বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জল অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) ২০২২ পেলেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হকের পিতা মরহুম অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সফরে দেশের বাইরে থাকায় তাঁর ভাগনে (বোনের ছেলে) ব্যারিস্টার শেখ মো. ইফতেখারুল ইসলাম আজ ঢাকায় আয়োজিত স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২২ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে মরহুম সিরাজুল হকের পক্ষে পুরস্কার গ্রহণ করেন।
জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এ বছর দেশের ৯ বিশিষ্ট ব্যক্তি ও দুই প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করে সরকার। এদের মধ্যে মরহুম সিরাজুল হক একজন।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, মরহুম সিরাজুল হকের পৈত্রিক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলাতে হলেও পিতার কর্মসূত্রে তিনি ১৯২৫ সালের ১ আগস্ট সাতক্ষীরা জেলায় জন্ম গ্রহণ করেন।
তিনি খুলনা জিলা স্কুল থেকে এসএসসি, কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুনরায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন।
মরহুম সিরাজুল হক মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনসহ স্বাধিকার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুথান ও মহান মুক্তিযুদ্ধে অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করেন।
বঙ্গবন্ধু ও মরহুম সিরাজুল হক কলকাতায় একজন ইসলামিয়া কলেজে এবং অন্যজন প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তেন এবং এক সঙ্গে বেকার হোস্টেলে থাকতেন।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে তৎকালীন কুমিল্লা জেলার কসবা-বুড়িচং নির্বাচনী এলাকা থেকে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসাবে এমএনএ নির্বাচিত হন।
বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে মরহুম সিরাজুল হক আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতপূর্বক মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যান এবং সেই থেকে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের একজন অন্যতম সংগঠক হিসেবে নিরলসভাবে কাজ করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরতে বাংলাদেশের যে প্রতিনিধিদল নিউইয়র্কে জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধির সাথে দেখা করেন তার অন্যতম সদস্য ছিলেন মরহুম সিরাজুল হক।
১৯৭২ সালে গঠিত গণপরিষদের সংবিধান কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন মরহুম সিরাজুল হক। তিনি ১৯৭৩ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কসবা ও আখাউড়া নিয়ে গঠিত তৎকালীন কুমিল্লা-৪ (বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া- ৪ কসবা-আখাউড়া) আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৭৫ সালের অক্টোবরে বঙ্গভবনে খুনি খন্দকার মোশতাক তৎকালীন এমপিদের নিয়ে এক বৈঠকের আয়োজন করেন। ওই বৈঠকে মরহুম সিরাজুল হক প্রথম ব্যক্তি হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি বলা যায় না মর্মে দ্বিধাহীন চিত্তে ঘোষণা করেন।
মরহুম সিরাজুল হক উপমহাদেশের প্রখ্যাত আইনজীবী ছিলেন। তিনি ১৯৫৭ সালের ৮ জানুয়ারি হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে সনদ লাভ করেন। পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং তদপরবর্তীতে সিনিয়র আইনজীবী হিসাবে সনদ লাভ করেন।
তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ ১৯৫৮ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যত মামলা হয়েছে তার বেশির ভাগেরই আইনজীবী ছিলেন। ১৯৮২ সালে তিনি সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। মার্শাল ল'র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোয় ১৯৮২ সালের ১০ অক্টোবর তাঁকে তৎকালীন সরকার গ্র্রেফতারপূর্বক কারাগারে প্রেরণ করেন।
তিনি ১৯৯৬ সাল থেকে আমৃত্যু বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা এবং জেল হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের Chief Special Prosecutor ছিলেন। তিনি ২০০২ সালের ২৮ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জল অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মরহুম সিরাজুল হককে স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) ২০২২ প্রদান করা হয়।
ব্যক্তিগত জীবনে সিরাজুল হক বেগম জাহানারা হক এর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ছিলেন দুই পুত্র ও এক কন্যার জনক। বর্তমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক তাঁর বড় পুত্র।
সিরাজুল হকের ছোট পুত্রের নাম মরহুম আরিফুল হক রনি এবং একমাত্র কন্যা মরহুমা সায়মা ইসলাম। সিরাজুল হকের সহধর্মিণী বীর মুক্তিযোদ্ধা বেগম জাহানারা হক ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। তাঁকেও বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।