‘বাংলাদেশের বীর পুলিশ ভাইসব- সাড়ে সাত কোটি নিরস্ত্র বাঙালি আজ মরিয়া হয়ে ইয়াহিয়া খানের সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আমরা বাংলাদেশের সন্তান। আমরা বাঙালি। আমরা বাংলাদেশের পুলিশ। আমরা মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। জয় বাংলা-আবদুল খালেক।’
১৯৭১ সালে সারা দেশের পুলিশ সদস্যদের প্রতি তখনকার পুলিশপ্রধান আবদুল খালেক এভাবেই বাহিনীতে কর্তব্যরতদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। হাতে লেখা তিন পাতার এই চিঠিটি এখনো অক্ষত। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের এই গুরুত্বপূর্ণ দলিল সংরক্ষণ করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’-এ।
চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘দেশের সবখানে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গতে তোলার কথা। শাসন আর শোষণের বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে একটি স্বাধীন মাতৃভূমির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তিনি। নীল আকাশে লাল-সবুজের স্বাধীন পতাকা উড়বে, চোখেমুখে আর কল্পনার জগৎজুড়ে ছিল এমন স্বপ্ন। তাই মৃত্যুকে আর পরোয়া নয়। যুদ্ধ! প্রতিরোধ আর যুদ্ধ! মুক্তি সংগ্রামের যুদ্ধ’।
এখানেই শেষ নয়। জাদুঘরজুড়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বিশাল সংগ্রহশালা। যুদ্ধে সারা দেশে পুলিশ সদস্যদের ব্যবহার করা সবকিছুই এখানে স্থান পেয়েছে। আছে শহীদ পুলিশ সদস্যদের ব্যবহার করা পোশাকও। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালোরাত্রিতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে আক্রমণের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধে ব্যবহৃত থ্রি নট থ্রি রাইফেল, বেতারযন্ত্র, পাগলা ঘণ্টাসহ আছে অনেক কিছুই।
আছে মুক্তিসংগ্রামে পুলিশ সদস্যদের বীরত্বগাথা ইতিহাস। রয়েছে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের সময় ব্যবহার করা সার্চ লাইটসহ অস্ত্র। এছাড়াও আছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সংবাদচিত্রসহ নানা ইতিহাস। সবকিছুই যেন জীবন্ত হয়ে এখনো পাকিস্তানিদের বর্বরতার প্রতি অবিরাম ধিক্কার জানাচ্ছে। দেয়ালে সাঁটানো ছবিতে বীর শহীদরা যেন বারবার দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করে চলেছেন, ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’।
সবার জন্য উন্মুক্ত জাদুঘর
১৯৭১ সালে মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেওয়া পুলিশ সদস্যদের বীরত্বগাথা ইতিহাস সংরক্ষণে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এ কথা সাধারণ মানুষ খুব একটা জানে না। অনেকটাই নীরবে-নিভৃতে প্রতিষ্ঠানটি ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী হয়ে আছে। রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের একপাশে নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’।
দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত মুক্তিযুদ্ধের এই সংগ্রহশালা। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে ৫টা পর্যন্ত জাদুঘর খোলা থাকে। দুপুর ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত বিরতি। তবে শুক্রবার বিকেল ৩-৫টা পর্যন্ত খোলা রাখা হয়। প্রবেশ ফি ৫ টাকা। তবে স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। যেকোনো স্কুলের শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধের বিশাল এই সংগ্রহশালা বিনামূল্যে দেখার সুযোগ পাবে।
প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৩০-৩৫ জন দর্শনার্থী আসেন এখানে। তবে বিশেষ দিনে অর্থাৎ বিজয় দিবসসহ অন্যান্য দিবসে দর্শনার্থী তুলনামূলক বেশি হয়। বিশেষ করে মুক্তিসংগ্রামে শহীদ হওয়া বীর পুলিশ সদস্যদের পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজনরাই এখানে বেশি আসেন। এর বাইরে মুক্তিসংগ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই করে এখন বেঁচে থাকা পুলিশ সদস্যরাও মাঝেমধ্যে জাদুঘরে বেড়াতে আসেন।
জাদুঘরে কর্তব্যরতরা জানিয়েছেন, সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চারজন পুলিশ কনস্টেবল জাদুঘরের দায়িত্বে রয়েছেন। এর মধ্যে দুজন পুরুষ ও দুজন মহিলা। তারা বলছেন, প্রচারের অভাবে দর্শনার্থী আসেন না এখানে। ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার জাদুঘরের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চ লাইটের নামে রাজারবাগের পুলিশ লাইন্সে ঘুমন্ত পুলিশ সদস্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বর্বর পাকিস্তানি সেনারা। মেতে উঠেছিল নির্মম হত্যাযজ্ঞে। সেদিন নিহতের সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা হয় ১৭৪ জনের বেশি পুলিশ সদস্যকে রাজারবাগে হত্যা করা হয়েছিল।
সব মিলিয়ে প্রতিরোধে অংশ নিয়েছিলেন ১৪ হাজারের বেশি পুলিশ সদস্য। অথচ প্রচারের অভাবে রাজারবাগের ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’-এর খবর তেমন কেউ রাখেন না। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জাদুঘরের বাইরে শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভের শ্বেতপাথরে লেখা শহীদদের নামও মুছে যেতে বসেছে।
‘আমরা তোমাদের ভুলবো না...’
‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে/ বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা/ আমরা তোমাদের ভুলবো না/ আমরা তোমাদের ভুলবো না...’। সত্যিই দেশ রক্ষার প্রয়োজনে মুক্তিকামী জনতার সে দিনের বীরত্বগাথা ইতিহাস ভুলবার নয়। তাদের আত্মত্যাগ, সম্মুখ সমরযুদ্ধ, বীরত্বগাথা ইতিহাস এখনো যেন সবকিছু জীবন্ত হয়ে কথা বলছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পুলিশে দায়িত্বরত অবস্থায় দেশমাতৃকার প্রয়োজনে সেদিন যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হয়েছিলেন কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন এর সবকিছুই আছে জাদুঘরে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বরিশালে দায়িত্বরত পুলিশ সুপার গোলাম হোসেন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ২৯ মার্চ তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত হন। জাদুঘরের দেয়ালে বীর এই মুক্তিযোদ্ধার ছবিসহ ইতিহাস এখনো জ্বলজ্বল করছে। এএসডিও হিসেবে দায়িত্বরত অবস্থায় যুদ্ধে যোগ দেন পিরোজপুর মহকুমার ফয়জুর আহমেদ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে ৫ মে হত্যা করে।
নড়াইলে কর্মরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন পুলিশ ইন্সপেক্টর গোলাম রব্বানী। ২১ এপ্রিল তাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বন্দি করে। পরে যশোর সেনানিবাসে তাকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। তার ছবিসহ পুরো ইতিহাস লেখা আছে জাদুঘরে।
পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন আ. কাদের মিয়া। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ১ জুন তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এছাড়াও জাদুঘরে সংরক্ষণ করা আছে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পুলিশে কর্মরত এসপি মুন্সি কবীর উদ্দিন, আল মামুন, এসপি শাহ আবদুল মজিদসহ অনেকের ইতিহাস ও ছবি।
আতঙ্কের সার্চ লাইট
মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামের সঙ্গে সবাই পরিচিত। সবার কাছে একটি আতঙ্কের নাম ছিল অপারেশন সার্চ লাইট। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে আক্রমণের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন পুলিশ সদস্যরা। আক্রমণ আর পাল্টা আক্রমণের মুখে দীর্ঘ সময়জুড়ে চলে যুদ্ধ।
সেদিনের রণাঙ্গন থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যবহার করা অনেক কিছুই স্থান পেয়েছে এই জাদুঘরে। এগুলোর মধ্যে সার্চ লাইট অন্যতম। দূর থেকে শত্রুর উপস্থিতি ও অবস্থান দেখার জন্য এ লাইট ব্যবহার করত পাকিস্তানি সেনারা, যা রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সেও ব্যবহার করা হয়েছে।
বিশাল আকৃতির এই লাইটটি জাদুঘরের প্রদর্শনীতে রয়েছে। যা গণহত্যার অন্যতম দালিলিক প্রমাণ হিসেবে এ দেশের মানুষের কাছে মহাকালব্যাপী স্মরণীয় থাকবে। এ ছাড়া পাকিস্তানি বাহিনীর মর্টারশেল। রায়ট রাবার শেলও রয়েছে জাদুঘরে। আলাদা ধরনের বন্দুক দিয়ে ৯০ ডিগ্রি কোণে উত্তেজিত জনতার প্রতি রায়ট শেল নিক্ষেপ করা হতো।
জাদুঘরজুড়ে শহীদের স্মৃতি
জাদুঘরজুড়েই শহীদদের স্মৃতি চিহ্ন ও মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যবহারিক জিনিসপত্র সংরক্ষণ করা হয়েছে। আছে আলোকচিত্রসহ মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া নেতাদের ছবি ও পুলিশের দালিলিক বিভিন্ন চিঠিপত্র।
২৫শে মার্চ রাতে যে বেতার যন্ত্রটি ব্যবহার করে সারা দেশে পুলিশ সদস্যদের রাজারবাগ আক্রমণের খবর দেওয়া হয়েছিল তা যত্ন করে সংরক্ষণ করা হয়েছে জাদুঘরে। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রাজারবাগ পুলিশের হাতে প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হিসেবে ছিল সাধারণ থ্রি নট থ্রি রাইফেল। তাতে কি। কেউ ভীত ছিলেন না। সামান্য অস্ত্র নিয়েই দেশমাতৃকা রক্ষায় প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সবাই। সেই থ্রি নট থ্রি রাইফেল জাদুঘরে সযত্নে সংরক্ষণ করা হয়েছে। আছে এই রাইফেলে ব্যবহৃত গুলির খোসাও।
আছে পুলিশের ব্যবহৃত হ্যান্ড মাইক। পুলিশ সদস্য শহীদ আবদুস সামাদ ও মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের শ্বেতপাথরে খোদাই করা ফলক। নড়াইলে শহীদ ইন্সপেক্টর গোলাম রব্বানীর পুলিশের পোশাক রয়েছে এই জাদুঘরে। আছে মুক্তিযোদ্ধা কনস্টেবল মো. আবু সামাদের হেলমেট। স্বাধীন বাংলার প্রথম পুলিশপ্রধান ছিলেন আব্দুল খালেক।
তিনি যে চেয়ারে বসে মুক্তিযুদ্ধের সময় পুলিশ সদস্যদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন সেই চেয়ারটি জাদুঘরে সংরক্ষণ করা আছে। আছে তার ব্যবহার করা তলোয়ার। আছে শহীদ পুলিশ সদস্য কাদের মিয়ার কলম, রেঙ্কব্যাজ, রেল্ট, কলম।
অজ্ঞাত এক পুলিশ মুক্তিযোদ্ধার হেলমেট সংগ্রহ করা হয়েছে জাদুঘরে। যুদ্ধের সময় এই হেলমেটটি ব্যবহার করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সারা দেশে পুলিশ সদস্যদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যবহার করা নানা স্মৃতি এখনো সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।
ফয়জুর রহমানের হাতে লেখা ডায়েরি
নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের পিতা ফয়জুর রহমান ১৯৭১ সালে পিরোজপুরে পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। একপর্যায়ে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীন দেশের স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিলেও নিজ চোখে তা দেখে যেতে পারেননি তিনি। দেশপ্রেমিক এই মানুষটিকে বাঁচতে দেয়নি পাকিস্তানি দোসররা।
শত্রুর বিরুদ্ধে অন্যবদ্য সংগ্রামও চালিয়ে যেতে পারেননি তিনি। তবে নির্ভয়ে লড়েছেন। পুড়েছেন প্রতিরোধ আর প্রতিশোধের আগুনে। একপর্যায়ে ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় তাকে হত্যা করে পাকিস্তানি নরপিশাচরা। পরে তার লাশ শনাক্ত করা হয়। জাদুঘরে তার ব্যবহার করা হাতে লেখা ডায়েরি ও টেপ রেকর্ডার সংরক্ষণ করা হয়েছে।
কালের সাক্ষী ‘পাগলা ঘণ্টা’
রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে আক্রমণের মুহূর্তে তৎকালীন পুলিশ প্রধানের বডিগার্ড কনস্টেবল ‘আবদুল আলী’ লোহার পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে বিভিন্ন স্থান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পুলিশ সদস্যদের এক করে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছিল সেদিন। লোহার সেই পাগলা ঘণ্টা জাদুঘরে সংরক্ষণ করা রয়েছে। আছে চাকাওয়ালা মেশিনগানও।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আক্রমণের পর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের প্রশাসনিক ভবনে আগুন লাগিয়ে দেয়। ফলে দলিল-দস্তাবেজ সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়, যা পরবর্তীতে আর সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি।
‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব আমাদের’
১৯৭১ সালে এ অঞ্চলের পুলিশপ্রধান ছিলেন আবদুল খালেক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সব পুলিশ সদস্যের উদ্দেশে তিন পাতার চিঠি লিখেছিলেন, যা প্রতিটি ব্যারাকে পাঠানো হয়েছিল। এই চিঠির পর সারা দেশের পুলিশ সদস্য দেশপ্রেমে আরো উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।
সবাই মিলে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রতিরোধ গড়ে তোলেন পাক হানাদারসহ দেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে।
চিঠির শুরুটা ছিল ঠিক এ রকম- ‘বাংলাদেশের বীর পুলিশ ভাইসব- সাড়ে সাত কোটি নিরস্ত্র বাঙালী আজ মরিয়া হয়ে ইয়াহিয়া খানের সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আমরা বাংলাদেশের সন্তান। আমরা বাঙালী। আমরা বাংলাদেশের পুলিশ। আমরা মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। জয় বাংলা- আবদুল খালেক’।
সাবেক পুলিশপ্রধানের হাতে লেখা তিন পাতার চিঠিটি জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। এদিকে আইজিপি আবদুল খালেক রেডিওতে দেওয়া ভাষণেও পূর্ব পাকিস্তানের ১৪ হাজার পুলিশ সদস্যকে কর্মস্থল ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
সার্জেন্ট মো. মর্তুজার কথা
১৯৬০ সালের ৬ আগস্ট ঢাকা জেলায় পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজারবাগে আক্রমণ করলে তিনি প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে অস্ত্র তুলে নেন। এর আগে তিনি রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের অস্ত্রাগারের ইনচার্জ সুবেদার আবুল হাশেম ও সুবেদার গোলাম মোস্তফাসহ অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে পুলিশ সদস্যদের মাঝে তা বিতরণ করেন। রাজারবাগে উত্তোলন করেন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। ৬ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন, পরে মুক্তিও পান।
রাজারবাগ আক্রমণের ইতিহাস
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনী অতর্কিতভাবে রাজারবাগ আক্রমণ করে। পুলিশ লাইন্স হাসপাতালের দক্ষিণ দিক থেকে পাকবাহিনী প্রথম গোলাবর্ষণ শুরু করে। এ সময় পুলিশ লাইনে উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তা ছিলেন না। সাধারণ পুলিশ সদস্যরা নিজেদের সিদ্ধান্তে সেদিন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।
দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা অস্ত্রাগার ভেঙে অস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধের যুদ্ধের সূচনা করেন। শুরু হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরযুদ্ধ।
পাকিস্তানিদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের মুখে মুক্তিবাহিনীর কাছে তখন থ্রি নট থ্রি (৩০৩) বন্দুকই ছিল একমাত্র ভরসা। তবুও দমে যাননি দেশপ্রেমিক ও অকুতোভয় যোদ্ধারা। পাল্টা জবাব দিতে ভুল করেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের কেউই। যুদ্ধের একপর্যায়ে শেষ রাতের দিকে গোলা ফুরিয়ে এলে পাকবাহিনী রাজারবাগ দখল করে নেয়।
তখন ঘাতক বাহিনী ব্যাপক লুটপাট চালায়। তারা আটকেপড়া পুলিশদের নির্মমভাবে হত্যা করে। পরবর্তীতে লাশ বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়। সুইপার রাবেয়াসহ অন্য নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায় পাক হানাদার বাহিনী। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চ লাইটের নামে ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আক্রমণ শুরু করে।
তারা একযোগে পিলখানার ইপিআর সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ ও ইকবাল হলে হত্যাযজ্ঞ চালায়। তৎকালীন ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার খবর মতে, ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণের পর পাক বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের দিকে অগ্রসর হয়।
প্রথমে পাক বাহিনীর ট্যাঙ্ক থেকে গোলা ছোড়ে। পরে কোয়ার্টারে ঘুমন্ত পুলিশ সদস্যদের ওপর পাশবিক হত্যাযজ্ঞ চালায়। সেই রাতে শহীদ হওয়া পুলিশ সদস্যদের সংখ্যা জানা না গেলেও খুব বেশি পুলিশ সদস্য পালিয়ে যেতে পারেননি। সেই যুদ্ধে ২০৪ জন পুলিশ কনস্টেবলের মধ্যে ৩০ জনকে পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় বাকিরা সবাই শহীদ হয়েছেন।
আক্রমণের খবর দেন শাজাহান মিয়া
২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ছিলেন কনস্টেবল শাজাহান মিয়া। ওয়ারলেস বেইজ স্টেশনের অপারেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। রাজারবাগ আক্রমণ হওয়ার খবর তিনি প্রথম বেতার মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে দেন। সেই রাতে তিনি হেডকোয়ার্টার্স বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে যুদ্ধ করেন। ভোর রাতের দিকে তার গোলাবারুদ শেষ হয়ে যায়।
পাকিস্তানি বাহিনী রাজারবাগে প্রবেশ করে চারদিক ঘিরে ফেলে। সকালে তিনি পাক বাহিনীর হাতে আহত হন এবং অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাকে। ২৮ মার্চ বিকেলে পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে মুক্তি পান তিনি। এরপর সিলেট, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধে অংশ নেন। বীর এই মুক্তিযোদ্ধা এখনো বেঁচে আছেন।
অবহেলিত বীর সন্তানদের নাম
জাদুঘরের ঠিক সামনে মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ বীর পুলিশ সদস্যদের স্মরণে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলার শহীদ পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা রয়েছে স্মৃতিস্তম্ভজুড়ে। কালো কালিতে শ্বেতপাথরে খোদাই করা বীর সন্তানদের অনেকেরই নাম এখন মুছে গেছে। কাছে গিয়েও দেখার উপায় নেই।
প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ার কারণেই এমন বেহাল দশা। সত্যিই বিষয়টি সবাইকে অবাক করে। সামান্য অবহেলায় মুছে যেতে বসেছে জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নাম। তা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত এ প্রশ্ন রয়েই গেল।