অনাদিকাল থেকে আজ অবধি বাঙালির যা কিছু অর্জন সবই রক্তমূল্যে কেনা। খ্রিস্টীয় দুই হাজার দুইশ’ বছর আগে থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাঙালি যা কিছু অর্জন করেছে তার মূলে রয়েছে বীর বাঙালির অপরিসীম আত্মত্যাগ এবং তুলনাহীন, আপসহীন, হার না মানা সংগ্রামশীলতা। এ অর্জনের পশ্চাতে রয়েছে অযুত বীরের রক্তস্রোত। কত তিতুমীর, কত ঈসা খাঁ, কত ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা, কত সালাম-রফিক, জব্বার, বরকত, ত্রিশ লাখ আত্মোৎসর্গকৃত অকুতভয় বীর বাঙালির উৎসর্গীকৃত জীবন। অগণিত মাতার বিগলিত অশ্রু, বীরাঙ্গনা নারীর উৎসর্গকৃত সম্ভ্রম, ভাই হারানোর মর্মান্তিক যাতনা-দহন। আর একজন আপসহীন সিংহ পুরুষ; বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালি জাতিসত্তার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পঞ্চান্ন বছরের বিলিয়ে দেয়া মহাজীবন। এই তুলনাহীন বীরত্বগাথার অপর নাম আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
অনাদিকালের বাংলার ইতিহাস মানে বিদ্রোহ বিপ্লব সংগ্রাম আর আত্মোৎসর্গের ইতিহাস। বাংলার প্রাচীন ইতিহাস মূলত রক্তরঞ্জিত হওয়ার ইতিহাস। আমরা চিরায়ত বাংলা বলতে যা বুঝি তা তার প্রাচীন ইতিহাসে যে সীমানা চিহ্নিত রয়েছে সেই সীমানা হলো উত্তরে গিরিরাজ হিমালয়, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে মিয়ানমার ও পূর্বে বিহার এবং উড়িষ্যা। আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে এই বাংলা পূন্ড্রবর্ধন ও দন্ডভুক্তি নামে দুটি ভুক্তিতে বিভক্ত ছিল। গুপ্তযুগে এই ভুক্তি দুটি ভেঙে বঙ্গ, বরেন্দ্র, রাঢ়, সমতট, হরিকেল ও রতœদ্বীপ নামে ছয়টি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় দুই হাজার দুইশ’ বছর পূর্বে মধ্য এশিয়া থেকে আর্য নামীয় এক যাযাবর জাতি এ দেশের গণমানুষের ওপর বর্বর আগ্রাসন ও অত্যাচার চালায়। এটাই ছিল বাঙালি জাতির ওপর বৈদেশিক ও বিজাতীয় কোনো আক্রমণ।
আর্যদের অনস্বীকার্য কলাকৌশল ও শৌর্য-বীরত্বের কাছে পরাজিত হওয়ার অনতিকাল পরেই বাঙালির স্বাতন্ত্র্যবোধ, আত্মমর্যাদা ও কৃষ্টি এবং সংস্কৃৃতির ওপর চরম আঘাত হানে আর্যরা। তারা বাংলার জনগণকে অসুর, দস্যু ইত্যাকার অপবাদে অপমানিত করে। বিপরীতে নিজেদের দেব জাতির অভিধায় ভূষিত করে।
১২২৭ থেকে ১২৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রবল প্রতিরোধ সত্ত্বেও এ দীর্ঘ ষাট বছর বাংলা দিল্লির অধীনে চলে যায়। এ ষাট বছর ১৬ জন শাসনকর্তা দ্বারা বাংলা শাসিত হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, এই ১৬ জন শাসনকর্তা মুখে দিল্লির অধীনতা স্বীকার করলেও তারা প্রায় স্বাধীনকার্য পরিচালনা করে। বাংলার অধিকাংশ শাসনকর্তাই স্বাধীনচেতা ছিল বিধায় তখন এই বাংলায় ঘন ঘন বিদ্রোহ দেখা দিত বলে বাংলাকে ‘বুলগ্রাকপুর’ বা বিদ্রোহী নগরী বলা হতো।
উল্লেখ্য, এসব শাসনকর্তার মধ্যে অনেকে বাঙালি ছিলেন না। অনেকেই বাংলাকে ভালোবেসে জীবনে অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এর মধ্যে বুগরা খান নামক একজন শাসক বাংলার মসনদ ছেড়ে দিল্লির সিংহাসনে বসতে সম্মত হননি। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার তুর্কী, খলজি, মালিক এবং বলবনী সুলতান ও গভর্নরগণ এই বাংলার শাসন প্রতিষ্ঠায় লালায়িত ছিলেন। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবরের আমলে বাংলা বিজিত হয়নি। ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাদশা হুমায়ুন গৌড় দখল করেন। ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে শের শাহ বাংলার মুঘল শাসক জাহাঙ্গীর কুলিকে পরাজিত করে বাংলাকে শুর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু চুনার দুর্গ দখলকালে বারুদের আগুনে অকস্মাৎ শের শাহের মৃত্যুর পরে আকবর বাংলা জয় করেন ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে।
মুঘলদের হাত থেকে বাংলার স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য দাউদ খান কল্যাণী, বারো ভূঁইয়া ও তাদের নেতা ঈশা খাঁ বহুদিন পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করেন। ১৭০৭ সালে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর বাংলার সুবেদার মুর্শিদ কুলি খাঁ বাংলাকে নামেমাত্র দিল্লির অন্তর্ভুক্ত রেখে স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা করেন। মুর্শিদ কুলি খাঁর পর তার নিজ পুত্র সুজাউদ্দৌলা, তার পুত্র সরফরাজ খাঁন এবং পরবর্তীকালে আলিবর্দি খাঁন বাংলা মুলক শাসন করেন। আলিবর্দি খাঁর বীরত্বে ও কৌশলে বর্গীদের বাংলা থেকে চিরতরে পর্যুদস্ত এবং পরাজিত করেন। ১৫৫৬ সালের ১০ এপ্রিল আলিবর্দি খাঁনের মৃত্যুর পরে তার দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা ১৭৫৭ সালের ২২ জুন পর্যন্ত মাত্র ১৪ মাস ১৪ দিন বাংলা বিহার উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। মীরজাফর এবং ঘষেটি বেগম প্রমুখের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে ইংরেজ জাতি পলাশীর প্রহসন যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে বাংলার স্বাধীনতা হরণ করেন। কিন্তু বীর বাঙালি কোনোদিন এই পরাজয় মেনে নেয়নি।
ইতিহাসের কালানুক্রমিক পথ বেয়ে ১৭৬৩ থেকে ১৭৬৯ সাল পর্যন্ত প্রথম কৃষক বিদ্রোহ চলমান ছিল। ইংরেজরা এর নাম দিয়েছিল ফকির সন্যাসী বিদ্রোহ। এরপর মেদেনীপুরে আদিবাসী কৃষক বিদ্রোহ, কুমিল্লায় কৃষক বিদ্রোহ, সন্দ্বীপের কৃষক বিদ্রোহ, তাঁতী বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, লবণ চাষি বিদ্রোহ, রংপুর, যশোর, খুলনা, বীরভূম, বরিশালের দক্ষিণাঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এছাড়া ময়মনসিংহে গারো বিদ্রোহের পর ১৮৫৭ সালে বাংলার হারানো স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য সিপাহি বিদ্রোহে বাঙালি মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহই বাংলার প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। যার নেতৃত্বে ছিলেন শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। কিন্তু যুদ্ধে তিনি জয়ী হতে না পারলেও বাংলার সংগ্রামশীল ইতিহাসে এই মহাবিদ্রোহ প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। এরপর ১৮৬১ সালে সুন্দরবন অঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহ, ১৮৭২-৭৩ সালে কুমিল্লায় কৃষক বিদ্রোহ, ১৯৩০ সালে সিরাজগঞ্জে কৃষক বিদ্রোহ এবং ১৯৪৬-৪৭ সালে তেভাগা কৃষক বিদ্রোহে জ্বলে ওঠে এ বাংলা। ১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসক ভারত ত্যাগ করলে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় জিন্নাহ’র ‘সাধের পাকিস্তান’।
মূলত, পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকে বাঙালির ধারাবাহিক নিপীড়ন ও বৈষম্য অব্যাহত থাকে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত প্রমুখ নাম না জানা বীর বাঙালিরা বুকের তাজা রক্ত আর জীবন দিয়ে মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় রূপদান করেন। এরপর ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের বিপরীতে যুক্তফ্রট বিজয় লাভ করলেও এদেশীয় কিছু মীর জাফর আর পশ্চিম পাকিস্তানের কুচক্রী শাসক মহলের কারণে তাদের ক্ষমতা চর্চার ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি। এ সময় পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর আরবি হরফে বাংলা প্রচলন, রবীন্দ্র সংগীত বন্ধসহ অর্থনৈতিক বৈষম্য নির্যাতন আর অত্যাচারের রোষানলে বাংলার মানুষকে দাবিয়ে রাখার কূটচাল অব্যাহত রাখে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬২ সালে এক দুর্বোধ্য শিক্ষানীতি বাংলার ওপর চাপিয়ে দেয়। ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামে অদ্ভুত এক শাসন প্রণালি উপহার দেয়। এর প্রতিবাদে বাঙালির অসীম সাহসী সিংহ পুরুষ শেখ মুজিব ছয়দফা নামীয় বাঙালির ‘মেঘনাকার্টা’ ঘোষণা করেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শুরু হয় বাঙালির স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার সংগ্রাম। এরপর ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়, ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চের অসহযোগ আন্দোলন, ২৫ শে মার্চের কালো রাতে বর্বর গণহত্যা এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর আমরা লাভ করি মহান স্বাধীনতা। আমরা পাই একটি লাল সবুজের পতাকা এবং সার্বভৌম বাংলাদেশ।
কিন্তু, এ দেশীয় কতিপয় ষড়যন্ত্রকারী মুশতাক, তাহের, ফারুক, রশীদ, ডালিম গং আর তাদের নেপথ্য সহায়তাকারীদের ষড়যন্ত্র আর বাংলাদেশে স্বাধীনতাকে মেনে না নেওয়া বিদেশি শত্রুদের মিশেল চক্রান্তে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয়। এরপর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে রাউফুন বসুনিয়া, সেলিম, জয়নাল, নূর হোসেনরা জীবন দান করে। এদের সম্মিলিত রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ আজ উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে।
বস্তুত, বাংলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্তে রঞ্জিত হওয়ার ইতিহাস। অনাদিকাল থেকে বীর বাঙালি কোনোদিন জীবনের বিনিময়ে হলেও পরাধীনতাকে মেনে নেয়নি। আর্যদের আক্রমণের পর থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এবং তৎপরবর্তী সব স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি সংগ্রাম ও লড়াই অব্যাহত রেখেছে এবং জীবনের বিনিময়ে হলেও মাতৃভূমি, মাতৃভাষা এবং তার স্বাধীনতা অর্জন ও লালনের ক্ষেত্রে আপসহীন ভূমিকা পালন করেছে।
এমন বীরের জাতি পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই আছে। কারণ বাঙালির সব অর্জনই তার মহামূল্যবান রক্তমূল্যে কেনা। তাই স্বাধীনতাহীনতায় সে কোনোদিন বাঁচতে চায়নি এবং বাঁচতে শিখেওনি। প্রয়োজনে নিরীহ বাঙালি অস্ত্র ধরেছে এবং জীবন দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন ও সংরক্ষণ করেছে। আমরা আজ গর্ববোধ করে বলতে পারি- বাঙালির গৌরবের ঝুলিতে হিরন্ময় যে অর্জন তা কারো করুনার দান নয় বরং সবই তার এক সাগর রক্তমূল্যে কেনা।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক এবং সাবেক পরিচালক, মাউশি