logo
আপডেট : ২৪ মার্চ, ২০২২ ১৫:০১
শিল্প ও বাণিজ্য ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়ের নীতি
নিজস্ব প্রতিবেদক

শিল্প ও বাণিজ্য ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়ের নীতি

উন্নয়ন এবং উৎপাদনে সবাইকে একাত্মবোধের মূল্যবোধে উজ্জীবিত করাও সামগ্রিক সামষ্টিক ব্যবস্থাপনার একটা অন্যতম উপায় ও উপলক্ষ

উন্নয়নশীল দেশসমূহের জাতীয় নেতৃত্ব যখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নে ইনকর্পোরেট ধারণা বা প্রেরণাকে ব্যবহার করতে চাইছেন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়ন সম্ভাবনার সমাজে অনুরূপ চিন্তাচেতনার বিকাশ ও প্রচেষ্টার পরিবেশ আজ কোন পর্যায়ে? এখানে একটি ভালো সংগীত সৃষ্টিতে গীতিকার, সুরকার, গায়ক ও বাদ্যযন্ত্রীর সমন্বিত প্রয়াস যেমন অপরিহার্য, তেমনি দেশ বা সংসারের সামষ্টিক অর্থনীতির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সব পক্ষের সহযোগিতা ছাড়া সুচারুরূপে সম্পাদন সম্ভব নয়। আধুনিক শিল্প ও বাণিজ্য ব্যবস্থাপনার বেলাতেও এমনকি যেকোনো উৎপাদন ও উন্নয়ন উদ্যোগেও ভূমি, শ্রম ও পুঁজি ছাড়াও মালিক-শ্রমিক সব পক্ষের সমন্বিত ও পরিশীলিত প্রয়াসই সব সাফল্যের চাবিকাঠি বলে বিবেচিত হচ্ছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রমের দ্বারা দক্ষতা ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি ছাড়াও সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়াসকে, সমাজবিজ্ঞানীরা যাকে ‘কর্পোরেট কালচারের প্রেরণা’ হিসেবে শনাক্ত করেন, সেখানেও সুসমন্বয়ের আবশ্যকতা অপরিহার্য। স্থান-কাল-পাত্রের পর্যায় ও অবস্থান ভেদে উন্নয়ন এবং উৎপাদনে সবাইকে একাত্মবোধের মূল্যবোধে উজ্জীবিত করাও সামগ্রিক সামষ্টিক ব্যবস্থাপনার একটা অন্যতম উপায় ও উপলক্ষ।


বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নকামী কল্যাণমুখী অর্থনীতিতে সব পক্ষকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন এবং সব প্রচেষ্টায় সমন্বয়ের মাধ্যমে সার্বিক উদ্দেশ্য অর্জনের অভিপ্রায়ে অয়োময় প্রত্যয়দীপ্ত হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টির আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। একজন কর্মচারীর পারিতোষিক তার সম্পাদিত কাজের পরিমাণ বা পারদর্শিতা অনুযায়ী না হয়ে কিংবা কাজের সফলতা-ব্যর্থতার দায়-দায়িত্ব বিবেচনায় না এনে যদি দিতে হয় অর্থাৎ কাজ না করেও যদি কেউ বেতন পেতে পারে, কিংবা তাকে বেতন দেয়া হয়, তাহলে দক্ষতা অর্জনের প্রত্যাশা আর দায়িত্ববোধের বিকাশভাবনা মাঠে মারা যাবেই। এ ধরনের ব্যর্থতার বজরা ভারী হতে থাকলেই যেকোনো উৎপাদন ব্যবস্থা কিংবা উন্নয়ন প্রয়াস ভর্তুকীর পরাশ্রয়ে যেতে বাধ্য। দারিদ্র্যপীড়িত জনবহুল কোনো দেশে পাবলিক সেক্টর বেকার ও অকর্মন্যদের জন্য যদি অভয়ারণ্য কিংবা কল্যাণরাষ্ট্রের প্রতিভু হিসেবে কাজ করে তাহলে সেখানে ‘অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্ন’ স্বপ্নই থেকে যাবে। যদি বিপুল জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে পরিণত করা না যায়, উপযুক্ত কর্মক্ষমতা অর্জন ও প্রয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি না করে, তাহলে উন্নয়ন কর্মসূচিতে বড় বড় বিনিয়োগও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। চাকরিকে সোনার হরিণ বানানোর কারণে সে চাকরি পাওয়া এবং রাখার জন্য অস্বাভাবিক দেনদরবার চলাই স্বাভাবিক। দায়-দায়িত্বহীন চাকরি পাওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় থাকার ফলে নিজ উদ্যোগে স্বনির্ভর হওয়ার আগ্রহতেও অনীহা চলে আসে। মানবসম্পদ অপচয়ে এর চেয়ে বড় নজির আর হতে পারে না। দরিদ্রতম পরিবেশে যেখানে শ্রেণি নির্বিশেষে সবার কঠোর পরিশ্রম, কৃচ্ছ্র সাধন ও আত্মত্যাগ আবশ্যক সেখানে সহজে ও বিনা ক্লেশে কিভাবে অর্থ উপার্জন সম্ভব সেদিকেই ঝোঁক বেশি হওয়াটা সুস্থতার লক্ষণ নয়। ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব নিজেরাই যখন উৎপাদন বিমুখ আর শ্রমিক স্বার্থ উদ্ধারের পরিবর্তে আত্মস্বার্থ উদ্ধারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে শোষণের প্রতিভু বনে যায় তখন দেখা যায়, যাদের তারা প্রতিনিধিত্ব করছে তাদেরই তারা প্রথম ও প্রধান প্রতিপক্ষ। প্রচণ্ড স্ববিরোধী এই পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে উৎপাদন, উন্নয়ন তথা শ্রমিক উন্নয়ন সবই বালখিল্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।


মানুষের দায়িত্ব বোধের দ্বারা কর্তব্যকর্ম সুচারুরূপে সম্পাদনের মাধ্যমে সমাজ সমৃদ্ধি লাভ করে। আবার এই মানুষের দায়িত্বহীনতার কারণে সমাজের সমূহ ক্ষতি সাধিত হয়। মানব সম্পদ না হয়ে ‘সমস্যায়’ পরিণত হলে সমাজের অগ্রগতি তো দূরের কথা সমাজ মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি সভ্যতার বিবর্তনে সহায়ক হয়। মানুষের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ, সহিংস সন্ত্রাসী কার্যকলাপ কিংবা যুদ্ধ এবং মরণাস্ত্রের ব্যবহারে মানুষের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। মানবতার জয়গান মানুষই রচনা করে আবার মানবভাগ্যে যত দুর্গতি তার স্রষ্টাও সে। মানুষের সৃজনশীলতা, তার সৌন্দর্যজ্ঞান, পরস্পরকে সম্মান ও সমীহ করার আদর্শ অবলম্বন করে সমাজ এগিয়ে চলে। পরমত সহিঞ্চুতা আর অন্যের অধিকার ও দাবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার মাধ্যমে সমাজে বসবাস করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। অন্যের অন্যায়-অনিয়মের নজির টেনে নিজেদের অপকর্মের দৃষ্টান্তকে ব্যাখ্যার বাতাবরণে ঢাকার মতো আত্মঘাতী ও প্রবঞ্চনার পথ পরিহার করেই বরং সবার সহযোগিতা ও সমন্বিত উদ্যোগের আবহ সৃষ্টি করতে পারলে সমাজ নিরাপদ ও বসবাসযোগ্য হয়ে ওঠে। সমাজবিজ্ঞানীরা তাই মানুষের আর্থ-সামাজিক সার্বিক উন্নয়নকে দেশ-জাতিরাষ্ট্রের সব উন্নয়নের পূর্বশর্ত সাব্যস্ত করে থাকেন। সমাজের উন্নতি, অগ্রগতি ও কল্যাণ সৃষ্টিতে মানুষের সার্বিক উন্নতি অপরিহার্য শর্ত। আগে সমাজ, না আগে মানুষ- এ বিতর্ক সর্বজনীন। মানুষ ছাড়া মনুষ্য সমাজের প্রত্যাশা বাতুলতামাত্র। সুতরাং একেকটি মানুষের উন্নতি সবার উন্নতি, সমাজের উন্নতি।


অনাবশ্যক ব্যয় পরিহার করে উৎপাদন বৃদ্ধি চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সমন্বয় সাধনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে পুঁজি-ভূমি-শ্রমের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে মুনাফা অর্জন কোম্পানি ব্যবস্থাপনার অভীষ্ট লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। জাপানে শ্রমিক-মালিকের সম্পর্ক কোম্পানিগত প্রাণ। সেখানে শ্রমিক যাতে তার সর্বাধিক মনোযোগ কোম্পানির জন্য দিতে পারে সে জন্য স্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে সংসারের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব বহনের ভার। কোম্পানির কাজে সার্বক্ষণিক মনোযোগ দেবে স্বামী। সংসার চালানোর বিষয় নিয়ে অফিস থেকে বাসায় ফোন যাবে না- বাসা থেকে কোনো ফোন আসবে না কোম্পানিতে। জাপানে নারীদের চাকরি, ব্যবসা, প্রশাসন, রাজনীতিতে বড় একটা দেখা যায় না। তার কারণ সমাজ তাদেরকে সংসার চালানোর দায়িত্ব দিয়ে পুরুষদেরকে উৎপাদনকর্মে পূর্ণ মনোনিবেশে সহায়তা করার দায়িত্ব দিয়েছে। স্বামীর বেতনের টাকা মাস শেষে পারিবারিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলে যায়। স্ত্রী ওই হিসাব অপারেট করেন। সংসারের যাবতীয় খরচপাতি স্বামীর সম্মতিতে স্ত্রীর নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। স্বামী প্রতি সপ্তাহের শুরুর দিনে তার সাপ্তাহিক হাত খরচ বাবদ টাকা পেয়ে থাকেন। সেই টাকা দিয়ে পুরো সপ্তাহ তার চলতে হয়। সুতরাং স্বামীর পক্ষে অপব্যয় কিংবা বাড়তি খরচ করার কোনো সুযোগ সেখানে নেই। পারিবারিক সঞ্চয় এভাবে প্রথাগত ব্যবস্থাদির দ্বারা উৎসাহিত হচ্ছে। জাপানের নারীরা বাইরের কাজে তেমন অবদান রাখছেন না ঠিকই কিন্তু গৃহে যে দায়িত্ব তারা পালন করেন তার আর্থিক ও তাৎপর্য মূল্য অনেক বেশি।


জাপানে কলকারখানা কিংবা অফিস আদালতে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন হয় না। অর্থবছর শুরুর পরপরই একটি নির্দিষ্ট দিনে শ্রমিক-মালিক পক্ষ একত্রে বসে বিগত বছরের আয়-ব্যয়ের স্থিতিপত্র সামনে নিয়ে খোলাখুলি আলোচনায় বসে স্থির করে আগামী বছরে বেতন বেশি হবে, না কম হবে। ‘কোম্পানি টিকলে আমি টিকব’- এই নীতিতে বিশ্বাসী সবাই যার যার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে থাকে। কোম্পানির প্রেসিডেন্ট, তার স্ত্রী কিংবা তার ছেলেকে কোম্পানির কর্মকালীন সময় আলাদা করে শনাক্ত করা চলে না। কোম্পানির প্রেসিডেন্ট, তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে সবাই নিজেকে ওই কোম্পানির চাকুরে হিসেবে বিবেচনা করেন। বছর শেষে কোম্পানির নিট লাভ-লোকসান যা হয় তাই-ই তার প্রকৃত পাওনা। কোম্পানিতে বড় সাহেব, ছোট সাহেব বলে কোনো ভেদ-বিভেদ নেই। আছে কর্মক্ষমতা দক্ষতা আর দায়িত্ব অনুযায়ী শ্রেণিবিন্যাস। সেখানে একজন সাধারণ কর্মীরও অবদান রাখার সুযোগ আছে। কোম্পানির সার্বিক অগ্রগতির পেছনে পরামর্শ দেয়ার স্বীকৃতি আছে সবার। সনি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষ মরিতা সান তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, কোম্পানির প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিদিন সকালে অফিসে এসে প্রথমে তিনি পরিদর্শনে যান কারখানার টয়লেটগুলো। তিনি মনে করতেন, টয়লেট ও অন্যান্য আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রাখার দায়িত্বে যেসব শ্রমিক তাদেরও যথেষ্ট অবদান রাখার অবকাশ আছে উৎপাদনে। তিনি হিসেব করে দেখিয়েছেন, উৎপাদন শ্রমিকেরা অবসরে যখন টয়লেটে আসে তখন তা যদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পায় তখন তাতে তাদের মন প্রসন্ন হয়। সিটে ফিরে যেয়ে তারা আরো একনিষ্ট সহকারে উৎপাদনে মনোনিবেশ করতে পারে। ফলে উৎপাদনে উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায়। এভাবে দিনে যদি ১০০০ টেলিভিশন উৎপাদিত হয় কোনো কারখানায়, মরিতা সানের মতে, তার মধ্যে ন্যূনতম ৪টি টেলিভিশন উৎপাদন বেশি হয় উৎপাদন শ্রমিকের প্রসন্ন মন মানসিকতার কারণে। তিনি সবাইকেই উৎপাদনে যোগ্য অংশীদার হিসেবে স্বীকৃতি দিতেন। ফলে শ্রেণি ও পর্যায়ভেদে সবাই যার যার কাজ তা সুন্দর ও সুচারুরূপে সম্পাদন করে।


হোন্ডা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা নিজেই হোন্ডা মোটরসাইকেলের ডিজাইন করতেন গভীর রাতে। গভীর মনোনিবেশ সহকারে এ কাজ যাতে তিনি করতে পারেন সেজন্য তার স্ত্রী রাত জাগতেন তার সাথে। রাতে ফেরিওয়ালা মিষ্টি আলু বিক্রি করত সুন্দর সুরে গান করে। মিষ্টি আলু ফেরিওয়ালার গানের সুরে হোন্ডা সাহেবের মনোনিবেশে যাতে ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয় সেজন্য তার স্ত্রী ফেরিওয়ালার পুরো আলু কিনে নিয়ে তাকে ঘরে ফিরে যেতে অনুরোধ করতেন। এ হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি বলে বলীয়ান জাপানে পথিকৃৎদের প্রতিষ্ঠার কাহিনি। টয়োটা পরিবারের উত্থান একজন ব্যক্তির অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল। অনুসন্ধিৎসা ও গভীর নিষ্ঠা-অধ্যাবসায় সামান্য অবস্থা থেকে তিলে তিলে গড়ে ওঠা এক বিশাল শিল্প সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা। কোয়ালিটির প্রশ্নে কোনো আপস নেই- পরিবেশনে, মুনশীয়ানায়, আন্তরিকতায় কমতি নেই। ডিজাইন ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায় গভীর অভিনিবেশ সহকারে এমন সচেতন ও একাগ্রতার সমাহার ঘটানো হয়ে থাকে যে- উৎপাদনের প্রত্যেক পর্যায়ে অপচয়, বাতিল, পরিত্যক্তের পরিমাণ কমে আসে।


লেখক: সাবেক সচিব এবং প্রাক্তন চেয়ারম্যান, এনবিআর