logo
আপডেট : ১৯ মার্চ, ২০২২ ১১:৪৫
অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন
নিজস্ব প্রতিবেদক

অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান

১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০২তম জন্মবার্ষিকী এবং জাতীয় শিশু দিবস। আর বঙ্গবন্ধুর জীবনের ইতিহাস মানেই স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস। জীবনে তিনি যা কিছু করেছেন সবকিছু দেশের জন্যই করেছেন। মাত্র ৫৫ বছর তিনি বেঁচে ছিলেন। সময়ের বিচারে এটি সংক্ষিপ্ত হলেও তার জীবনের দৈর্ঘ্যরে আকারে তার কর্মের প্রস্থ ছিল অনেক বেশি। তার জন্ম না হলে আজ আমরা স্বাধীনতা পেতাম না। এই মহান নেতার সংক্ষিপ্ত জীবনী ইতিহাস সম্পর্কে জানা প্রতিটি বাঙালির অবশ্য কর্তব্য।


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাজার ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) বাইগার নদীর তীরবর্তী টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতার নাম সায়রা বেগম। শেখ লুৎফর রহমান এবং সায়রা বেগমের চার কন্যা ও দুই পুত্রের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ছিলেন তৃতীয়। তার ডাকনাম ছিল খোকা। টুঙ্গিপাড়াতেই খোকার শৈশবকাল কাটে।


১৯২৭ সালে মাত্র সাত বছর বয়সে গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষা জীবনের সূচনা হয়। গোপালগঞ্জ মিশন হাই স্কুল থেকে তিনি মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর ১৯৪৭ সালে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বি.এ পাস করেন। ইসলামিয়া কলেজের মুসলিম শিক্ষার্থীদের ছাত্রাবাসের নাম ছিল বেকার হোস্টেল। বঙ্গবন্ধু এ ছাত্রাবাসে থেকেই লেখাপড়া করতেন। তিনি এ ছাত্রাবাসের ২৪ নম্বর কক্ষে ১৯৪৫-৪৬ সাল পর্যন্ত ছিলেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন।


মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৯৩৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহ সম্পন্ন হয়। তাদের দুই কন্যাÑ শেখ রেহানা ও শেখ হাসিনা এবং তিন ছেলে- শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল। তাদের মেয়ে শেখ হাসিনা বর্তমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তার রাজনৈতিক জীবনে মোট ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। এর মাঝে ব্রিটিশ আমলে স্কুলের ছাত্রাবস্থায় ৭ দিন কারাভোগ করেন। বাকি ৪৬৭৫ দিন তিনি পাকিস্তান সরকারের শাসনামলে কারাভোগ করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি প্রথম কারাগারে যান।


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সারা জীবনের স্মৃতি নিয়ে একটি দুর্লভ আলোকচিত্র সম্বলিত বই রচিত হয়। বইটির নাম হলো ‘৩০৫৩ দিন’।


এ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর লেখা তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো হলো- অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১২), কারাগারের রোজনামচা (২০১৭) এবং আমার দেখা নয়াচীন (২০২০)।


ছাত্র জীবনেই তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে প্রথমবারের মতো জেলে যান। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন। তিনি তার স্নেহ, আনুকূল্য ও দিকনির্দেশনায় সক্রিয় রাজনীতিতে ক্রমান্বয়ে এগুতে থাকেন। কলকাতায় ছাত্রজীবনে তিনি ‘নিখিলবঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ’, ‘নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশন’ প্রভৃতি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন।


১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পূর্ববঙ্গের মানুষের ওপর পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ ও শাসন চলতে থাকে। পূর্ববাংলাকে মুক্ত করাই তখন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের প্রধান লক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনপড়ার সময় থেকেই পাকিস্তানি শাসকদের শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আরম্ভ করেন। ফলে ১৯৪৯ সালের ১১ মার্চ পাকিস্তানি সরকার তাকে গ্রেপ্তার করে।


১৯৪৯ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হলে তিনি যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে তিনি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে সাধারণ পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হলে নতুন প্রাদেশিক সরকার গঠিত হয়। তিনি ১৯৫৬ সালে প্রাদেশিক সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হন। কিন্তু দেশে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে তিনি কারারুদ্ধ হন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু হলে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।


১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যান। এ সময় কলকাতার হলওয়েল মনুমেন্ট ভাঙার আন্দোলনেও শেখ মুজিবুর রহমান অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালে জানুয়ারি মাসে শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রবিরােধী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। তার ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ বাংলার ইতিহাসে ‘মেঘনা কার্টা’ হয়ে আছে।


এদেশের রাজনীতির ইতিহাসে দেশের সুসন্তানগণকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। যেমনÑ চিত্তরঞ্জনকে দেওয়া হয়েছিল ‘দেশবন্ধু’ এবং ফজলুল হককে দেওয়া হয়েছিল ‘শেরে বাংলা’ খেতাব। ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটির অর্থ হলো ‘বাংলার বন্ধু’। বন্ধু তাকেই বলা যায়- যে প্রয়োজনের কথাটি বুঝতে পারে, তা মেটানোর জন্য চেষ্টা করে, বিপদে-আপদে পাশে থাকে। যখন পূর্ব পাকিস্তানের বড় বিপদ সেই বিপদ থেকে উদ্ধারের পথ নির্দেশনা দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাই তো তার নামকরণ বা উপাধি দেওয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধু।


১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে বিজয়ী হয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে না দিয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে শুরু করে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেপ্তারের আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার একটি ঘোষণাপত্র ওয়ারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা হান্নান চৌধুরীর কাছে পাঠান। এ ঘোষণাপত্রটি হান্নান চৌধুরী কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করেন। শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ।


বাংলা ভূ-খণ্ডের একটি সময়ে পরিচয় ছিল বিদেশি জাতির একটি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র হিসেবে। ইতিহাসের পাতায় এক নজর চোখ বুলালেই আমরা দেখতে পাই- জাতি হিসেবে আমাদের প্রতিটি পদে ব্যর্থতা। শক, তুন, মগ, পর্তুগিজ, ফরাসি, ওলন্দাজ, ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানিরা নানা সময় নানাভাবে আমাদের শোষণ করেছে। ভোগ করেছে আমাদের সম্পদ।


শুধু ১৯৭১ সালের যুদ্ধে আমরা বিদেশি পরাশক্তিকে রুখতে পেরেছিলাম। এর পেছনে সবটুকু ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান। তিনি নিজের স্বার্থকে সম্পূর্ণভাবে বিসর্জন দিয়ে লড়েছেন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য। জাতি হিসেবে আমাদেরকে প্রথম বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এই মহাপ্রাণ বাঙালি। আর তাই তিনিই বাঙালি জাতির জনক।


বাংলাদেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি আনন্দের দিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু একজনই জন্মেছিলেন। যার জন্ম না হলে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হতো না। যারা বাংলাদেশকে বিশ্বাস করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধারণ করে তাদের মাঝেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকবেন চিরকাল।


লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি