logo
আপডেট : ২৩ মার্চ, ২০২২ ০৯:৪৯
ঐতিহ্যের লাল চিনি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন কৃষকরা!
কামরুজ্জামান মিন্টু, ময়মনসিংহ ব্যুরো

ঐতিহ্যের লাল চিনি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন কৃষকরা!

তৈরি করা হচ্ছে লাল চিনি

কোনো ধরনের রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি ছাড়াই ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় কয়েক শ বছর ধরে কৃষকের হাতে সনাতন পদ্ধতিতে তৈরি হচ্ছে লাল চিনি। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মাধ্যমে সুস্বাদু এ চিনি উৎপাদন করে পরিবারের ভরণপোষণ করছেন কৃষকরা।

স্থানীয়রা জানান, লাল চিনি দিয়ে বানানো পিঠা, নাড়ু, মোয়া, ক্ষীর, মিঠাই খেতে বেশি সুস্বাদু। এ উপজেলায় এখনো নতুন জামাইকে লাল চিনির গরম ক্ষীর ও মোয়া দিয়ে আপ্যায়ন করার রেওয়াজ আছে। কিন্তু নানা কারণে ঐতিহ্যের এই আবাদ-উদ্যোগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন কৃষকরা। ইতোমধ্যে অনেক কৃষকই আবাদ পাল্টে ঝুঁকেছেন অন্য ফসলে।

মূলত দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পাইকাররা এই লাল চিনি কিনে নিয়ে বিক্রি করেন। তবে চিনির ন্যায্য দাম, শ্রমিক ও উন্নত চারার সংকট, সার ও কীটনাশকের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে বহু কৃষক আখের আবাদ বন্ধ কওে দিয়েছেন।

কৃষকরা জানান, আখ কেটে ইঞ্জিনচালিত মেশিন দিয়ে মাড়াইয়ের মাধ্যমে রস বের করা হয়। তারপর ৮ থেকে ১০টি চুল্লিতে বড় লোহার কড়াইয়ে রস জ্বাল দেওয়া হয়। কাঁচা রস ঘণ্টাখানেক জ্বাল দেওয়ার পর তা ঘন হয়। এরপর কড়াই নামিয়ে কাঠের তৈরি ডাং (হাতল) দিয়ে অনবরত নাড়তে হয়। একপর্যায়ে তা লাল চিনিতে রূপ নেয়।

সরেজমিনে রাধাকানাই ইউনিয়নের পলাশতলী (মধ্যপাড়া) গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, আখ থেকে রস সংগ্রহ করে চিনি উৎপাদন করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। আগুনের প্রচণ্ড তাপ তাদের শরীরে সয়ে গেছে। ফুটন্ত রসে ডাং দিয়ে দ্রুত নাড়ছেন। তবুও ক্লান্তির ছাপ নেই তাদের চোখে-মুখে। কষ্ট ভুলে আনন্দ-উল্লাসে লাল চিনি উৎপাদন করছেন তারা।

এ সময় কথা আব্দুল জব্বার নামে এক আখচাষির সঙ্গে। তিনি দৈনিক ভোরের আকাশকে জানান, এক সময় উপজেলার প্রায় সর্বত্র আখের আবাদ হতো। বর্তমানে লাল চিনির ন্যায্য দাম, উন্নত জাতের চারার অভাব, শ্রমিক সংকট, সার ও কীটনাশকের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে অনেকে আখ উৎপাদন থেকে সরে এসেছেন। কোনোরকমে পরিবারের ভরণপোষণসহ ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতেই লাল চিনি উৎপাদনের সঙ্গে এখনো সম্পৃক্ত রয়েছেন তিনি।

ফরহাদ মিয়া নামে আরেকজন জানান, এক কাঠা জমির আখে ৫০০ থেকে ৬০০ কেজি রস হয়। এসব রস থেকে ১৫০ থেকে ১৬০ কেজি লাল চিনি পাওয়া যায়। তবে বাজারে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না তারা। এ ছাড়া সরকারিভাবে কোনো সাহায্যও পান না। উপজেলায় একটি লাল চিনি গবেষণাগার স্থাপনের দাবি জানান তিনি।

স্থানীয় জমশের আলী নামে এক বৃদ্ধ বলেন, ‘লাল চিনি আমাদের ঐতিহ্য। গত পাঁচ বছর আগেও যেদিকে তাকিয়েছি, শুধু আখের ক্ষেত চোখে পড়েছে। বর্তমানে আখ চাষে কৃষকদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। লাল চিনির উৎপাদন ধরে রাখতে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।’

ফুলবাড়িয়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার মো. দেলোয়ার হোসেন দৈনিক ভোরের আকাশকে জানান, গত বছর ১ হাজার ২৪৫ হেক্টর জমিতে আখের আবাদ হয়েছে। এর আগের বছর ১ হাজার ২৪০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। প্রতিবছরই উন্নত জাতের আখ চাষ করা হয়। পাবনার ঈশ্বরদীতে অবস্থিত বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত বিএসআরআই-৪১ ও বিএসআরআই-৪২ উন্নত জাতটি সংগ্রহ করে কৃষকদের দেওয়া হয়। যা স্থানীয় জাতের চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ বেশি উৎপাদন হয়।

তিনি আরো জানান, কৃষকের হাতে তৈরি লাল চিনির গুণের কথা বলতে গেলে এটি শুধু মজাদারই নয়, স্বাস্থ্যসম্মতও বটে। যদি প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তারা এখানে বিনিয়োগ করেন, তা হলে কৃষকরা চিনি উৎপাদনে আরো উৎসাহিত হবেন এবং উৎপাদন বাড়বে।