ভয়াল ২৫শে মার্চ আজ। বাঙালি জাতির জীবনে ১৯৭১ সালের এই দিনের শেষে এক ভয়াল বিভীষিকাময় রাত নেমে এসেছিল। মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের পূর্বপরিকল্পিত অপারেশন সার্চ লাইটের নীলনকশা অনুযায়ী বাঙালি জাতির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা মুছে দেওয়ার চেষ্টায় গণহত্যা শুরু করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তারপর ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এসেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা, যা এ বছরই ৫০ বছর পূর্ণ করল। দিনটি ২৫শে মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হয় বাংলাদেশে। তবে একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নৃশংস গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি আজও। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সে সময় সংঘটিত নৃশংস গণহত্যাগুলোর নেই কোনো সঠিক পরিসংখ্যানও। এ নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণাও হয়নি স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছরে।
তবে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় ‘১৯৭১: গণহত্যা নির্যাতন আর্কাইভ জাদুঘর’-এর পক্ষ থেকে দেশের ৩৪টি জেলা জরিপে উঠে এসেছে প্রায় ১৮ হাজার গণহত্যার নিদর্শন। আরো আটটি জেলার কাজ সম্পাদনা পর্যায়ে রয়েছে। বাকিগুলোর কাজ চলমান রয়েছে বলে জানান, জাদুঘরের গবেষণা কর্মকর্তা মাসুদ রানা।
তিনি বলেন, জরিপের সঙ্গে সঙ্গে ডিজিটাল ম্যাপ তৈরির কাজও চলমান। ইতোমধ্যে জরিপ হওয়া জেলাসমূহের মধ্যে ১১টি জেলার ম্যাপ আপডেট করা হয়েছে। আরো ২০টির কাজ শেষ হলেও এখনো আপলোড করা হয়নি বলে জানান তিনি।
জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটি সূর্যাস্তের সময় জাসদ কার্যালয়ের সামনে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গণশহীদদের স্মরণে আলোক প্রজ্বালন করবে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি রাত ৮টা ৩০ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আলোক প্রজ্বালন কর্মসূচির আয়োজন করেছে। এছাড়া সেক্টরস কমান্ডার ফোরাম মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে মিরপুর জল্লাদখানা বধ্যভূমিতে মোমবাতি প্রজ্বালন এবং গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবিতে একই জায়গায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করবে সংগঠনটি।
এছাড়া আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকে গণহত্যা দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে শহীদদের স্মরণে আলোর মিছিল, সমাবেশের আয়োজন করেছে।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে গণহত্যার নির্দেশনামা তৈরি করে পাকিস্তানের দুই সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। এই নির্দেশনামার কোনো লিখিত নথি রাখা হয়নি। গণহত্যার সেই পুরো নির্দেশ মুখে মুখে ফরমেশন কমান্ডার বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো হয়। অনেক পরে, ২০১২ সালে, মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ‘আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওউন কান্ট্রি’ নামে একটি আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত সে আত্মজীবনীতে প্রথমবারের মতো অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়।
অপারেশন সার্চলাইট কীভাবে পরিকল্পিত হয়, ১৯৭১ সালের সে স্মৃতিচারণা করে খাদিম হোসেন রাজা লিখেছেন, ‘১৭ মার্চ, সকাল প্রায় ১০টা বাজে। টিক্কা খান আমাকে ও মেজর জেনারেল ফরমানকে কমান্ড হাউসে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে খবর পাঠান। খবর পেয়ে আমরা দুজন টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করি। গিয়ে দেখি, সেখানে জেনারেল আবদুল হামিদ খানও রয়েছেন।’
মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সেই রাতে সাত হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেপ্তার করা হয় আরো তিন হাজার লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয় তখন। পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সৈন্যদের গুলি ও নির্যাতনে বাড়তে থাকল মৃতের সংখ্যা। তারা জ্বালিয়ে দিতে লাগল ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট। লুট আর ধ্বংস যেন তাদের নেশায় পরিণত হল। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হল। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুনতাড়িত শ্মশান ভূমি।’
পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয় : ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানি জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের প্রক্রিয়া চলাকালে পাকিস্তানি সেনারা কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নাম দিয়ে নিরীহ বাঙালি বেসামরিক লোকজনের ওপর গণহত্যা শুরু করে। তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ সব সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা। এদিন দুপুরের পর থেকেই ঢাকাসহ সারা দেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। সকাল থেকেই সেনা কর্মকর্তাদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। হেলিকপ্টারযোগে তারা দেশের বিভিন্ন সেনানিবাস পরিদর্শন করে বিকেলের মধ্যে ঢাকা সেনানিবাসে ফিরে আসে।
ঢাকার ইপিআর সদর দপ্তর পিলখানাতে অবস্থানরত ২২তম বালুচ রেজিমেন্টকে পিলখানার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিতে দেখা যায়। মধ্যরাতে পিলখানা, রাজারবাগ, নীলক্ষেত আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনারা। হানাদার বাহিনী ট্যাঙ্ক ও মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল নেয়। সেনাবাহিনীর মেশিন গানের গুলিতে, ট্যাঙ্ক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে উঠে বিভীষিকাময়।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ কে নিয়াজির জনসংযোগ অফিসারের দায়িত্বে থাকা সিদ্দিক সালিক-এর ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থেও এ-সংক্রান্ত একটি বিবরণ পাওয়া যায়। সিদ্দিক সালিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জেনারেল নিয়াজির পাশেই ছিলেন। বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে অনুগত পাকিস্তানি হিসাবে পাক সামরিক জান্তার চক্রান্ত তিনি খুব কাছে থেকেই দেখেছেন। ২৫শে মার্চ, অপারেশন সার্চ লাইট শুরুর মুহূর্ত নিয়ে তিনি লিখেন ‘নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সামরিক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। এমন আঘাত হানার নির্ধারিত মুহূর্ত (এইচ-আওয়ার) পর্যন্ত স্থির থাকার চিহ্ন বিলুপ্ত হয়ে গেল। নরকের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেল।’
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সকল পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যান। সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের আগে ২৬ মার্চ (২৫শে মার্চ মধ্যরাতে) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যেকোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র লড়াই শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের নির্মমতার সাক্ষী গণহত্যার স্থান, বধ্যভূমি, গণকবর, নির্যাতনকেন্দ্র ও স্মৃতিফলক চিহ্নিত করে ডিজিটাল ম্যাপ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে খুলনায় স্থাপিত ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’। একটি পাইলট প্রকল্পের আওতায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১১টি জেলার স্মৃতিচিহ্ন চিহ্নিত করে ম্যাপটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
ডিজিটাল ম্যাপে যে ১১ জেলার একাত্তরের স্মৃতিচিহ্ন চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো হলো খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পাবনা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, যশোর, নড়াইল ও ফরিদপুর। যে ৮৩৪টি জিপিএস স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে গণহত্যা ৪৫৯, বধ্যভূমি ১৭৭, গণকবর ৯১ ও নির্যাতনকেন্দ্র ১০৭টি।