logo
আপডেট : ২০ মার্চ, ২০২২ ১২:০২
বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় শিশু-কিশোর দিবস
নিজস্ব প্রতিবেদক

বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় শিশু-কিশোর দিবস

শিশু-কিশোরদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন বুনেছেন দেশ গড়ার

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেম্স ম্যাক গ্রেগর বার্নস- এর নাম অনেকেই জানেন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব সংক্রান্ত তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্যে তিনি সুপরিচিত এবং যথেষ্ট সুখ্যাতিও অর্জন করেছেন। বিশ্বে তাকে রাজনীতিকদের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অথরিটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ বিষয়ে তিনি জবরদস্ত আলেম, মান্যবর। তার একটি বিখ্যাত গ্রন্থ ‘লিডারশিপ’। এতে তিনি দু-ধরনের নেতৃত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। তার বিশ্লেষণ অনুযায়ী- স্থানীয় বা জাতীয় রাজনীতিতে একদল নেতা আছেন, যারা শুধু আদান-প্রদাননির্ভর। তারা নিজের সুযোগ-সুবিধা, ক্ষমতা এবং নিজের স্বার্থ বলয়ের বাইরে কিছু ভাবতে পারেন না। তারা গদিতে বসেন, গদি হারান। কিন্তু সমাজে ও মানুষের মনে চিরস্থায়ী কোনো প্রভাব ফেলতে পারেন না। মানুষ একটা সময়ের পর তাদের আর মনে রাখে না। এ ধরনের নেতাদের ‘ÔTransactional Leader’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। আরেক শ্রেণির নেতা আছেন; তারা বিরল প্রকৃতির। তারা উঁচুমাপের অন্যরকম নেতা। একটা দেশে এ জাতীয় নেতার আবির্ভাব ঘটে যুগ যুগ ব্যবধানের পর। তারা সমাজকে আলোর পথ দেখান, ঘরে ঘরে জ্বালেন উন্নয়ন ও জীবনমুখী শিক্ষার আলো। একটা দেশ, জাতি তথা গোটা মানবসমাজকে জ্যোর্তিময় প্রভায় প্রভাবিত করেন। জেম্স বার্নস এ ধরনের নেতাদের বলেছেন ‘Transfroming Leader’।


বার্নস’-এর লিডার তত্ত্ব অনুযায়ী, আমাদের দেশে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই বিরল প্রকৃতির নেতা, যিনি কিনা একটা জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটিয়ে বিশ্বের বিস্ময় হিসেবে উদাহরণ সৃৃষ্টি করেছেন। এই মহান ব্যক্তিটি ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা সায়রা খাতুন মহান মুজিবের গর্বিত পিতা-মাতা। সুজলা-সুফলা এই শ্যামল বাংলার অপরূপ সৌন্দর্যানুভূতির জায়গাটা বৃহৎ পরিসরে বাঙালি তথা বিশ্ব মানবসমাজের তীর্থভূমিতে পরিণত হয়েছে শেখ মুজিবের জন্মের কারণে।


ব্রিটিশ শাসনামলে গোপালগঞ্জ ছিল একটি থানা। ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে সৃষ্টি হয় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটো রাষ্ট্র। পাকিস্তানের দূরবর্তী একটি অংশ পূর্ব পাকিস্তানে শাসনকার্যের সুবিধার লক্ষ্যে গোপালগঞ্জকে ‘মহকুমা’র মর্যাদা দেওয়া হয়। টুঙ্গিপাড়া গোপালগঞ্জের নিকটবর্তী একটি গ্রাম। নদীবিধৌত গোপালগঞ্জ ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে ব্রিটিশ আমল থেকেই। ছবির মতো টুঙ্গিপাড়া গ্রাম শেখ পরিবারের ঐতিহ্য ঐতিহাসিকতার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত। শেখ মুজিব এই পরিবারে জন্মগ্রহণ করে পরিবারের ঐতিহ্যকে ভিন্নভাবে রাঙিয়ে দেন। বাইগার নদীর তীরঘেঁষা গ্রাম টুঙ্গিপাড়া শেখ পরিবারের হাত দিয়েই অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি অর্জন করে। শেখ মুজিবের পূর্বপুরুষের প্রতিষ্ঠিত গিমাডাঙ্গা স্কুলটি গ্রামের শিশু-কিশোরদের জন্য ছিল মহাতীর্থের মতো। এই স্কুলেই শেখ মুজিবের প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি।


আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা একটি গ্রন্থে ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ শিরোনামে প্রবন্ধটিতে শেখ মুজিবের কৈশোরের অনেক বর্ণনা রয়েছে। সে অনুযায়ী, শেখ মুজিবের শৈশব কেটেছে টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে মেঠো পথের ধুলোবালি মেখে এবং বর্ষার কাদাপানিতে ভিজে। বাবুইপাখি বাসা কেমন করে গড়ে তোলে, মাছরাঙা কিভাবে ডুব দিয়ে মাছ ধরে, কোথায় দোয়েল পাখির বাসা, দোয়েল পাখির সুমধুর সুর শেখ মুজিবকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করত। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেদের সঙ্গে করে মাঠেঘাটে ঘুরে প্রকৃতির সাথে মিশে বেড়াতে তার খুবই ভালো লাগত। ছোট শালিক, পাখির ছানা, ময়নাপাখির ছানা ধরে তাদের কথা বলা ও শিস দেয়া শেখাতেন। বানর ও কুকুর পুষতেন; তাঁর কথামতো যা বলত, তারা তাই করত। এগুলো মুজিবের প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা ও পশুপাখির প্রতি মমত্ববোধের বহির্প্রকাশ।


শেখ মুজিবকে পরিবারের সকলেই আদর করে ‘খোকা’ বলে ডাকত। কিন্তু প্রতিবেশীরা তাকে ‘মিয়া ভাই’ বলে ডাকত। তিনি সবার প্রিয় ‘মিয়া ভাই’। মানুষের প্রতি ছিল অপরিসীম মমত্ববোধ। গরিব ও দুঃখী মানুষের সাহায্যের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন উদার। গিমাডাঙ্গা স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন সময়েই তার মধ্যে ন্যায়বোধ জেগে ওঠে। উল্লেখ্য, জরাজীর্ণ সেই স্কুলটিতে তদানীন্তন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা একেএম ফজলুল হক পরিদর্শনে যান। বর্ষার পানি স্কুলে প্রবেশ করত। এ সমস্যাটির কথা সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। স্কুলঘরটি মেরামতের প্রতিশ্রুতি আদায় করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। ন্যায়সঙ্গত দাবি তুলে ধরায় মুখ্যমন্ত্রীও শেখ মুজিবের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করেন। এভাবে শেখ মুজিব ধীরে ধীরে নেতৃত্বের জন্য যোগ্য হয়ে ওঠেন।


ছোটবেলায় শেখ মুজিবের ‘বেরিবেরি’ রোগে আক্রান্ত হলে চোখ খারাপ হয়ে যায়। ফলে চার বছর শিক্ষাজীবন স্থগিত রাখতে হয়। সুস্থ হয়ে আবার স্কুলে ভর্তি হন। শেখ মুজিবের একজন গৃহশিক্ষক ছিলেন; তার নাম হামিদ মাস্টার। হামিদ মাস্টার ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য। এজন্য মাস্টার সাহেবকে বহু বছর জেল খাটতে হয়েছে। কীভাবে ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন করতে হয়, সেই মাস্টার সাহেবের কাছ থেকে তিনি অনেকটাই শিক্ষা গ্রহণ করেন।


শেখ মুজিবের আরেক স্কুলশিক্ষক একটা সংগঠন গড়ে তোলেন। বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাল, ধান, টাকা পয়সা তুলে মেধাবী গরিবদের সাহায্য করাই ছিল ওই সংগঠনের কাজ। শেখ মুজিব এই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হয়ে মানবসেবার কাজে মনোযোগী হন। অবশ্য এ কাজে পরিবার থেকে কোনো বাধা বা আপত্তি আসেনি। বরঞ্চ পরিবারের অন্য সদস্যরা শেখ মুজিবকে অণুপ্রেরণাই যুগিয়ে যেত।


সাংগঠনিক দক্ষতা অর্জনের এটি কার্যকর পদক্ষেপ ছিল শেখ মুজিবের। সামাজিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতিও ছিল প্রচণ্ড ঝোঁক। গড়ে তুলেছিলেন ফুটবল ক্লাব। সব কাজ সামলিয়ে লেখাপড়াও চালিয়ে যেতেন। গোপালগঞ্জের মিশনারি থেকে ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতার ইসলামি কলেজ ভর্তি হন শেখ মুজিব। সেখানে বেকার হোস্টেলে থাকতেন। বেকার হোস্টেলে থেকে পড়ালেখা করতে গিয়ে নানামুখী অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। বিখ্যাত রাজনীতিক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শ লাভ করেন এখান থেকেই। গণতন্ত্রের মানসপুত্র সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক শিষ্যত্ব গ্রহণ করে পুরোদস্তুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। ১৯৪৬ সালে বিএ পাস করেন। এই বছরটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারতবর্ষে ভয়ানক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। সেই দাঙ্গা প্রতিরোধে যুবক শেখ মুজিব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস মতবাদের প্রতি মুজিব আকৃষ্ট হয়ে মানবতাবাদী নেতা হিসেবে নিজেকে বিকশিত করেন। তারপর ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান যখন সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকে লালন করতে থাকে, মুজিব তার বিরুদ্ধেও কথা বলতে থাকেন।


পাকিস্তানিদের শাসন-শোষণ এবং ভেদনীতির সঙ্গে মুজিব খাপ খাওয়াতে পারেননি। মুজিব আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলেন। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ শাসনামলে ‘মুসলীম লীগ’ ছিল পশ্চাৎপদ মুসলমানদের একমাত্র প্ল্যাটফর্ম। পরে মুসলীম থেকে আওয়ামী মুসলীম লীগ, এরপর ‘মুসলিম’ শব্দটি পরিত্যাগ করে আওয়ামী লীগের জন্ম ঘটে। একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়; এই যুদ্ধটিও মূলত সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে সংঘটিত হয়। কেননা, এর এক বছর পূর্বে ১৯৬৪ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়। ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জে দাঙ্গার ভয়াবহতা ছিল উল্লেখ করার মতো। যা হোক, মুজিব দাঙ্গা দমনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।


অন্যায়-অসত্য ও অবিচার প্রতিরোধে তিনি যেমন কঠিন ছিলেন, তেমনি প্রেম-পুণ্য-ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়েছেন এ জাতিকে। প্রেমেই মানবজীবনের সঠিক নির্দেশনার পথকে প্রশ^স্ত করে। মানুষের কল্যাণে বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রেমময় আত্মার বিকাশ ঘটে মানবরূপে। জীবাত্মা ও পরম্পরায় আবৃত মানুষ নানাভাবেই জীবনকে মাত্রা দিয়ে থাকে। এই মাত্রায় কেউ কেউ মহৎ জীবনের অধিকারী হয়ে ওঠেন। কারো কারো জীবনদর্শন এমন এক মাত্রায় পর্যবসিত হয়, যা মানুষের আত্মমর্যাদা, স্বাধীনতা ও সাম্যের ভিত্তিতে নতুন কল্যাণমুখী সমাজ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। বঙ্গবন্ধু আমাদের সামনে এমন এক লক্ষ্য স্থাপন করতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং একটি দেশের জন্ম দিয়ে গেছেন। তাঁর মধ্যে যে ‘দেবত্ব’ ছিল, সেই দেবত্বই মহিমান্বিত করেছে বিশ্ব সমাজকে।


আমাদের অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে, সব নারী-পুরুষকে কাজ করতে হয় এবং দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নিতে হয়। তাদের জীবন ও কর্ম সম্বন্ধে একটা দর্শন থাকা দরকার। ওই দর্শনের কথা বঙ্গবন্ধু ছোটবেলা থেকেই চিন্তা করেছেন; যা পরে প্রতিভাত হয়েছে জাতীয় জীবনে। তিনি শিশু-কিশোরদের নিয়ে স্বপ্ন বুনেছেন দেশ গড়ার। বঙ্গবন্ধু চেয়েছেন- বাঙালি জাতি হবে সমুদ্রের মতো গভীর আর আকাশের মতো বিস্তৃত। এই চেতনায় রয়েছে বুদ্ধির উন্নতি ও পূর্ণতা সাধনের নিগূঢ় সদর্শন। এই দর্শনকে সামনে রেখেই ১৭ মার্চ জাতীয় শিশু-কিশোর দিবস হিসেবেও পালিত হয়ে আসছে।

লেখক : কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক