সতেরোই মার্চ ১৯৭২। সকাল সাড়ে ১০টা। ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে নেমে আসে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি উড়োজাহাজ। নাম তার 'রাজহংস'। বিমানটির গায়ে ভারতের তেরঙ্গার পাশে শোভা পাচ্ছে নতুন জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকাটিও।
বিমানটির অবতরণ উপলক্ষে তখনকার ঢাকার এবং বাংলাদেশের এক মাত্র এই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটিতে দুপুর পর্যন্ত সব ধরনের বিমান ওঠানামা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই বিমানটিতে রয়েছেন এমন একজন মানুষ, যিনি বিগত বছরে বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন।
তার নেতৃত্বে ভারত এক কোটিরও বেশি শরণার্থীকে আশ্রয়-আহার-চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন দিয়ে গেরিলা যোদ্ধাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। স্বীকৃতির জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিক প্রচার চালিয়েছেন। এক পর্যায়ে নিজের দেশকে সরাসরি সেই যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলেছেন। তিনি ভারতের সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।
বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত হয়েছেন সস্ত্রীক বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। দিনটি আবার শেখ মুজিবের জন্মদিন। স্বাধীন বাংলাদেশে তার প্রথম জন্মদিন। ইন্দিরা গান্ধী তার প্রথম বাংলাদেশ সফরের জন্য দারুণ একটি দিন বেছে নিয়েছেন।
গান্ধীর আগমনে ছুটি
দিনটিকে যদিও সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু শেখ মুজিব স্পষ্ট করে দিয়েছেন, এই ছুটি ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ আগমন উপলক্ষে।
‘ভবিষ্যতে তাহার জন্মদিন আর সরকারি ছুটির দিন হিসেবে উদযাপিত হইবে না। এই দিনটি কঠোর শ্রম ও বৃহত্তর কল্যাণে আত্মনিয়োগের দিন হিসেবে পালিত হইবে’, শেখ মুজিবের একটি বক্তব্যের বরাত দিয়ে ১৯৭২ সালের ১৭ই মার্চ দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় ছাপা হওয়া খবর।
তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে নবগঠিত বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে চড়ে ইন্দিরা গান্ধী সরাসরি যান বঙ্গভবনে। রাষ্ট্রপতি আবু সাইদ চৌধুরীর সরকারি বাসভবন সেটি। সফরের পরবর্তী তিনটি দিন সেখানেই থাকবেন মিসেস গান্ধী।
সেসময় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির স্পেশাল অফিসার ছিলেন মাহবুব তালুকদার, যিনি বাংলাদেশের সদ্য বিদায়ী নির্বাচন কমিশনের একজন কমিশনার। স্মৃতিচারণ গ্রন্থ 'বঙ্গভবনে পাঁচ বছর'-এ তিনি লিখেছেন, মিসেস গান্ধীর সফর উপলক্ষে বঙ্গভবনকে নতুন সাজে সজ্জিত করা হয়।
‘অভ্যন্তরীণ সাজ-সজ্জার জন্য কলকাতা থেকে মিসেস বসন্ত চৌধুরীকে কমিশন করে আনা হয়েছিল। বসন্ত চৌধুরী স্বনামখ্যাত চিত্রনায়ক ও নাট্যাভিনেতা। তার স্ত্রী স্বনামখ্যাত ইন্টেরিয়র ডেকোরেটর। ভদ্রমহিলা দিন রাত পরিশ্রম করে বঙ্গভবনকে সাজিয়ে দিলেন’, লিখেছেন মি. তালুকদার।
নৌকার আদলে মঞ্চ
সতেরো তারিখেই বিকেল ৩টায় ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি জনসভায় যোগ দেন ইন্দিরা গান্ধী। জনসভা উপলক্ষে ‘ময়দানের এক পাশে নৌকার আকারে বিশাল মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। মঞ্চের নাম দেওয়া হয়েছে ইন্দিরা মঞ্চ’ - বঙ্গভবনে পাঁচ বছর গ্রন্থে লিখেছেন মাহবুব তালুকদার।
পরের দিন দৈনিক ইত্তেফাকের খবর- জনসভায় বাংলায় ভাষণ দিতে শুরু করেন ইন্দিরা গান্ধী। প্রথম দুই মিনিট তিনি বাংলাতেই বলেন। পরে বাংলায় দীর্ঘ বক্তৃতাদানে অক্ষমতার জন্য ক্ষমা চেয়ে হিন্দিতে বলতে শুরু করেন। কিন্তু এক পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের একটি বাংলা গান থেকে একটি লাইন উদ্ধৃত করেন তিনি- 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে'।
পরদিন বিকেলে বঙ্গভবনে একটি নাগরিক সংবর্ধনায় যোগ দেন মিসেস গান্ধী 'হাল্কা সবুজ রঙের সিল্কের শাড়ি' পরে। মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের একজন সদস্য ও বাংলার অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন সেই সংবর্ধনায়।
দুই হাজার পনের সালে প্রকাশিত জীবনীগ্রন্থ বিপুলা পৃথিবীতে ড. আনিসুজ্জামান লিখেছেন, সেদিন ‘ইন্দিরা গান্ধী বেশ সলজ্জভাবে কথা বলছিলেন ও চলাফেরা করছিলেন। আমার অনুরোধে আমন্ত্রিতদের পক্ষ থেকে কবীর চৌধুরী ভাষণ দিলেন - সংক্ষিপ্ত, মনোজ্ঞ ও উদ্দীপ্ত। ইন্দিরাও জবাবে সুন্দর বললেন’।
ওইদিন বঙ্গভবনে নৈশভোজে দেওয়া ভাষণে মিসেস গান্ধী বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিরাজমান বন্ধুত্বমূলক পরিবেশকে দূষিত করার জন্য ভিতরের ও বাহিরের বিরুদ্ধ মহল চেষ্টা করিবে’, প্রতিবেদনে লেখে দৈনিক ইত্তেফাক।
পত্রিকাটি আরো লেখে, ‘কিন্তু তিনি দৃঢ় আস্থা প্রকাশ করেন যে, উভয় দেশের মৈত্রী সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে অধিকতর শক্তিশালী ও সফল হইবে’।
মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি
ইন্দিরা গান্ধীর এই প্রথম ঢাকা সফরেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি ২৫ বছর মেয়াদী দীর্ঘ মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিটিতে শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধী সই করেন মিসেস গান্ধীর ঢাকা সফরের তৃতীয় দিনে।
যদিও মিসেস গান্ধীর ওই সফরকালীন বাংলাদেশের চিফ অব প্রোটোকল বা রাষ্ট্রাচার বিষয়ক প্রধান ফারুক চৌধুরীর (মৃত্যু: ১৭ই মে ২০১৭) ভাষ্য, মৈত্রী চুক্তিটি সই হয়েছিল ১৮ই মার্চ, মিসেস গান্ধীর ঢাকা সফরের দ্বিতীয় দিন। তিনি ২০১১ সালে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর সফরের দ্বিতীয় দিন শীতলক্ষ্যা নদীতে এক নৌবিহারে।
মি. চৌধুরী বলেছিলেন, ‘চুক্তিটি সই হয়েছিল স্থলে নয়, জলে’।
তবে দৈনিক ইত্তেফাকের ১৯৭২ সালের ১৯ শে মার্চ প্রকাশিত 'মুজিব-ইন্দিরা সফল আলোচনা' শীর্ষক খবর থেকে জানা যায়, ১৮ই মার্চ শীতলক্ষ্যার নৌবিহারটি হয়েছিল ঠিকই, তবে ৩০ মিনিটের সেই নৌবিহারে শুধুমাত্র দুই নেতার শীর্ষ বৈঠকটিই হয়েছিল।
চুক্তিটি আসলে সই হয়েছিল মিসেস গান্ধীর সফরের শেষ দিন ১৯ শে মার্চ।
দৈনিক ইত্তেফাক ২০ শে মার্চ তাদের প্রথম পাতার প্রধান শিরোনাম লেখে, ‘বন্ধুত্ব সহযোগিতা শান্তি’ এবং তাতে পত্রিকাটি উল্লেখ করে- মিসেস গান্ধীর সফর শেষে ঢাকা ত্যাগের আগে বঙ্গভবনে দুই নেতা বারো দফাবিশিষ্ট চুক্তিটিতে সই করেন।
চুক্তিটি ছিল অনেকটা ১৯৭১ সালের ভারত-সোভিয়েত চুক্তির আদলে। কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে দুটি চুক্তিই ছিল হুবহু এক, শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তিটির মেয়াদ ছিল ২০ বছর আর বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিটির মেয়াদ ২৫ বছর।
চুক্তিতে লেখা ছিল- দুই দেশ একে অন্যের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার বিষয়ে সম্মান প্রদর্শন করবে এবং কেউই একে অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। কোনো পক্ষ স্বাক্ষরকারী অপর পক্ষের বিরুদ্ধে পরিচালিত কোনো সামরিক জোটে অংশ নেবে না। পরস্পর পরস্পরের প্রতি কোনো আক্রমণ করবে না এবং অপর পক্ষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে এমন কোনো কাজে নিজের ভূমি ব্যবহার করতে দেবে না।
শান্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ক আরো ধারা ছিল চুক্তিতে। এছাড়া দুই দেশের মধ্যে শিক্ষা, খেলাধুলা, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি সহায়তার উল্লেখও ছিল চুক্তিতে।
২০১১ সালে ফারুক চৌধুরী বিবিসিকে বলেন, এই চুক্তির মধ্যে নতুন কোনো 'এলিমেন্ট' ছিল না। ‘ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে চুক্তিটি হয়েছিল ওইটারই একটা অনুলিপি ছিল এটা’।
পাকিস্তানের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন
মি. চৌধুরীর চোখে চুক্তিটি ছিল 'আমাদের অর্থনৈতিক সহযোগিতা, আমাদের নিরাপত্তা এবং আমাদের সার্বভৈামত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার একটি পদক্ষেপ'।
‘আমরা ভেবেছি আমাদের নিরাপত্তা বাড়বে এতে। তখন পর্যন্ত পাকিস্তানের উদ্দেশ্য কী তাতো আমরা জানি না। কী হবে না হবে? অতএব একটা দেশের সঙ্গে একটা সমতার ভিত্তিতে আমাদের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ রেখে আমরা আরো পাকাপোক্ত করলাম’।
অরুন্ধতী ঘোষ (মৃত্যু: ২৫শে জুলাই ২০১৬) সেসময় ছিলেন ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি। তার চোখে এই চুক্তিটি ছিল দুই রাষ্ট্রের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকী বিষয়। ২০১১ সালে অরুন্ধতী ঘোষ বিবিসিকে বলেন, ‘আমার যেটা মনে হয়, আমাদের যে নতুন বন্ধুত্বটা গড়ার দরকার ছিল সেটাকে একটা প্রুফ দেওয়া, যে আমাদের এই বন্ধুত্বটা থাকবে’।
অবশ্য এই চুক্তিটি ইন্দিরা গান্ধীর ঢাকা সফরের সময়ে হলেও চুক্তির ব্যাপারে ঐকমত্য তার আগের মাসে শেখ মুজিব তার প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে যখন ভারত গিয়েছিলেন তখনই হয়ে গিয়েছিল বলে কোনো কোনো ঐতিহাসিকের বিবরণে উঠে আসে।
স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রনেতা হিসেবে প্রথম সরকারি সফরে শেখ মুজিবুর রহমান দুদিনের সফরে কলকাতা গিয়েছিলেন ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে। তার সঙ্গে দেখা করতে দিল্লি থেকে কলকাতা উড়ে এসেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। এসময় কলকাতার রাজভবনে দুজনের যে সাক্ষাৎ হয়েছিল, সেখানেই মিসেস গান্ধীকে ফিরতি সফরের দাওয়াত দিয়েছিলেন শেখ মুজিব।
একই সফরে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্যদের প্রত্যাহারের ব্যাপারেও জোর দিয়েছিলেন শেখ মুজিব। ফারুক চৌধুরী তার জীবনীগ্রন্থ 'জীবনের বালুকাবেলায়'-তে লিখেছেন, ‘মাত্র দুই দিনের অবস্থানের মধ্যেও কলকাতায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়ে ছিলেন সক্রিয়’।
সফরের দ্বিতীয় দিনে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনার পর যুক্ত ইশতেহারে সরকারি ঘোষণা করা হয়, '২৫শে মার্চ ১৯৭২ সালের মধ্যে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার সমাপ্ত করা হবে'।
কিন্তু বাস্তবে এই সৈন্য প্রত্যাহার শেষ হয় তারও দু'সপ্তাহ আগে, ইন্দিরা গান্ধীর প্রথম বাংলাদেশ সফরে ঢাকা আসতে তখনও পাঁচ দিন বাকি।
'গোলামী চুক্তি'
ফারুক চৌধুরীর ভাষায়, চুক্তিটি নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে কোনো 'দ্বিমত' ছিল না। কিন্তু চুক্তিটি হয়ে যাওয়ার পর এক পর্যায়ে এর তুমুল সমালোচনা তৈরি হয়। কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও তাদের মুখপত্র বলে পরিচিত দৈনিক পত্রিকাগুলো এই চুক্তির বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে সমালোচনায় যোগ দেয়।
এগুলোর মধ্যে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর হক কথা, ফেরদৌস আহমদ কোরেশী সম্পাদিত দেশবাংলা, জাসদের মুখপত্র হিসেবে নতুন প্রকাশিত দৈনিক গণকণ্ঠের মতো পত্রিকাও ছিল।
সিনিয়র সাংবাদিক আবেদ খান তখন দৈনিক ইত্তেফাকের একজন সহ-সম্পাদক। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, তখন ‘সমালোচনার পয়েন্ট ছিল একটাই। এই চুক্তি হওয়া মানে বাংলাদেশটাকে শেখ মুজিব ভারতের হাতে লিজ দিয়ে দিয়েছেন’।
তখনকার বিরোধী ‘পার্টিগুলো ক্রমাগত কিন্তু মুজিববিরোধী এবং চুক্তিবিরোধী কথাবার্তা বলেছে এবং সেটাকে বলেছে গোলামী চুক্তি’।
চুক্তি নিয়ে হরতাল নেই
তবে রাজনৈতিক দলগুলোর এই অবস্থান ছিল স্রেফ 'বিরোধিতার কারণে', এমন মত লেখক ও রাজনীতি বিষয়ক গবেষক মহিউদ্দীন আহমদের। ইন্দিরা-মুজিব মৈত্রী চুক্তিটি ছিল ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির হুবহু প্রতিরূপ। কিন্তু এটা নিয়ে ভারতে কোনো বিরোধিতা হয়নি উল্লেখ করে মি. আহমদ বলেন, ‘আমাদের এখানে হয়েছে, কারণ আমাদের এখানে সরকার যেটাই করবে কিছু লোক তার বিরোধিতা করবে, সবসময়ই’।
কিন্তু এ নিয়ে তখন কোনো রাজনৈতিক দল হরতাল ডেকেছে বলেও মনে করতে পারেন না সেসময়ের গণকণ্ঠ পত্রিকার সাংবাদিক মি. আহমদ। যদিও সেসময় রাজনৈতিক দলগুলো মি. আহমদের ভাষায় ‘কথায় কথায় হরতাল ডাকতো’।
কিন্তু ‘যারা বিরোধিতা করেছে, এটা বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতা করেছে, তারা যখন ক্ষমতায় গেছে তারা এই চুক্তি বাতিল করে নাই’।
তবে চুক্তিটি কতটা কার্যকর হয়েছে, আদৌ কার্যকর হয়েছিল কিনা এর কোনো কিছু সেটা নিয়েও আছে বিরাট প্রশ্ন। ড. আনিসুজ্জামান তার জীবনীগ্রন্থ বিপুলা পৃথিবী-তে লিখেছেন, ‘যত সমালোচনা হয়েছিল, চুক্তি তার সামান্য ভাগও কার্যকর হয়নি’।
আর এই কার্যকর না হওয়ার পেছনে ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনও একটা বড় ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে করেন মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি অরুন্ধতী ঘোষ।
‘শেখ সাহেব মারা যাওয়ার পরে কিছুদিন অনেকগুলো মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং (ভুল বোঝাবুঝি) এসেছিল’, ২০১১ সালে বিবিসিকে বলেছিলেন মিজ ঘোষ।
তিনি বলেন, চুক্তির উদ্দেশ্যটা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি বলে আমি মনে করি। ‘আমি যতদিন ছিলাম বন্ধুত্বটা গড়ছিল। কিন্তু অনেকগুলো মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিংও (ভুল বোঝাবুঝি) শুরু হয়েছিল আমাদের সাইড (পক্ষ) থেকে।’
চুক্তির স্বাভাবিক মৃত্যু
উনিশশো সাতানব্বই সালের ১৯শে মার্চ যখন চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে তখনও বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। উনিশশো পঁচাত্তর সালের রক্তাক্ত পট পরিবর্তনের দীর্ঘ সময় পর প্রথমবারের মত দলটি ক্ষমতায় ফিরেছে। কিন্তু তারপরও ভারত কিংবা বাংলাদেশ কেউই এই চুক্তি আর নবায়ন করেনি।
ফারুক চৌধুরীর চোখে এটি ছিল একটি 'হার্মলেস' (নির্বিষ) কিন্তু 'প্রয়োজনীয়' চুক্তি। কিন্তু ‘১৯৯৭ সালের যে পৃথিবী সেটা ১৯৭২ সাল থেকে কমপ্লিটলি (সম্পূর্ণরূপে) ভিন্ন ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন আর নেই। রাশিয়া হয়ে গেছে। টাইম মেড ইট ইররেলেভেন্ট (সময় এটাকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়েছে)। এই চুক্তির মৃত্যুতো দেখেছি। একটা হচ্ছে এটার তো কোনো প্রয়োজন নেই। লেট ইট ডাই এ ন্যাচারাল ডেথ (এটাকে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করতে দেয়া হোক)’, ২০১১ সালে বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন মি. চৌধুরী।
‘যারা আশঙ্কা করেছিলেন যে চুক্তি নবায়ন হবে, তাদের আশঙ্কা ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। আমি মনে করি সেটা সময়ের প্রয়োজনে হয়েছিল। সেটা সে সময়ে আমাদের সাহস যুগিয়েছিল। শক্তি দিয়েছিল । আমাদের সার্বভৌমত্বকে সুদৃঢ় করেছিল। এটার মনস্তাত্ত্বিক একটা সিগনিফিকেন্স (গুরুত্ব) ছিল’, বলেছিলেন মি. চৌধুরী।
দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত
মৈত্রী চুক্তি যেদিন সই হয়, সেদিন সকালেই বঙ্গভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন ইন্দিরা গান্ধী। সেখানে তিনি বলেন- ‘ভবিষ্যতে যে কোনো পরীক্ষার দিনে পাশে থাকিব’ - লিখেছে দৈনিক ইত্তেফাক।
এর কিছুক্ষণ পর মিসেস গান্ধী ও তার সহচরদের নিয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দর ত্যাগ করে ভারতীয় বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজ রাজহংস। মন্ত্রীসভার সদস্য ও অন্যদের নিয়ে বিমানবন্দরে মিসেস গান্ধীকে বিদায় জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান।
এসময় 'ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ এদেশীয় ফুলের একটি তোড়া শ্রীমতি গান্ধীকে উপহার দেন' শেখ মুজিব, পরদিন ২০শে মার্চ প্রথম পাতায় 'আবার আসিবেন' শীর্ষক সংবাদে এই খবর দেয় দৈনিক ইত্তেফাক।
এর পরের ১২ বছরের মধ্যে তিন বছর বাদ দিয়ে ১৯৮৪ সালে নিজ দেহরক্ষীদের গুলিতে নিহত হওয়ার দিন পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। কিন্তু এই এক যুগের মধ্যে কখনোই আর বাংলাদেশ সফরে আসা হয়নি তার।
বিবিসি বাংলা