সেঞ্চুরিয়নে বাংলাদেশের সফর শুরু ইতিহাস পাল্টে দেওয়ার মিশন দিয়ে। আফ্রিকার মাটিতে তিন সিরিজে ৮ ম্যাচ খেলে জয় শূন্য টাইগাররা এবার গিয়েছে নতুন ইতিহাস লিখতে, চতুর্থ সিরিজের প্রথম ম্যাচেই সে জয় এলো কী অসাধারণ পারফরম্যান্স দিয়ে। আজ প্রথম ওয়ানডেতে ৩৮ রানের জয়টা শুধু জয়ই নয়, আরও অনেক কিছু। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে এটি প্রথম ওয়ানডে জয় এবং সিরিজে বাংলাদেশ এগিয়ে গেল ১-০তে।
এই জয় পাওয়ায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শুরুতে টসে হেরে ব্যাটিংয়ের শুরু বাংলাদেশের। সবার ভাবনায় অতীত উঁকি দিচ্ছিল। কিন্তু, দারুণ ধৈর্যশীল আজ অধিনায়ক তামিম ও তার সঙ্গী অধিনায়ক লিটন দাস। উদ্বোধনী জুটিতে রেকর্ড গড়ে তারা যখন বিদায় নেন তামিম তখন ৪১, লিটন পূর্ণ করে ফেলেছেন তার অর্ধ শতক। খেলার সত্যিকারের শুরু যেন এরপরেই সাকিবের হাতে।
প্রথম ইনিংসে ৩১৪ রান করা যেন কোন দল থাকবে আত্মবিশ্বাসে টগবগে, বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম ছিল না। দুর্দান্ত পরিকল্পনা আর মাঠে তার বাস্তবায়ন চেষ্টায় মরিয়া টাইগাররা এর ফলও পায়। ব্যাটিং সহায়ক স্পোর্টিং উইকেটে ব্যাটারদের আউট করার জন্য মুন্শিয়ানা ছিল প্রতিটি বোলারের মধ্যে। সাকিব ইনিংস উদ্বোধন করেন। তবে উইকেট শূন্য ছিলেন আজ।
আজ অসাধারণ ছিলেন তাসকিন। শুরুতে এলবিডব্লিউ, এরপর কট আউট-৯ ওভারে দুটো উইকেট ভালোই মানাচ্ছিল তার পাশে। তবে সন্তুষ্ট ছিলেন না, শেষ ওভারে এসেই প্রথম বলেই নিয়েছেন ব্যক্তিগত ঝুলিতে তৃতীয় ও দলীয় পঞ্চম উইকেট। এরপর ৭ নম্বরে নামা আফ্রিকান ব্যাটার পেহলিখুওয়ায়ো তাকে ঠিকমতো খেলতে না পারায় বল গিয়ে তার ব্যাট ছুঁয়ে হেলমেটে লাগে।
৪০ ওভার শেষে দক্ষিণ আফ্রিকার সংগ্রহ ১৯৯, রানরেট উঠে যায় ১০ এর ওপরে। তবে তারপরও দলটির নাম দক্ষিণ আফ্রিকা আর হাতে রয়েছে তখনও ৫ উইকেট। ফলে খেলা কোন দিকে যায় তা দেখতেই শবেবরাতের রাতেই টিভির সামনে ভিড় কম ছিল না। ঘুরে ঘুরে টিভি কিংবা মোবাইলে সবাই রাখছিলেন খেলার খবর।
ব্যাটিংবান্ধব উইকেটে শেষ ১০ ওভারে ১১৫ ওঠানো অসম্ভব নয়, তবে বেশ কঠিন। এক প্রান্তে মিলার থাকায় তখন ভরসা ছিল আফ্রিকার। তবে ৪১তম ওভারে অসাধারণ বল করেন মোস্তাফিজুর রহমান। এ ওভারে মিলারকে বিটও করেছিলেন, কিন্তু বল ছিল লফটেড, সোজা জমা হয় মুশফিকের গ্লাভসে। উইকেট না পেলেও কিপটের মতো রান দিয়ে বাড়িয়ে দেন দক্ষিণ আফ্রিকার রানরেট।
এরই প্রভাবে কিনা মেহিদির আকাশে বল তুলে দিয়ে লিটনের হাতে জমা হন পেহলুখোয়ায়ো। ১৩ বলে ২ রান করে বিদায় হওয়ার আগে দলের বোঝা হয়ে ফেরেন এই অলরাউন্ডার।
এরপর আফ্রিকার লেজের সাথে সঙ্গে শুরু হয় বাংলাদেশের খেলা। তবে ওপাশে তখনও সিংহ মিলার। সুযোগ পেলেই আক্রমণে আসবেন জানা কথাই। যতটা সম্ভব স্ট্রাইক ধরে রেখে খেলার চেষ্টা করেন মিলার।
আগে দুই নেওয়া শরিফুলের আত্মবিশ্বাস দুমড়ে মুচড়ে দিতে দলীয় ৪৩তম ওভারে তলোয়ারের মতো ব্যাট চালান মিলার। প্রায় মিলিয়ে যাওয়া সুযোগটা আবারও উঁকি দেয় তার ৬,৪,৪, ১,১,১ মোট ১৭ রান তুলে নেওয়ায়।
৪৪ ওভারের শুরুতে সমীকরণ দাঁড়ায় ৪২ বলে ৯২ রান।
তবে ওই ওবারেই লেজের ব্যাটার মারকো জানসেন মেহিদির বলে ছক্কা মারতে গেলে বাউন্ডারি লাইনে তাকে ধরে ফেলেন অধিনায়ক তামিম ইকবাল। ম্যাচে আবার ফিরে আসে টাইগাররা। এরপর রাবাদা এসে হয়ে যান দুই বলের প্লেয়ার, সংহারক ওই মেহিদি।
মাঠজুড়ে শুরু থেকেই বাংলাদেশি সমর্থকই ছিল বেশি। হইচই করে স্লোগানে স্লোগানে তারাই মাঠ সজীব রেখেছিল। রাবাদার আউটের পর জয় দেখতে শুরু করেন তারা।
দলের লেজের শেষ দুই বোলারকে ব্যাটার হিসেবে পেয়ে স্বস্তির চেয়ে চিন্তাই বাড়ে মিলারের। শেষের খেলাটুকু তাই হয়ে যায় মিলার বনাম বাংলাদেশের। তবে ৪৬তম ওভারে এসে খে্ি হারিয়ে ফেলেন মিলার। শিকার হয়ে যান মেহিদির।
আফ্রিকার ব্যাটারদের মধ্যে ডুসেন ও মিলারই ভুগিয়েছেন সবচেয়ে বেশি। সেঞ্চুরি পাওয়ার আগেই ডুসেনকে (৮৭) থামান তাসকিন আর মিলার কাটা পড়েন মেহিদির বলে মুশফিকের স্ট্যাম্পিংয়ে ৭৯ রান করে। অধিনায়ক বাভুমা যত না রান করেছেন, ক্রিজে থেকে করিয়েছেন তার চেয়েও বেশি ।
শেষ দিকে শেষ জুটিতে মহারাজ ও এনডিগি দর্শকদের বিনোদিত করতে খেলা খানিকটা জমিয়েছিলেন। তবে তাদের সে চেষ্টা আফ্রিকার ভাগ্যে পরিবর্তন আনতে পারেনি।
শেষ পর্যন্ত মহারাজ এবিডব্লিউ হয়ে গেলে ৩৮ রানের জয় পায় টাইগাররা। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে এটি প্রথম ওয়ানডে জয় এবং সিরিজে বাংলাদেশ এগিয়ে গেল ১-০তে।
এর আগে প্রথম ইনিংস জমিয়ে দেন লিটনের পর সাকিব। রানের খাতাই শুধু নয়, শরীরী ভাষাতেই আজ এগিয়ে ছিলেন ‘বাংলার জান’ সাকিব আল হাসান।
নানা নাটকের পর দক্ষিণ আফ্রিকায় গেছেন দলের পরে, তবে নেমেছেন সেই সাকিবের ভূমিকাতেই যাকে দর্শকরা দেখেন তাদের কল্পনায়।
নিরুত্তাপ হতে পারতো যে ম্যাচ তাকে এখন বারুদ ঠাসা উত্তেজনায় তুলেছেন সাকিব। একের পর এক চার-ছক্কায় সেঞ্চুরিয়ন শাসন করছেন সাকিব। সাকিব অর্ধশত পেরিয়েছেন ৩৬ ওভারেই। শেষ পর্যন্ত তিনি করতে পারলেন ৭৭।
শেষ পর্যন্ত টিকে থাকলে দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠে শতকের গল্পও লেখার সম্ভাবনাও ছিল, তবে এনডিগির বলে এলবিডব্লিউ হয়ে ফিরতে হলো মাঠের বাইরে। তবে সাকিবের সেঞ্চুরিয়নে মারা ৭টা চার ও ৩টা ছক্কা খেলায় এনেছে প্রাণ, দলের বাকি খেলোয়াড়দের জন্য তা ছিল বুস্টার ডোজ। খেলায় জয়ের পর প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার গেছে তার হাতেই।
তাকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন আজ ইয়াসির আলী। সাকিবের পাশে পাশে সমান তালে খেলে শত রানের পার্টনারশিপ গড়েছেন। করেছেন অর্ধ শত রান।
বাংলাদেশের মিডল ও লোয়ার অর্ডারও আজ হতাশ করেনি। তিনটা ফিফটি ও বাকি সবার কার্যকরী ছোট বড় ইনিংসের এমন ব্যাটিংই আসলে টনিক হয়ে যায় দুর্দান্ত বোলিংয়ের জন্য।
ধন্যবাদ তামিম ও তার দলকে, পুরনো ইতিহাস মুছে নতুন করে শুরু করার জন্য।