মিরপুরের বাসিন্দা সাইফুল্লাহ মাহমুদ। গতকাল রোববার ব্যক্তিগত কাজে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন দুপুর ১২টায়। প্রেসক্লাবে পৌঁছতেই তার সময় লাগে প্রায় ৩ ঘণ্টা। অথচ স্বাভাবিক সময় এটুকু পথ যেতে মোট সময় লাগার কথা আধা ঘণ্টা থেকে পৌনে এক ঘণ্টা। রাজধানী ঢাকার এই পরিবেশ এখন আর নেই। যানজটের কবলে পড়ে নাকাল হচ্ছে নগরবাসী।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রোববার সকাল থেকে রাজধানীর রামপুরা, বনশ্রী, বাড্ডা, নতুন বাজার, কুড়িল বিশ্বরোড, গুলিস্তান, শাহবাগ, মতিঝিল এলাকায় তীব্র যানজট। হাতিরঝিলে যানজট বেশি থাকায় ওয়াটার বাসে যাত্রী বেশি। গাড়ির চাপ এত পরিমাণ বাড়ছে যে ট্রাফিক সিগনাল ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। এক গন্তব্য থেকে অন্য গন্তব্যে পৌঁছাতে যাত্রীদের কয়েক গুণ সময় বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। প্রশ্ন হঠাৎ কেন যানজট বাড়ছে?
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার ছিল সরকারি ছুটি। এক টানা ছুটি পাওয়ায় অনেকে রাজধানী ছেড়ে চলে যান। রোবার অফিস ডে শুরু হতেই রাজধানীতে চাপ বাড়তে শুরু করায় আবারো সীমাহীন যানজট শুরু হয়েছে। এ কারণে সব ধরনের গাড়ির চলাচল বেড়েছে।
পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘ সময় ধরে স্কুল, কলেজ বিশ^বিদ্যালয় বন্ধ ছিল করোনার কারণে। বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ায় গত ১৫ মার্চ থেকে রাজধানীর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীরে ক্লাস শুরু হয়েছে। ফলে ছুটির দিন বাদে প্রায় প্রতিদিন যাত্রীর চাপ বেড়ে গেছে কয়েক গুণ।
একই সঙ্গে মাহে রমজান সমাগত। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই শুরু হচ্ছে পবিত্র মাহে রমজান। এ উপলক্ষে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের বড় ধরনের প্রস্তুতি থাকে। বিশেষ করে এই মাসে নতুন পোশাক কেনার ধুম পড়ে যায়।
করোনার কারণে গত দুই বছরের রমজানে দেশের প্রায় সব দোকানপাট বন্ধ ছিল। ফলে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারেনি। এবার রমজান উপলক্ষে প্রচুর পাইকারি ব্যবসায়ী রাজধানীতে আসছেন। ফলে যানজট বাড়ছে। একই সঙ্গে করোনা মহামারি কাটতে শুরু করায় রাজধানীতে মানুষের আনাগোনা বেড়েছে আগের তুলনায় বেশি। সেই সঙ্গে বাড়ছে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার। ফলে দিন দিন রাজধানীতে অসহনীয় হয়ে উঠেছে যানজট।
পরিবেশ সংগঠন পবার সভাপতি আবু নাসের খান বলেন, রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার বেড়েছে। প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল, সিএনজি ইত্যাদির সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। এতে যানজট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। তিনি বলেন, দুটি প্রাইভেট কারে দুজন যাত্রী সড়কের যে জায়গা দখল করেন, সেই একই জায়গায় গণপরিবহণের একটি বাস অর্ধশতাধিক যাত্রী বহন করতে পারে।
ঢাকার রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি অধিক পরিমাণ চলাচলের কারণে কোনো রুটেই পর্যাপ্ত বাস থাকছে না। দীর্ঘক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পরও বাসে ওঠা যায় না। অনেকে বাধ্য হয়ে বেশি টাকা ব্যয়ে উবার পাঠাওয়ের মতো ছোট যানবাহনে যাতাযাত করছে। ফলে ক্রমাগত বাড়ছে যানজটের অসহনীয় ভোগান্তি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার যানজটের আরো একটি বড় কারণ ব্যক্তিগত গাড়ির আধিক্য। স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান বা এসটিপির হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকায় কম-বেশি ১৫ ভাগ যাত্রী প্রাইভেট গাড়িতে যাতায়াত করেন। এই ১৫ ভাগ যাত্রীর দখলে রয়েছে মোট সড়কের ৭০ ভাগ। বাকি ৮৫ ভাগ যাত্রী অন্য কোনো ধরনের গণপরিবহণ ব্যবহার করেন। অর্থাৎ ৮৫ ভাগ যাত্রী সড়কের মাত্র ৩০ ভাগ এলাকা ব্যবহার করেন।
বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, রাজধানীতে সৃষ্ট যানজটে প্রতিদিন আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এর মধ্যেই প্রতিদিন নগরীর রাস্তায় নতুন করে নামছে প্রায় ২০০ পরিবহণ। যা ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের জন্য। ফলে কোনো রুটেই পর্যাপ্ত বাস মিলছে না। মানুষের ভোগান্তি শুধু বাড়ছেই। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাদাগাদি করে বাসে উঠতে বাধ্য হচ্ছে নগরের যাত্রীরা। যানজটের কারণে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকা নগরী।
২০১৭ সালের জুলাইয়ে বিশ্বব্যাংকের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, যানজটে রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এ কারণে বছরে যে আর্থিক ক্ষতি হয়, অঙ্কের হিসাবে তা প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। ঢাকায় গাড়ির গতি ঘণ্টায় গড়ে প্রায় সাত কিলোমিটার।
বিশ্বব্যাংক এর মতে, এভাবে চলতে থাকলে আর কিছুদিন পর হেঁটেই গাড়ির আগে যেতে পারবে মানুষ। যানজটের পরিস্থিতি দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে। ছোট যানবাহনের পরিমাণ যদি এই হারে বাড়তে থাকে তাহলে ২০২৫ সালে এই শহরে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম।