logo
আপডেট : ২২ মার্চ, ২০২২ ০৮:৪৮
শতভাগ বিদ্যুৎ: উন্নয়নের মাইলফলক
মো. রেজাউর রহিম

শতভাগ বিদ্যুৎ: উন্নয়নের মাইলফলক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার পটুয়াখালীতে দেশের সবচেয়ে বড় ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর পরিদর্শন করেন। ছবি- পিআইডি

দেশে চাহিদার শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাইলফলক অর্জন করেছে বাংলাদেশ। গতকাল সোমবার পটুয়াখালীর পায়রায় ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনের মাধ্যমে দেশে শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত দেশে রূপান্তরিত করার স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যা একটি বড় পদক্ষেপ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত এ দেশে পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের আল্ট্রা সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে ১৩তম। এ ছাড়া দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৫ গুণের বেশি বেড়েছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৪৯৪২ মেগাওয়াট। যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দাঁড়িয়েছে ২৫,৫১৪ মেগাওয়াটে। এর মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানিও রয়েছে। আর ১৯৬২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। এছাড়া এর মাধ্যমে বিদ্যুতের লোডশেডিং অনেকাংশে দূর হবে।

বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ১৪ হাজার মেগাওয়াট। অন্যদিকে সিস্টেম লসও এখন সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে এসেছে।

পল্লি বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) তথ্যানুযায়ী, আরইবির গ্রিডভুক্ত ৪৬১টি উপজেলা এখন শতভাগ বিদ্যুতায়িত। এছাড়া পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালি উপজেলাটি অফগ্রিডভুক্ত হলেও সেখানে বিদ্যুতায়ন সম্পন্ন হয়েছে।

এদিকে, গ্রিডভুক্ত এলাকাগুলোতে শতভাগ বিদ্যুতায়ন সম্পন্নের পাশাপাশি অফগ্রিড এলাকায়ও বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে সোলার প্যানেল কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে। এর ফলে বাংলাদেশ হচ্ছে শতভাগ জনপদে বিদ্যুৎসেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ। পাশাপাশি এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। বর্তমান সরকারের লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশের সব মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানো। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এরই মধ্যে শতভাগ বিদ্যুতায়ন সম্পন্ন হয়েছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আমাদের লক্ষ্য ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশের সব পর্যায়ের মানুষের ঘরে বিদ্যুতের আলো জ্বালাব। আমরা প্রতিশ্রুতি রাখতে পেরেছি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ এখন বিদ্যুতায়িত উল্লেখ করে তিনি বলেন, সারা দেশের মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছাতে পারাটা বর্তমান সরকারের বড় সফলতা।

নসরুল হামিদ বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে সরকার দেশকে শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় আনার এক লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছিল এবং ২১ মার্চ সরকার তার এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী, সাহসী ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের ফলে গত ১৩ বছরে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে অভূতপূর্ণ সফলতা এসেছে।

প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, দেশের টেকসই উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অজনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে বিদ্যুৎ খাতের পরিকল্পনাগুলো সফলভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হলে সরকারের রূপকল্প অনুযায়ী ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে বিদ্যুতের উৎপাদন ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। আর গত ১৩ বছরে উৎপাদন বেড়েছে ১৯ হাজার ৬২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। শতাংশের হিসাবে ৯৯.৮৫। তিনি জানান, বর্তমানে ১৩ হাজার ২১৯ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। এ ছাড়া শীত এবং অফ পিক মৌসুমে বিদ্যুৎ রপ্তানির পরিকল্পনাও রয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগের।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, বাংলাদেশ এখন শতভাগ জনপদে বিদ্যুৎসেবা পৌঁছে দেওয়া দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ। এটি বড় ধরনের একটি মাইলফলক। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনায় ইআরপি, স্ক্যাডা, স্মার্টগ্রিড, স্মার্ট প্রিপেইড মিটার, ভূগর্ভস্থ কেব্্ল ব্যবস্থা, ভূগর্ভস্থ উপকেন্দ্র, জিআই ট্রান্সফরমার সংযোজনের উদ্যোগ নিয়েছে। এসব প্রকল্পের কাজ চলমান। এছাড়া ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় মাটির নিচ দিয়ে বিদ্যুতের কেব্্ল সম্পন্নের কাজ চলছে।

প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই ইলাহী বলেন, স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাশিয়ার সহায়তায় বিদ্যুৎ খাত পুনর্গঠন কাজ শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন শতভাগ বিদ্যুতায়নের রেকর্ড গড়েছে।

সূত্র জানায়, গত ১৩ বছরে বিদ্যুৎ খাতে ৫ হাজার ২১৩ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া মোট ৩ লাখ ৬১ হাজার কিলোমিটার বিতরণ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে নতুন গ্রাহকের সংযোগ সাড়ে তিন কোটি। বিদ্যুৎ সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৪৭ ভাগ থেকে ৯৯ শতাংশে পৌঁছেছে। মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ২২০ কিলোওয়াট থেকে প্রায় ৫৬০ কিলোওয়াটে উঠেছে। পাশাপাশি সিস্টেম লস ৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছে। এর বাইরে ৪৬ লাখ ৭৭ হাজার প্রিপেইড মিটার স্থাপন করা হয়েছে। সেচ মৌসুমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে।

বিদ্যুৎ সচিব মো. হাবিবুর রহমান ভোরের আকাশকে জানান, বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশ। এছাড়া সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে ইতোমধ্যে দেশের চর সোনারমপুর, আশুগঞ্জ, রাঙ্গাবালি, মনপুরা, সন্দ্বীপ, হাতিয়া, নিঝুম দ্বীপ ও কুতুবদিয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, অবকাঠামো এবং অর্থনৈতিক অবস্থায় ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর বিষয়টি কঠিন হলেও সরকার তা বাস্তবায়ন করেছে।

সূত্র জানায়, বিদ্যুৎ খাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা অংশ হিসেবে গত নভেম্বর মাসে ৯৯ দশমিক ৭৫ ভাগ বিদ্যুতায়ন সম্পন্ন হয়। এরপর গত ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই দেশের ৯৯ দশমিক ৮৫ ভাগ এলাকায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন সম্পন্ন হয়। বাকি ছিল শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার দুর্গম এলাকা। এগুলো সবই অফগ্রিড এলাকা। এ অঞ্চলে সোলার প্যানেলের মাধ্যম ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে বিদ্যুৎ পৌঁছানো সম্ভব নয়। এজন্য সোলারের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ পৌঁছানো হয়েছে।

এছাড়া সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন কেব্্লের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর বিষয়টি ছিল স্বপ্নাতীত। বিচ্ছিন্ন হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপে ১৫ মেগাওয়াট বিদ্যৎকেন্দ্র নির্মাণ করে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সন্দ্বীপ, হাতিয়া, মনপুরা, রাঙ্গাবালীর মতো দুর্গম জায়গাগুলোতে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানো হয়েছে। সারা দেশে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর ফলে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত দেশে রূপান্তরের স্বপ্ন বাস্তাবায়ন অনেকাংশে সহজ হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপদনের বিষয়টি নিঃসন্দেহে একটি বড় অর্জন। এ অর্জনকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি দূর করা এবং অপচয় বন্ধ করা জরুরি।