মার্চ মাস বাঙালির স্বপ্নসাধ যৌক্তিক পরিণতির এক মাস। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বিষাদ, আবেগ-অনুভূতি বিজড়িত মাস এই মার্চ। এই মার্চে ৪টি দিবস খুবই গুরুত্ব বহন করে। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ- জাতীয় দিবস, ১৭ মার্চ- বঙ্গবন্ধুর জন্ম দিবস, ২৫ মার্চ- গণহত্যা দিবস এবং ২৬ মার্চ- মহান স্বাধীনতা দিবস। এ মাসের ২৬ তারিখে এ দেশের জন্ম; আবার এ মাসের ১৭ তারিখেই জন্মেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই, মার্চ বাঙালি জাতির জন্য অর্থবহ এক মাস। এ মাসেই জাদুকরি ভাষণে বাঙালি জাতিকে স্বপ্নে বিভোর করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। গর্জে উঠেছিল বাঙালি। স্বাধীনতার প্রেরণার উৎস ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ওই ভাষণ। ঐতিহাসিক এই ভাষণের পর প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ের গহীনে লালন করা তখনো অধরা ‘স্বাধীনতা’ যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
একজন বঙ্গবন্ধু; একটাই বাংলাদেশ। শত বছর আগে ১৭ মার্চে জন্ম নেয়া ত্যাজদ্বীপ্ত এই মানুষটি গর্জে উঠেন ৭ই মার্চ; সেই গর্জনেই অর্জন ১৬ ডিসেম্বর। পৃথিবীর বুকে নাম লেখাল স্বাধীন বাংলাদেশ। তার মেধা, প্রজ্ঞা, সততা, সাহস সর্বোপরি দেশপ্রেমেই বাংলাদেশের জন্ম হয়। বাংলাদেশের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম ঘটনা হচ্ছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের এই ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের সামাজিক-রাজনৈতিক স্বপ্নসাধ পূরণ হয়। ১৯৭১ সালে এসে যে রাজনৈতিক সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করে, তার গোড়াপত্তন হয়েছিল বহু বছর আগে। তারপর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের শিক্ষা আন্দোলন ও ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের মার্চে এসে বাঙালির সেই স্বপ্নসাধ যৌক্তিক পরিণতিকে স্পর্শ করে।
১ মার্চ রাতেই স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নামে একটি সংগঠন তৈরি হয়। সেই সংগ্রাম পরিষদ ৩ মার্চ পল্টনে একটি শোভাযাত্রার আয়োজন করেছিল। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই শোভাযাত্রায় শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। ইশতেহারে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সব কথা বলা ছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের চৌহদ্দি কী হবে, এই পতাকা বাঙালির পতাকা হবে, জয় বাংলা বাঙালির স্লোগান হবে, বঙ্গবন্ধু আমাদের মুক্তিসংগ্রামের সর্বাধিনায়ক। সবকিছু বলা হয়েছিল। সে সময় মুহুর্মুহু স্লোগান হয় যে- বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। ২ তারিখে পতাকা উত্তোলন, ৩ তারিখে ইশতেহার পাঠ, আর ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন বঙ্গবন্ধু। এভাবেই স্বাধীনতার পটভূমি তৈরি হয়।
আজ বঙ্গবন্ধু নেই। আছে তার স্মৃতি। ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশা আল্লাহ।’ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ আজও বাংলার প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে গাঁথা আছে। বঙ্গবন্ধুকে কি করে ভুলে বাঙালি। বাঙালি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে তাকে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালন করেছে বাংলাদেশ। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত সময়কে ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করা হয়।
শতবছর আগে ১৭ মার্চ প্রিয় এ মানুষটির জন্ম। তিনি ভালোবেসেছিলেন বাঙালি জাতিকে। বীর হতে চাননি যিনি; ভয় পাননি শহীদ হতে। রক্ত দিয়ে যিনি দেশবাসীর ভালোবাসার ঋণ পরিশোধ করতে প্রস্তুত ছিলেন সর্বদা- তাকে কী করে স্মরণ না করে পারে বাঙালি? বঙ্গবন্ধু ক্ষমতাকে ভালোবাসেননি, হৃদয় দিয়ে দেশকে ভালো বেসেছেন, দেশের মানুষকে ভালোবেসেছেন। অর্থ লোভ তাকে ছোঁয়নি কখনো। দেশকে ভালোবাসার জন্য তার কাছে অর্থ ছিল তুচ্ছ। এমন নেতা কি আর জন্মাবে কখনো এদেশে? যা দেখছি তাতে বোধ করি- কখনোই না। বঙ্গবন্ধু হয়ে আর আসবেন না কখনো কেউ। এক বঙ্গবন্ধু, এক বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।
বাংলাকে ভালোবাসার এমন মানুষ আর কখনোই আসবে না এদেশে। তার মতো করে কেউ বাংলাকে আর ভালোবাসবে না; বাঙালিকে তার মতো করে কেউ আর আগলে রাখবে না। আমরা সত্যি অকৃতজ্ঞ জাতি। যিনি আমাদের দেশমাতৃকাকে উপহার দিলেন, সেই তাকেই কত না নির্মমভাবে হত্যা করা হলো! জাতির জনকের বাসভবনে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়া হয়েছিল সেদিন। শিশু রাসেলের কান্না আর আকুতিও ওদের হৃদয় স্পর্শ করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, হত্যাকারীরা তার কবর তিন মাস পর্যন্ত পাহারা দিয়েছে। সেখানে কাউকে আসতে দেয়া হয়নি। এমনকি দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের ছবি এদেশে নিষিদ্ধ ছিল। বঙ্গবন্ধুর কবর দেখতে না দেয়া, তার হত্যার ছবি প্রকাশের নিষেধাজ্ঞার মূল কারণ ঘৃণ্য হন্তারক ওই সামরিক শাসকরা তাতে ভয় পেত। তাদের ভয়টা ছিল এখানেই যে, তারা নিশ্চিত জানত জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে মৃত বঙ্গবন্ধু অনেক বেশি শক্তিশালী। তারা আরো জানত, সে সময় এসব ছবি প্রকাশ পেলে কোনো কিছুতেই বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা যাবে না। তাই তো ইতিহাসের এই মহানায়কের উদ্দেশে কবি লিখেছিলেন, ‘যতদিন রবে পদ্মা, যমুনা/গৌরী, মেঘনা বহমান/ ততদিন রবে কীর্তি তোমার/ শেখ মুজিবুর রহমান’।
অবিসংবাদিত এই নেতার জীবন চলার পথ ছিল কণ্টকাকীর্ণ। পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলে ’৬০-এর দশক থেকেই তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের অগ্রনায়কে পরিণত হন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ লাখো মানুষের উপস্থিতিতে ঢাকার তৎকালীন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু বজ্রদৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তারই বজ্র নির্ঘোষ ঘোষণায় উদ্দীপ্ত-উজ্জীবিত জাতি স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ধারণ করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
অদম্য সাহস ও আত্মত্যাগ এবং সাংগঠনিক শক্তি দিয়ে বাঙালিসত্তার গভীর অনুরণন উপলব্ধি করেছিলেন তিনি। কখনো স্বভাবের প্রেরণায়, কখনো সযত্ন উৎসাহে তার উন্মোচন ঘটিয়েছিলেন। দেশবাসীকেও তেমনি অনুপ্রাণিত করেছিলেন সেই সত্তার জাগরণ ঘটাতে। দেশ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে এক মোহনীয় স্বপ্ন রচনা করেছিলেন তিনি ধীরে ধীরে, সেই স্বপ্ন সফল করার আহ্বান জানিয়েছিলেন সবার প্রতি। কী বিপুল সাড়া তিনি পেয়েছিলেন, তার পরিচয় তো আমরা সচক্ষে দেখেছি। ১৯৭১ সালে যেভাবে তিনি অসহযোগ আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন, তাতে বিস্মিত হয়েছিল সারা বিশ্ব। অপশক্তির সঙ্গে নৈতিক শক্তির দ্বন্দ্ব পৃথিবীতে এই প্রথম সংঘটিত হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের এই আন্দোলনের মধ্যদিয়ে যে ঐক্য, যে শৃঙ্খলা, যে দুর্জয় সংকল্পের পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল তার তুলনা হয় না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি নাম, একটি ইতিহাস। বাঙালির ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ সন্তান তিনি। তার জীবন ছিল সংগ্রামমুখর। সংগ্রামের মধ্যেই তিনি বড় হয়েছিলেন। তার জন্ম তৎকালীন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ায়। ছাত্র অবস্থায় তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-র যুক্তফ্রন্টের সরকার গঠন, কপ, পিডিপি’র আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে মহানায়ক হিসেবে ’৭০-র নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি আওয়ামী লীগকে এদেশের গণমানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীকে পরিণত করেন।
বঙ্গবন্ধুকে জীবনের একটা বড় অংশ বাঙালি জাতির জন্য ত্যাগ করতে হয়েছে। দেশের জন্য দিয়েছেন নিজের জীবনও। জেল-জুলুম ছিল তার জীবনের একটা অংশ। বন্দিদশা থেকে মুক্তিলাভ করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেই তিনি বলেছিলেন, ‘যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে, স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না’।
বাংলাদেশ ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নেরই অংশ। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের আগেই তাকে সপরিবারে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া হলো! বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ে স্বপ্ন দেখা মানুষগুলো। তিনি চলে গেলেন। আর ফিরে এলেন না। এমন একটা নেতা এদেশে আর জন্মায়নি একটিও। তার মতো করে বাংলাকে আর ভালোবাসেনি কেউ, দেশের মানুষকে আগলে রাখেনি কেউ। প্রকৃত অর্থে বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালির অকৃত্রিম বন্ধু।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক