাখ ৮১ হাজার ৮৮৫ মণ খাদ্যশস্য ও পুনর্বাসন কাজের জন্য ২৫ লাখ ৫৪ হাজার ৭৮৯ টাকা ব্যয় করা হয়। এছাড়া প্রাথমিক পুনর্বাসন কাজেও ২৫ কোটি ৬৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়। সে সময় ক্ষতিগ্রস্তদের ৯ লাখ বাসগৃহ নির্মাণ করা হয়েছে এবং সমস্ত ভস্মীভূত ঘরবাড়ি পুনঃনির্মাণ করা হয়।
এ সময় বাংলাদেশ অনুদান এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য প্রায় ১০০ কোটি ডলার (বর্তমান হিসাবে প্রায় ৩০০০ কোটি টাকা) মূল্যের সাহায্য লাভ করে। বিভিন্ন কমিটি গঠন করে সেগুলোর মাধ্যমে সারাদেশে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়।
নারীদের কল্যাণে গৃহীত ব্যবস্থা: বঙ্গবন্ধুর সরকার ছিল নারীদের সমঅধিকারে বিশ্বাসী। নারী শিক্ষা ও তাদের অধিকারের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি বঙ্গবন্ধু হাতে নেন। ১৯৭২ সালে তিনি নারী পুনর্বাসন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন। চাকরির ক্ষেত্রে নারীদের জন্য ১০ ভাগ কোটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। নারীদের রাষ্ট্রের মূলধারার কাজে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে বদরুন্নেসা আহমেদ ও নূরজাহান মুরশিদকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেন। ড. নীলিমা ইব্রাহিমকে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন।
জনস্বাস্থ্যে পদক্ষেপ: স্বাস্থ্য সম্পর্কে দেশের অধিকাংশ অসচেতন পরিবারের স্বাস্থ্যসেবায় বঙ্গবন্ধু সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। দেশ স্বাধীনের পর ৭ হাজার ৪৮২ জন ডাক্তার, ৮২১ জন নার্স ও ১ হাজার ৯২ জন ধাত্রী নিয়োগ করা হয়। পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলায় যেখানে হাসপাতালে ৮ হাজার ৫৪৯টি শয্যা ছিল, সেখানে স্বাধীন হওয়ার পর ১২ হাজার ৬০৬টি শয্যায় উন্নীত করা হয়। এ সময় ৪ কোটি ৩২ লাখ ৩৭ হাজার ২০ জনকে কলেরা-বসন্তের প্রতিষেধক টিকা দেওয়া হয়। সরকার সে সময় স্বাস্থ্য উন্নয়ন খাতে ১১ কোটি ৯৫ লাখ ৬৭ হাজার টাকা ব্যয় করে।
মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন: মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে যারা দেশকে স্বাধীন করেছেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। শহীদ ও আহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে রাষ্ট্র কর্তৃক সাহায্যের ব্যবস্থা করা হয়।
সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে গৃহীত পদক্ষেপ: সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো বঙ্গবন্ধু সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং সামাজিক ও ক্রীড়া ক্ষেত্রেও বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। স্বাধীন দেশের যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে নৈতিকতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ১৫ জানুয়ারি সরকারি আদেশের মাধ্যমে মদ, জুয়া, হাউজি ও ঘোড়দৌড় নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ৯টি রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক চুক্তি সম্পাদন করে। ঢাকার রামপুরায় অবস্থিত বাংলাদেশ টেলিভিশনের বর্তমান ভবনটি বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে কাজ শুরু হয়। সে সময় বঙ্গবন্ধু ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ভারতে অবস্থান করছিলেন। বঙ্গবন্ধু সরকার কাজী নজরুল ইসলামকে দেশে এনে জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করেন। বঙ্গবন্ধু সরকার সংস্কৃতি কর্মীদের জন্য বিভিন্ন আইন চালু করেন। সংস্কৃতিকর্মীদের কাজের পরিধির কথা চিন্তা করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ক্রীড়াসেবী কল্যাণ ফাউন্ডেশন গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের প্রচার, প্রসার ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু সব মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের পুনর্গঠন করেন। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জমায়েত বিশ্ব ইজতেমা বর্তমানে ঢাকার টঙ্গীতে তুরাগ নদীর দুই পাড়ে অনুষ্ঠিত হয়। তাবলিগ জামাত এবং এই বিশ্ব ইজতেমার জায়গা সংরক্ষণে বঙ্গবন্ধু যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেন। একই বছর ২০ মার্চ বঙ্গবন্ধু সরকার ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার জন্য অধ্যাদেশ জারি করেন। এছাড়া হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য তিনি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ সংরক্ষণ: ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে এবং হাজারো ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। যার নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু ও তার দল আওয়ামী লীগ। তাই সরকার গঠন করেই বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানানোর জন্য বিভিন্ন স্থানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন। ১৯৭২ সালের ৯ মার্চ সাভার ও মেহেরপুরের মুজিবনগরে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করেন। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। একই বছরের ২২ ডিসেম্বর ঢাকার মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
ক্ষণজন্মা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে পৃথিবীর মানচিত্রে সৃষ্টি হতো না বাংলাদেশের। যুগ যুগ ধরে বঙ্গবন্ধুর মনের লালিত স্বপ্নের কারণেই এই বাংলাদেশের সৃষ্টি। বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র সাধনার ফল বাংলাদেশ।
লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়