logo
আপডেট : ২২ মার্চ, ২০২২ ১০:১৯
বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামছেই
তারেক মাহমুদ, রাজশাহী ব্যুরো

বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামছেই

বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রতিবছরই কমছে পানির স্তর। এর প্রভাব পড়েছে রাজশাহী নগর সংলগ্ন পদ্মা নদীতে

‘কয়েক বছর ধরেই খরা মৌসুমে জমিতে সেচ দিলে পানির পরিমাণ কম পাওয়া যায়। মাঝে মধ্যে সেচের ইঞ্জিনটি বন্ধ হয়ে যায়। ফসলে ভালোভাবে পানি দিতে পারছি না। সঠিকভাবে পানি না পাওয়ায় ফসলে পুষ্টি কম পাচ্ছে। তাই আশানুরূপ ফসল হচ্ছে না এই খরা মৌসুমে।’ বলছিলেন রাজশাহীর তানোর উপজেলার কৃষক নূর মোহাম্মদ। ধান ও আলুর জমিতে প্রতি বছর পানির জন্য ভোগান্তি পোহাতে হয় তাকে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার কৃষক সাইদুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। তিনি জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষ গরমকালে চরম পানি সংকটে পড়ে। যেসব জায়গায় পানি উঠছে, তা প্রয়োজনের তুললনায় অনেক কম। অনেক এলাকায় সুুপেয় পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে প্রায় আধা কিলোমিটার দূর থেকে। সেখানে পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের গাড়িচালক মতিউর। তিনি ২০১১ সালে যখন চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঝিলিম ইউনিয়নে ফল চাষ করে নিজের ভাগ্য পরিবর্তনে উদ্যোগী হন, তখন সবচেয়ে বড় যে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছিলেন তা ছিল পানির সংকট। সবচেয়ে কাছের পানির উৎসটি ছিল আড়াই কিলোমিটার দূরে। দূরের সেই পানির উৎস ছিল বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) একটি গভীর নলকূপ।

শুকনো মৌসুমে শুকিয়ে গেছে রাজশাহী নগর সংলগ্ন পদ্মা নদীতে

 

মতিউর সেখান থেকেই পানি নিতে শুরু করেন। কিন্তু মাত্র ছয় বছরেই নলকূপটি শুকিয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়তে হয় তাকে। শুধু সেচ নয়, বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষকে পানির জন্য এখন সংগ্রাম করতে হচ্ছে। পানির অভাবে অনেক কৃষক ধান চাষ বাদ দিয়ে কম সেচ লাগে এমন সব ফসলের চাষ করছেন। অনেকে ফসলি জমিকে মাছ চাষের পুকুর এবং এমনকি ইটভাটায় রূপান্তরিত করছেন।

এখন চলছে চৈত্র মাস। বৈশাখের শুরু থেকেই উত্তরাঞ্চলে এখন চারদিকে খাঁ খাঁ রোদ। কয়েকদিন ধরেই তাপমাত্রার পারদ ঊর্ধŸমুখী। যা গিয়ে ঠেকেছে মাঝারি ও তীব্র দাবদাহে। তাপমাত্রার পারদ চড়েছে এখন ৩৭-৩৮। উপরে তাপমাত্রার যেমন বাড়বাড়ন্ত, তেমনি মাটির নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর।

হিসাব বলছে, বর্তমানে এ অঞ্চলে পানির স্তর নেমেছে মাটির ১৫০ থেকে ১৭০ ফিট নিচে। শুধু রাজশাহী কিংবা নওগাঁর বরেন্দ্র অঞ্চল নয়, পদ্মা লাগোয়া রাজশাহী নগরীতেই প্রতিবছর পানির স্তরও নিচে নামছে।

ভূগর্ভস্থ পানি ও দাবদাহ সংকটের জন্য বৈশ্বিক উষ্ণতা, বৃক্ষনিধন, বরেন্দ্র অঞ্চলের মরুময়তাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। আবহাওয়া অফিসের মতে, হঠাৎ ক্ষণিকের বৃষ্টি প্রশান্তি আনলেও সহসাই খুব একটা হেরফের হচ্ছে না চলমান দাবদাহের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তুলনামূলক কম বৃষ্টিপাতের এই অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে। ধান চাষ ছাড়াও সেখানে চালকল এবং অন্যান্য শিল্পের প্রয়োজনে যথেচ্ছভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের খনিজ পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক চৌধুরী সারোয়ার জাহান বলেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলে বিভিন্ন ফসলের প্রচুর পরিমাণে চাষাবাদ হচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তা চিন্তা করেই আমরা চাষাবাদ করছি। তার পরও এই অঞ্চলের পানি নেমে যাচ্ছে। কিছু প্রতিষ্ঠান এ সমস্যা সমাধানে কিছুটা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

‘বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নতুন করে তাদের ডিপ টিউবওয়েল বসাচ্ছে না। তাদের ১২ থেকে ১৩ হাজার ডিপ টিউবওয়েল দিয়েই কাজ করছে। কিন্তু সব মিলে ২৫ হাজার গভীর নলকূপের চাহিদা রয়েছে। পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে, কারণ ভূগর্ভস্থ পানিতে সব মানুষের অধিকার থাকলেও অল্প কিছু লোক তা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে তুলে নিচ্ছে।’

তিনি জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রায় ২৩ বর্গকিলোমিটার এলাকার ঝিলিম ইউনিয়নে কমপক্ষে ৩৫টি অটো রাইস মিল রয়েছে, যেগুলো প্রতিনিয়ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করছে। এর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে মাটির নিচের পানির স্তরে। সেখানের অটো রাইস মিল মালিকরা জানাচ্ছেন, ভূগর্ভস্থ পানি ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প তাদের কাছে নেই, তাদের ব্যবসা করতে এভাবেই পানির ব্যবহার করতে হবে।

অধ্যাপক চৌধুরী সারোয়ার জাহান জানান, ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাত বছরে এই অঞ্চলের বার্ষিক বৃষ্টিপাত কখনো ১৪০০ মিলিমিটার অতিক্রম করেনি, যা জাতীয় গড় ২,৫৫০ মিলিমিটার থেকে ৪৫ শতাংশ কম। গত বছর অবশ্য এ অঞ্চলে ১৮০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল ও গোমস্তাপুর, রাজশাহী জেলার তানোর ও গোদাগাড়ী এবং নওগাঁ জেলার পোরশা, সাপাহার এবং নিয়ামতপুর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কমপক্ষে ৪৭ মিটার উঁচু।

তবে একই জেলাগুলোতে এমন কিছু অঞ্চল রয়েছে, যেগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১০ মিটার উঁচু উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ধান চাষের জন্য কেবল ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার এই উঁচু ও শুকনো অঞ্চলে পানীয় জল দুষ্প্রাপ্য করে তুলতে পারে।’

বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ধান উৎপাদনকারী দেশ বাংলাদেশে সেচের জন্য যে পানি ব্যবহার হয়, তার ৭৫ শতাংশই মাটির নিচ থেকে তোলা।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাব বলছে, এক কেজি বোরো ধান উৎপাদন করতে প্রায় তিন হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। ‘চালকলগুলোতে যে পানির ব্যবহার হয় তা এই হিসাবের বাইরে রাখা হয়েছে,’ বলেন অধ্যাপক চৌধুরী।

তিনি জানান, গম ও ভুট্টায় প্রতি কেজি উৎপাদনে প্রায় ৪০০-৬০০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়। তার মতে, বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচের জন্য ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহার করা উচিত। এ ছাড়া কম সেচ লাগে এমন ফল এবং সবজি চাষ এই অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানি খাবার জন্য সংরক্ষণে সহায়তা করতে পারে।

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশিদ জানান, গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে এই অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর মাত্র ৩০ ফুট নিচে ছিল, তখন কৃষকরা সেচের জন্য শুধু নদী, খাল-বিল, হ্যান্ড টিউবওয়েল ও বৃষ্টির পানি ব্যবহার করতেন।

নব্বইয়ের দশকে বিএমডিএ গভীর নলকূপ স্থাপন করার সঙ্গে সঙ্গে কৃষকরা বছরে তিনটি ফসলের চাষ শুরু করেন। ফলে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল দেশের অন্যতম প্রধান শস্য উৎপাদনকারী অঞ্চলে পরিণত হয়। কিন্তু বিএমডিএর কার্যক্রম অনুসরণ করে সচ্ছল কৃষক, ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা নিজস্ব গভীর নলকূপ স্থাপন করতে শুরু করেন।

২০১২ সালে যখন বিএমডিএ নতুন করে গভীর নলকূপ স্থাপন করা থেকে সরে এসে ভূপৃষ্ঠের পানির দিকে মনোনিবেশ করতে শুরু করে, বেসরকারি গভীর নলকূপের ব্যবহার কৃষি ও শিল্পে ব্যবহারের জন্য প্রসারিত হতে থাকে।

সম্প্রতি বিএমডিএর এক হিসাব অনুযায়ী, বরেন্দ্র অঞ্চলের বার্ষিক ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের পরিমাণ ১৩ হাজার ৭১০ মিলিয়ন ঘনমিটার, যার প্রায় ৭০ শতাংশই বেসরকারি গভীর নলকূপ দিয়ে উত্তোলিত হচ্ছে।

প্রকৌশলীদের হিসাব অনুযায়ী, এ পরিমাণ পানি এক বিঘা আয়তনের দুই মিটার গভীরতাবিশিষ্ট ১৮ লাখ পুকুর ভরে ফেলার জন্য যথেষ্ট। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নাচোল উপজেলায় ভূপৃষ্ঠের ১০৭ ফুট নিচে রেকর্ড করা হয়েছিল, যা ২০০৫ সালে ছিল ৭৮.৮ ফুট। মাত্র ১৩ বছরে এখানে পানির স্তর ২৮ ফুট নিচে নেমে গেছে।

বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক রশিদ বলেন, ‘পানির স্তর নিচে নামা এখনো অব্যাহত আছে। প্রতি সেচ মৌসুমের শেষে পানির স্তরটি কখনো কখনো ১০৭ ফুট পর্যন্ত নিচে চলে যায়।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে এখনই সুচিন্তিত জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন। আমাদের প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার গভীর নলকূপ ছাড়াও নদী ও জলাশয়ের পানির কার্যক্রম রয়েছে কৃষকদের জন্য। নতুন করে পদ্মা, মহানন্দা আত্রাইসহ আরো ছোট কিছু নদীর পানি কৃষিকাজের জন্য ব্যবহারোপযোগী করার কার্যক্রম চলছে।