ভাঙল মিলনমেলা। এর মধ্যে দিয়ে এক বছরের জন্য বিদায় নিল অমর একুশে বইমেলা তথা লেখক-প্রকাশক-পাঠকের মিলনমেলা।
বৃহস্পতিবার (১৭ মার্চ) সকালে শেষবারের মতো মেলার দোর খুলতেই বইপ্রেমীরা বইমেলায় আসতে শুরু করে। শেষ দিনে যারা এসেছিলেন তাদের প্রায় সবাই ছিলেন ক্রেতা। এবারের মেলায় মোট বিক্রি হয়েছে ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই।
মেলা ঘুরে দেখা যায়, পছন্দমতো বই কিনে নিচ্ছেন পাঠকরা। বেলা গাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে বিক্রি। এ দিন বেশি দামি বইগুলোতে অনেক স্টল থেকে ২৫ শতাংশের পরিবর্ত ৩০ শতাংশ ছাড় দেয়।
শেষদিনেও বরাবরের মতো অনন্যা, কাকলী, তাম্রলিপি, প্রথমা, পাঞ্জেরি প্রকাশনীর প্যাভিলিয়নগুলো ছিল ক্রেতাদের প্রধান আকর্ষণ। গতকালও অনেক শিশুও আসে মেলা প্রাঙ্গণে, বিশেষ করে শিশু চত্বরে তাদের ভিড় দেখা যায়।
শিশু দিবসে মেলার শিশু চত্বরে শেষ বিকেলে আনন্দে মেতেছিল শিশুরা। ইকরি, হালুম, টুকটুকি আর শিকুদের ছড়ানো আনন্দের জোয়ার বইছিল শিশুদের সঙ্গে আসা অবিভাবকদের মাঝেও। ভিড়ের মধ্যে ইকরি, টুকটুকিদের দেখাতে বাচ্চাকে কাঁধে তুলে নিয়ে নাচতে দেখা গেছে অনেক অভিভাবকদেরও ছন্দে ছন্দে ছড়া গানে সিসিমপুরের এসব চরিত্রের পরিবেশনায় তুলে ধরা হচ্ছিল বাচ্চাদের জন্য নানা বুনিয়াদি শিক্ষণীয় বিষয়।
সবাই মেলার শেষ দিনটিতে বই কেনার পাশাপাশি ঘুরে সময় কাটিয়েছেন বইমেলায়। অনেকের কণ্ঠে ছিল মেলা শেষের আক্ষেপ। সেইসঙ্গে আলোচনায় ছিল-কেমন হলো এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলা, সে বিষয়টিও। এবারের মেলা আয়োজন নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন এর আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি। প্রকাশকরাও বলেছেন প্রায় একই কথা। তাদের সবার মতেই করোনার মধ্যে এমন পূর্ণাঙ্গ একটা মেলা সত্যিই অনেক বড় বিষয় এবং অবশ্যই তা সফল।
এ বিষয়ে বাংলা একাডেমির পরিচালক ও বইমেলা আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ বলেন, এবারের মেলার আয়োজন নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট। কোনো ধরনের অঘটন ছাড়াই মেলা শেষ হতে যাচ্ছে। এটাই আমাদের মূল সন্তুষ্টির জায়গা।
এবারের মেলা নিয়ে প্রকাশকরা বলেন, একটা বড় আয়োজন করতে গেলে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকবেই। মেলায় কোনো বড় ধরনের অঘটন ঘটেনি, এটাই সুখের বিষয়। প্রথম দিন থেকেই মেলায় বেচাবিক্রি ভালো ছিল, যত দিন গড়িয়েছে বিক্রি ততই ভালো হয়েছে। সব মিলিয়ে এবারের আয়োজন নিয়ে প্রকাশকরা সন্তুষ্ট।
এদিকে অমর একুশে বইমেলায় গুণিজন স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করা হয়। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা এসব পুরস্কার ঘোষণা করেন। ২০২১ সালে প্রকাশিত বিষয় ও গুণমানসম্মত সর্বাধিক সংখ্যক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য আগামী প্রকাশনীকে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার-২০২২ প্রদান করা হয়েছে।
২০২১ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে শৈল্পিক ও গুণমান বিচারে সেরা গ্রন্থ বিভাগে আবুল হাসনাত সম্পাদিত বঙ্গবন্ধু জন্মশতবর্ষ স্মারক প্রকাশের জন্য বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, জালাল ফিরোজ রচিত লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর একদিন গ্রন্থের জন্য জার্নিম্যান বুক্স এবং সৈয়দ আবুল মকসুদ রচিত নবাব সলিমুল্লাহ ও তার সময় গ্রন্থের জন্য প্রথমা প্রকাশনকে মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২২ প্রদান করা হয়।
২০২১ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণমান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য কথাপ্রকাশকে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার-২০২২ প্রদান করা হয়।
২০২২ সালের অমর একুশে বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য থেকে নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নবান্ন প্রকাশনী, নিমফিয়া পাবলিকেশন এবং পাঠক সমাবেশকে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২২ প্রদান করা হয়।
বাংলা একাডেমি তথ্যে জানা গেছে, এবারের বইমেলার মোট বিক্রি হয়েছে ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলা একাডেমির বই বিক্রি হয়েছে ১ কোটি ২৭ লাখ টাকার। ২০২১ সালে মোট বই বিক্রি হয়েছিল ৩ কোটি টাকার। সেদিক থেকে টাকার হিসাবে বিক্রি বেড়েছে সাড়ে ১৭ গুণ।
বইমেলায় নতুন বই এসেছে ৩৪১৬টি। নতুন বইয়ের মধ্যে বাংলা একাডেমি কর্তৃক স্বীকৃত মানসম্মত বই ৯০৯টি, যা পুরো বইয়ের ২৬ ভাগ। ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল গত ৭ বছরে বইমেলায় মোট ৩৭৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৪ সালে বিক্রি হয়েছে সাড়ে ১৬ কোটি টাকার বই, ২০১৫ সালে ২১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, ২০১৬ সালে ৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০১৭ সালে ৬৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ২০১৮ সালে ৭০ কোটি টাকা, ২০১৯ সালে ৮০ কোটি টাকা, ২০২০ সালে ৮২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়।