logo
আপডেট : ১৭ মার্চ, ২০২২ ১০:১৬
বঙ্গবন্ধু: মহান মানুষ, মহান নেতা
ড. মিল্টন বিশ্বাস

বঙ্গবন্ধু: মহান মানুষ, মহান নেতা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফাইল ছবি

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা সম্পর্কে ভাবনার চুম্বক অংশসমূহ বিবেচনায় নিলে ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনে রাজনীতিবিদদের পথ অন্বেষণে সুবিধা হবে। ২৬ মার্চ ১৯৭৫ সাল। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক-আওয়ামী লীগ কর্তৃক আয়োজিত জনসভায় জাতির পিতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ দুনিয়ায় এসেছে, বাংলাদেশ থাকবে, কেউ একে ধ্বংস করতে পারবে না।’ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে এদেশের জনগণ বঙ্গবন্ধুর এই কথার সত্যতা খুঁজে পেয়েছে।

১৯৭৫ সালের ১৯ জুন বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক-আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে দলীয় চেয়ারম্যান হিসেবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সবাইকে এক হয়ে দেশের জন্য কাজ করতে হবে। এই ঐক্যচেতনা এসেছে গভীর উপলব্ধি থেকে। তার মতে, রক্তের বিনিময়ে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু সাড়ে সাত কোটি মানুষ ও ৫৪ হাজার স্কয়ার মাইল ভূখণ্ড ছাড়া আমাদের আর কোনো সম্পদ নেই। তার মতে, ‘আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। আমাদের স্বজন হারানোর অর্থ হলো, আমাদের অর্থনীতির মালিক আমরা এবং আমাদের দেশ সেই সম্পদ ভোগ করব।’ অথচ তার শাসনামলে বিদেশি চক্র এদেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। তারা এদেশের স্বাধীনতা বানচাল করার জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করে। আর লক্ষ সিদ্ধির জন্য বাংলাদেশে চোরাপথে অর্থ আসতে আরম্ভ করে। দেশের মধ্যে শুরু হয় ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ।

স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমরা দুনিয়ার নির্যাতিত পিপলের সঙ্গে আছি, আমরা কারো সঙ্গে শত্রুতা করতে চাই না। আমরা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাই। আমরা আন্ডারডেভেলপড কান্ট্রি, আমরা বিশ্বে শান্তি চাই। আমরা কারো ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে চাই না। আমাদের ব্যাপারেও কেউ হস্তক্ষেপ করুক এটাও আমরা চাই না।’

বঙ্গবন্ধুর আমল থেকেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য। জোটনিরপেক্ষ গোষ্ঠী, কমনওয়েলথ ও ইসলামী সামিটের সদস্য। ইউএনওর চার্টারে বিশ্বাস করা হয় তখন থেকেই। তার আমল থেকেই সবাই এদেশের বন্ধু। তার কাছে স্বাধীনতার মূল মন্ত্র ছিলÑ মানুষের মঙ্গল করা, দেশকে গড়ে তোলা। এজন্য সাব-কন্টিনেন্টে একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করে এদেশে ডেভেলপমেন্টের কাজ করতে চেয়েছিলেন তিনি।

স্বাধীনতা বলতে তিনি বুঝেছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে। বাংলাদেশে শোষণহীন সমাজ গড়তে হবে। এমনকি রাষ্ট্রের সার্বভৌম রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সেনাবাহিনীকে বসিয়ে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন না। তার মতে, ‘আই ওয়ান্ট মাই আর্মি পিপলস্ আর্মি। আই ডু নট ওয়ান্ট মাই আর্মি টু ফাইট অ্যাগেইনস্ট এনিবডি। বাট আই ওয়ান্ট মাই আর্মি টু ডিফেন্ড মাইসেলফ অ্যান্ড অ্যাট দি সেম টাইম টু ওয়ার্ক।’ স্বাধীন দেশে তিনি করাপশনের অবসান চেয়েছিলেন। তিনি জানতেন, পাবলিক ওপিনিয়ন মবিলাইজ না করলে শুধু আইন দিয়ে করাপশন বন্ধ করা যাবে না এবং সেই সঙ্গে সিস্টেমই পরিবর্তন করতে হবে। ঘুণে ধরা সিস্টেম দিয়ে করাপশন বন্ধ করা যায় না। গত ৫০ বছরে এদেশের মানুষের সেই সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। এজন্য করাপশনও মুক্ত হয়নি এদেশ থেকে।

স্বাধীন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হবে তা নিয়েও তিনি চিন্তা করে গেছেন। তিনি মনে করতেন, নতুন এডুকেশন সিস্টেম কেরানি পয়দা করার জন্য হবে না, বরং মানুষ পয়দা করবে। তবে এটা তিনি জানতেন, তিন বছর, সাড়ে তিন বছর একটা দেশের জীবনে কিছুই না। দেশের সার্বিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে সময় লাগবে।

পশ্চিমা দুনিয়া থেকে পাওয়া তত্ত্ব নয়, বরং যে শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন তা ছিল এদেশের মাটি-মানুষের সঙ্গে অনেক বেশি সম্পৃক্ত। আসলে বঙ্গবন্ধুর শোষণহীন সমাজব্যবস্থায় মানুষ সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করার স্বপ্ন দেখেছিল। আর তিনি চেয়েছিলেন, বাংলাদেশকে স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে সম্মানের সাথে দুনিয়াতে বাঁচিয়ে রাখা, বাংলার দুখী মানুষকে পেট ভরে খাবার দিয়ে শোষণমুক্ত সমাজ গঠন করা, যেখানে অত্যাচার-অবিচার জুলুম থাকবে না, দুর্নীতি থাকবে না।

ক্ষমতা বন্দুকের নলে- এ বিশ্বাস বঙ্গবন্ধুর ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন, ক্ষমতা বাংলার জনগণের কাছে। জনগণ যেদিন বলবে, ‘বঙ্গবন্ধু ছেড়ে দাও, বঙ্গবন্ধু তারপর এক দিনও রাষ্ট্রপতি, এক দিনও প্রধানমন্ত্রী থাকবে না। ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত থাকার সময় কিংবা তারপর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এসেও বঙ্গবন্ধু ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করেননি। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছেন দুখী মানুষকে ভালোবেসে, তিনি রাজনীতি করেছেন শোষণহীন সমাজ কায়েম করার জন্য। এ কারণে স্বাধীনতা তার কাছে এভাবেই ধরা দিয়েছেÑ ‘আমি চেয়েছিলাম স্বাধীনতা। কী স্বাধীনতা? আপনাদের মনে আছে, আমার কথার মধ্যে দুটি কথা ছিল। রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যায়, যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না আসে। যদি দুখী মানুষ পেট ভরে ভাত খেতে না পারে, কাপড় পরতে না পারে, বেকার সমস্যা দূর না হয়, তা হলে মানুষের জীবনে শান্তি ফিরে আসতে পারে না।’

অর্থাৎ, বঙ্গবন্ধুর কাছে স্বাধীনতার মানে ছিল শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। এই মহান মানুষ-মহান নেতার জন্মদিনে বলতে হয়, ‘বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগের জন্যই স্বাধীন বাংলাদেশের রক্তিম পতাকা আজ দুনিয়ায় ওড়ে’।

লেখক: অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়