কখনো ছিন্নভিন্ন, আবার কখনো টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে থাকে নিথর দেহ। শেয়াল, কুকুর ও পোকামাকড়ে কুরে কুরে খায় মরদেহ। এসব লাশের বেশির ভাগই অজ্ঞাত। নাম-পরিচয় নিয়ে চরম বেগ পেতে হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। পরিচয় অজ্ঞাত থাকায় লাশের সৎকার ও ময়নাতদন্ত নিয়েও থাকে জটিলতা। তবে পরিচিত লাশের বেলায় তেমন জটিলতা নেই।
৯ জানুয়ারি ২০১৭। ঘড়ির কাঁটায় সকাল সোয়া ৯টা। ৫ মিনিট আগেও জানত না স্কুল নয়, তাদের শেষ ঠিকানা হবে ওপারে। পৃথিবীর সুখ-শান্তি বুঝে ওঠার আগেই ট্রেনের চাকায় দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া প্রাইভেট কারেই থেমে যায় ছয় বছরের তালহা ও রিভার জীবন। সঙ্গে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তাদের দুজনের মা।
এমন এক কালো অধ্যায় নেমে আসে মো. বিদ্যুৎ মিয়ার পরিবারেও। সেদিন নিমিষেই এলাকাজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। হয়তো আজ ভুলে গেছে সবাই সেই মর্মান্তিক রেল দুর্ঘটনার কথা। তবে এখনো সেই যন্ত্রণা তাড়া করে বেড়ায় মো. বিদ্যুৎ মিয়াকে। তিনি বলেন, এখনো ঘুমাতে পারি না। স্ত্রী-সন্তানকে হারিয়ে সব হারিয়েছি আমি। মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয় ওদের জন্য। সবাই ভুলতে পারলেও আমি পারিনি। প্রিয়মুখগুলো কি চাইলেই ভুলে থাকা যায়?
গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অরক্ষিত রেল ক্রসিং দিয়ে গোয়ালবাথান গ্রামের মো. বিদ্যুৎ মিয়ার মালিকানাধীন ঢাকা মেট্রো গ৩৯-৩৬৮৯ নম্বরের প্রাইভেটকারে করে তার স্ত্রী সোনিয়া আক্তার (৩৫) ও ৬ বছর বয়সি ছেলে তালহা এবং তার চাচাতো ভাই রিপনের স্ত্রী লাকী (৩৩) ও তার ছয় বছর বয়সি মেয়ে রিভা স্থানীয় বাংলাদেশ খ্রিষ্টান মিশন স্কুলে যাওয়ার সময় কলিকাতাগামী মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেন প্রাইভেটকারটিকে ধাক্কা দিলে এক মাইল দূরে সোনাখালি ব্রিজে গিয়ে ছিটকে পড়ে। এ দুর্ঘটনায় প্রাইভেটকারের চালক মিনহাজসহ পাঁচ যাত্রী ঘটনাস্থলেই মারা যান।
বলছি, ট্রেনে কাটা লাশের কথা। এসব লাশের সৎকার করা হয় কীভাবে? একটি লাশের উদ্ধার থেকে শুরু করে ময়নাতদন্ত ও দাফন সম্পন্ন করতে কত টাকা খরচ হয়? টাকার অভাবে ময়নাতদন্ত ছাড়াই কি হয় দাফন? এমন সব ঘটনার ভেতরের আদ্যপ্রান্ত জানতে অনুসন্ধানে নামে ভোরের আকাশ। এর আগে জানতে হবে কী বলছে রেলওয়ে আইন?
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রেলওয়ে আইনের ১২ নম্বর ধারার ‘ঘ’ অনুযায়ী ট্রেনে কাটা লাশ ধর্ম ও জাতীয়তা অনুসারে দাফন বা দাহ করার জন্য ৮ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে! বর্তমানে একটি লাশ উদ্ধার করলে ১৪শ’ টাকা ডোমদের দিতে হয়। যে পুলিশ অফিসার ওই মামলাটি পরিচালনা করেন তাকে দেওয়া হয় ২ হাজার টাকা। লাশ উদ্ধার করে মর্গ পর্যন্ত পৌঁছাতে যানবাহন খরচ লাগে আরো প্রায় চার-পাঁচ হাজার টাকা। কখনো আবার দূরত্ব বুঝে যানবাহন খরচ দিতে হয় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে একেকটি লাশ উদ্ধার করে মর্গে পৌঁছানো পর্যন্ত কমপক্ষে আট থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। রেল দুর্ঘটনার অধিকাংশ লাশই টুকরো টুকরো হয়ে যায়। অজ্ঞাত থাকে অনেকের পরিচয়। অজ্ঞাত লাশগুলো আঞ্জুমানে মফিদুলে হস্তান্তর করা হলে তারা বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করে।
ট্রেনে কাটা পড়ে অজ্ঞাত লাশের পরিবহণ থেকে ময়নাতদন্ত পর্যন্ত কী পরিমাণ টাকা খরচ হয়, জানতে চাইলে বিমানবন্দর রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আলী আকবর ভোরের আকাশকে বলেন, এসব লাশের খরচ হিসেবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ দেয় মাত্র ১২শ টাকা। কিন্তু এতে খরচ হয় আরো অনেক বেশি। সেগুলো বহন করে থাকে তদন্তকারী কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, ট্রেনে কাটা লাশ বেশির ভাগ ছিন্নভিন্ন থাকে। সেগুলো উঠাতে ডোমদের দিতে হয় টাকা। আবার হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য ডোমদেরও টাকা দিতে হয়। লাশ বহনের জন্য আলাদা টাকা গুণতে হয়। সব মিলিয়ে একেকটি লাশ উদ্ধার করে মর্গে পৌঁছানো পর্যন্ত কমপক্ষে সাত থেকে আট হাজার টাকা খরচ হয়।
কোন আইনে চলছে রেলপথ?
রেলওয়ের তথ্য বলছে, দেড়শ বছরের পুরোনো সেই আইনে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে রেল কর্তৃপক্ষ। পুরোনো এই আইনটির সংশোধন বা আধুনিকীকরণ নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেই। ব্রিটিশ শাসনামলের ১৮৬১ সালের পুরোনো ও অবাস্তব আইনে আজও চলছে রেলওয়ে। এই আইনের ১২ নম্বর ধারা অনুযায়ী রেললাইনের দুই পাশে ২০ ফুটের মধ্যে নির্দিষ্ট লোকবিহীন কোনো সাধারণ মানুষ কিংবা গবাদি পশু প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ। লাইনের দুই পাশের ২০ ফুট এলাকায় সব সময়ই ১৪৪ ধারা জারি থাকে।
ওই সীমানার ভেতর কাউকে পাওয়া গেলে ওই আইনের ১০১ ধারায় গ্রেপ্তার করা যাবে। গবাদি পশু আটক করে তা বিক্রয় করে সেই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা দেওয়ারও কথা রয়েছে আইনটিতে। কিন্তু তার বাস্তবতা কি হচ্ছে?
সরেজমিন দেখা যায়, ২০ ফুট নয়, এক দম রেল লাইন ঘেঁষে চলাচল করছে মানুষ। লাইনের ওপর বসানো হয়েছে ভ্রাম্যমাণ দোকান। ট্রেন এলেই সরিয়ে ফেলা হয় ঝুড়ির দোকান। কিন্তু রেল আইনে বলা হয়েছে মানুষই নয়, গবাদি পশুও প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ। সেখানে কে শোনে কার কথা। বাস্তব চিত্র দেখে মনে হচ্ছে, শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ রেলওয়ে আইন। বাস্তবে লেশমাত্রও নেই এর প্রয়োগ।