logo
আপডেট : ২৫ মার্চ, ২০২২ ১৩:০৯
প্রত্যক্ষদর্শীদের চোখে রাজারবাগের প্রতিরোধ যুদ্ধ
রাজন ভট্টাচার্য

প্রত্যক্ষদর্শীদের চোখে রাজারবাগের প্রতিরোধ যুদ্ধ

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট নামে যে সামরিক অভিযানে পরিকল্পিত গণহত্যা চালানো হয় রাজধানী ঢাকাজুড়ে, তার তিনটি লক্ষ্যবস্তুর একটি ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনস। এর বাইরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একযোগে আক্রমণ করেছিল পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভয়াল সেই রাতে একমাত্র রাজারবাগের বাঙালি পুলিশ সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

একইসঙ্গে ঢাকা আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ পুলিশের বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে সারাদেশের থানাগুলোতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পুলিশের বার্তায় জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, রাজারবাগের পুলিশ সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।

পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে ঢাকায় প্রথম গণহত্যা শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলার মূল লক্ষ্য ছিল দেশের সূর্য সন্তানদের হত্যা করা। আর রাজারবাগ ও ইপিআর সদর দফতরে হামলা করে স্বাধীনতাকামী বাহিনী সদস্যদের হত্যা করা। যেন তারা যুদ্ধের মাঠে অস্ত্র¿ ও প্রশিক্ষণ মেধা কোনোটাই আর কাজে লাগাতে না পারে। তারা ভেবেছিল এতে মুক্তিকামী মানুষের মনোবল আরো দুর্বল হবে। জয় হবে পাকিস্তানের।

রাত ১১টার দিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৩৭টি ট্রাক ক্যান্টনমেন্ট থেকে শহরের দিকে বের হয়। পুলিশের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বিষয়টি জানান ফার্মগেটে টহলরত পুলিশের একটি দল। সেসব ট্রাকের একটি অংশ আঘাত হানে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে।

যদিও ২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকেই নানাভাবে খবর আসছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে রাতের যে কোনো সময় হামলার ঘটনা ঘটতে পারে। এই খবর পেয়ে ভেতরে ভেতরে প্রতিরোধের প্রস্তুতি ছিল অনেক পুলিশ সদস্যদের। তারা প্রত্যেকেই পাকিস্তানের শোষণ আর বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন।

রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে হামলার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। সেই প্রতিরোধ যুদ্ধের কথা জনিয়েছেন চারজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যারা তখন পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। জীবনের মায়া ত্যাগ করে সেদিন দেশমাতৃকা রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধে দেড় শতাধিক পুলিশ সদস্য পাকিস্তানি সেনাদের হামলায় শহীদ হয়েছিলেন। সাত-আটটি ট্রাকে করে লাশগুলো উধাও করে পাকিস্তানিরা। বেঁচে থাকা ৪৬জন প্রতিরোধ যোদ্ধাদের মধ্যে এখন জীবিত আছেন ২১ জন।

শাহজাহান মিয়া ছিলেন ওয়্যারলেস অপারেটর। আবু শামা ছিলেন অস্ত্রাগারের দায়িত্বে একজন পুলিশ কনস্টেবল। আর আবদুল আলী পুলিশের তৎকালীন আইজি তসলিম উদ্দিনের বডিগার্ড, থাকতেন রাজারবাগে। তাদের সহকর্মী ছিলেন আবুল ফারুক।

তারা চারজনই জানান, ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পরই ভেতরে ভেতরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি চলছিল। ২৫ মার্চ বিকেল থেকেই রাজারবাগের আশপাশের সড়কে ট্রাকে করে রেকি করে পাকিস্তানি বাহিনী।

প্রতিরোধ যুদ্ধের খবর জানান শাহজাহান মিয়া

‘ দ্য বেজ ফর অল স্টেশনস অব ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ, কিপ লিসেনিং ওয়াচ, উই আর অলরেডি অ্যাটাকড বাই পাকিস্তানি আর্মি, ট্রাই টু সেভ ইয়োরসেলফ ওভার’।

রাজারবাগে পাকিস্তানি সেনারা হামলার পর পুলিশের এই প্রতিরোধ যুদ্ধের খবর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সব থানায় এভাবেই পাঠিয়েছিলেন শাহজাহান মিয়া। তিনি বলেন, পুলিশের এই প্রতিরোধ যুদ্ধের খবর দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশের মুক্তিযোদ্ধারা অনুপ্রাণিত হন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে আক্রমণ হতে পারে এমন খবরে রাজারবাগের অস্ত্রাগার খুলে চার শতাধিক অন্ত্র নিয়ে পুলিশ সদস্যরা রাজারবাগসহ আশপাশের এলাকায় পজিশন নেয়। রাত সাড়ে ১১টায় দ্বিতীয় দফা পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে অস্ত্রাগারের সব অস্ত্র বিলি করা হয় পুলিশ সদস্যদের মধ্যে। রাত সাড়ে ১১টার কিছু পরে তারা রাজাররবাগের দিকে আসতে শুরু করলে পথেই প্রতিরোধের মুখে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী।

রাত ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে পাকিস্তানি বাহিনী চামেলিবাগে প্রথম পুলিশ ব্যারিকেডের মুখে পড়ে। সেখানেই দুই পাকিস্তানি সেনা পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। এটাই ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রথম বুলেট। আমি এবং ওয়্যারলেস অপারেটর মনির তখন ওয়্যারলেস রুমে চলে যাই। সেখানে একটি ওয়্যারলেস বার্তা আমি লিখে তা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ১৯ জেলা, ৩৬টি সাব ডিভিশন এবং সব পুলিশ লাইনসে জানিয়ে দিই।

আমি বেশ কয়েকেবার ম্যাসেজটি ট্রান্সমিট করি। তখন চারদিকে হাজার হাজার গুলির শব্দ। আমরাও তখন অন্ত্র নিয়ে পুলিশ লাইনের চারতলার ছাদে চলে যাই’। সাড়ে তিন ঘণ্টায় আমাদের গুলি ফুরিয়ে যায়।

শাহজাহান মিয়া তার তিন ভাইকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। যুদ্ধ করেন ৯ নম্বর সেক্টরে। তার এক ভাই মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হন।

শাহজাহান বলেন, পাকিস্তানিরা বিদ্যুতের লাইন কেটে দিয়েছিল। জেনারেটর চালু করতে গিয়েও পারলাম না। প্রচণ্ড গোলাগুলিতে রাজারবাগে আগুনের ফুলকি উড়তে লাগল। আমি চারতলার ছাদে আশ্রয় নিয়েছিলাম। একটা থ্রি নট থ্রি নিয়ে লড়াই করে চলেছি। ফজরের আজান পর্যন্ত আমিসহ ১০০ জনের মতো পুলিশ টিকেছিলাম। ভোর ৫টার দিকে আমাদের ঘিরে ফেলে বন্দি করে পাকিস্তানি আর্মি।

ভোরের দিকে পাকিস্তানিরা আট-দশটি ট্রাকে করে লাশ বের করে নিয়ে যায়। আমার ধারণা, অন্তত ১৫০ পুলিশ শহীদ হয়েছিল। আমরা ১৫০ জনের মতো বন্দি হলাম। ধারণা করি, এসব লাশ হয়তো নদীতে বা অন্য কোথাও ফেলা হয়েছিল। ২৯ মার্চ আমি যখন মিলব্যারাক পুলিশ লাইনসে যাওয়ার জন্য লোহারপুলে আসি, তখন ওই খালে আর বুড়িগঙ্গায় শত শত লাশ দেখেছিলাম।

অস্ত্রাগারের সামনে স্বাধীন দেশের পতাকা উত্তোলন করি- আবু শামা

রাজারবাগে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের একজন আবু শামা। বাড়ি কিশোরগঞ্জে। সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বীর এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ৯টার দিকে আমরা রাজারবাগ অস্ত্রাগারের সামনে স্বাধীন বাংলাদেশের পাতাকা উত্তোলন করি। স্লোগান দেই বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

তখন অস্ত্রাগারের দায়িত্বে থাকা সুবেদার আবুল হাসেম অস্ত্রাগারে তালা মেরে চাবি আর আই মফিজ সাহেবের কাছে রেখে পালিয়ে যান। আমরা খবর পাই ক্যান্টনমেন্ট থেকে সেনাবাহিনী বের হয়েছে। তখন আমরা মফিজ সাহবেবের বাসায় দৌড়ে গিয়ে চাবি নিয়ে আসি। তিনি চাবি দিতে চাননি। আমরা জোর করে চাবি এনে অস্ত্রাগার খুলে দিই।

সেদনি রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনার ইতোমধ্যে কেটেছে ৫০ বছর। ‘বাংলাদেশ’ জন্মের সূবর্ণজয়ন্তী পালিত হয়েছে। জীবন থেকে চলে গেছে দীর্ঘ সময়। অনেক ঘটনার ভিড়ে তবুও যেন ’৭১ এর ঘটনাপঞ্জি স্মৃতিতে জীবন্ত হয়ে আছে আজো’।

বলেন, ২৫ মার্চ কালো রাতে অস্ত্রাগার থেকে রাইফেল নিয়ে সবাই পজিশনে চলে যাই। অস্ত্রাগার তালা মেরে দেওয়া হয়। রাত সাড়ে ১১টার দিকে আমাদের ওপর যখন চূড়ান্ত আক্রমণ শুরু হয় তখন আমরা পাগলা ঘণ্টা বাজাই। বাকি যারা ছিলেন তারাও বের হয়ে এসে অস্ত্রাগার ভেঙ্গে বাকি অস্ত্র হাতে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা আমরা প্রতিরোধ চালিয়ে যাই। প্রাণপন লড়াই করি।

এই সময়ে পাকিস্তানি বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ভেতরে ঢুকতে পারেনি। সাড়ে তিন ঘণ্টায় আমাদের গুলি ফুরিয়ে যায়। শত্রুপক্ষকে আক্রমনের প্রধাণ হাতিয়ার গুলি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর চারটি ব্যারাকে পাকিস্তানি বাহিনী আগুন ধরিয়ে দেয়’।

সেদিনকার প্রতিরোধকারী মুক্তিযোদ্ধা আবু শামা বলেন, ‘রাজারবাগে সেদিন ইস্ট পাকিস্তান প্রভিনসিয়াল রিজার্ভ ফোর্সের (ইপিপিআরএফ) সাড়ে তিনশ এবং আমাদের স্পেশাল আর্মড ফোর্সের (এসএএফ) ৫০০ থেকে ৬০০ পুলিশ ছিল। আমরা রাত থেকেই প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করি। ভারী অস্ত্রের কাছে আমরা টিকতে পারলাম না। ভোরে গ্রেপ্তার হলাম। আমার মনে আছে, ফজরের নামাজের পর পাকিস্তানি সেনারা আট-দশটা ট্রাকে করে নিহত পুলিশ সদস্যদের লাশ নিয়ে গিয়েছিল।

আবু শামা ৩ নম্বর সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে গুরুতর আহত হন। গুলিবিদ্ধ হন তিনি। খবর পেয়ে বাজিতপুর থানার দৌলতপুর গ্রামে তাকে দেখতে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। তিনি ডাক্তারদের যে কোনো মূল্যে আমাকে বাঁচানোর নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন তাকে তো সারিয়ে তুলতেই হবে।

তিনি জানান, যুদ্ধে যাওয়ার অপরাধে আমাদের পুরো গ্রাম তিনবার জ¦ালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাবাকে বারবার নির্যাতন করেছিল দেশীয় রাজাকারসহ পাকিস্তানি সেনারা। বাবা আবদুর রশিদ ভূঁইয়াকে বারবার নির্যাতন করায় তিনি সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন, যতটা কষ্ট পাননি পাকিস্তানি সেনারা নিজের ওপর করা অত্যাচারেও। বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তৎকালীন কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক জি আকবর খানের হাতে অস্ত্র জমা দিয়েছেন যুদ্ধাহত এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

আমরা ৩০৩ রাইফেল দিয়ে জবাব দিই- আবদুল আলী

মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন পুলিশ বাহিনীর প্রধানের বডিগার্ড ছিলেন আবদুল আলী। ১০৭১ সালের ২৫ মার্চ ভয়াল কালো রাত্রির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, রাত ১১টা ৩০ মিনিটে আমি বঙ্গবন্ধুর ছেলের (শেখ কামাল) মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা পাই। আর তখন পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে ফোর্স জমায়েত করি। তখন চাবি না পেয়ে রাইফেল দিয়ে অস্ত্রাগারের তালা ভাঙা হয়। আমি নিজেই অস্ত্রাগারে ঢুকে সহকর্মীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিই। রাত সাড়ে ১২টার দিকে রাজারবাগের কাছে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পৌঁছে যায় তখন আমরা রাজারবাগ থেকে গুলি ছুড়ে যুদ্ধ শুরু করি। তারা কামান ও ট্যাংকের গোলা ছোড়ে জবাব দিতে থাকে। আমরা ৩০৩ রাইফেল দিয়ে পাল্টা জবাব দেই।

এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ২৬ মার্চ ভোরে পাকিস্তানি বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ভেতরে প্রবেশ করে। তখন পুলিশ লাইনসের চারতলা ভবনের ছাদে পানির ট্যাংকের নিচে আমরা অনেকে লুকিয়ে ছিলাম। আরো বিভিন্ন জায়গায় ২০ থেকে ২৫ জনকে পায় তারা। বাকিরা বাইরে চলে যেতে সক্ষম হয়। আমাদের আটক করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নির্মম নির্যাতন করা হয়। অনেক পুলিশ সদস্যদের লাশ পরে থাকতে দেখি। ১৫০-এর মতো পুলিশ সদস্য প্রাণ হারান।

আবদুল আলী বলেন, আমাদের ২৮ মার্চ পর্যন্ত বন্দি রাখা হয়। এই সময়ে কোনো খাবার, এমনকি পানিও দেওয়া হয়নি। এরপর আমাদের ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার ই এ চৌধুরীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। আমাদের সেখান থেকে ছেড়ে দিয়ে একটি নির্দিষ্ট দিনে কাজে যোগ দিতে বলা হয়। আমরা তা করিনি। সবাই মিলে পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেই।

আবদুল আলী ভারতের মেঘালয়ে প্রথমে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। এরপর ময়মনসিংহ এলকায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। আবদুল আলীকে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। আবদুল আলী বলেন, ‘১৯৭৭ সালে জিয়ার সময়ে স্পেশাল মার্শাল ল’ ট্রাইবুন্যালে আমাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। ২৫ মার্চ রাজারবাগে পাগলা ঘণ্টা বাজান, অস্ত্রাগার ভাঙা এসব অপরাধে আমাকে তখন ফাঁসিতে ঝোলানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়। পরে চাকরিচ্যুতির শর্তে আমি প্রাণে বেঁচে যাই।’

পাখির মতো গুলি করেছিলাম পাকিস্তানের ওপর- আবুল ফারুক

নায়েক আবুল ফারুক তখন রাজারবাগে পরিদর্শকের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কাল রাত্রির অনেক স্মৃতি এখনো মনে আছে তার। বার্ধক্যজনিত কারণে কথা স্পষ্ট নয়। রাতে রাজারবাগে হামলার পর চোখ বন্ধ করে গুলি চালিয়েছেন তিনি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর জীবনবাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। প্রতিজ্ঞা ছিল, পাঞ্জাবিদের ছাড় নয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স ছিল ৩২। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় প্রথম আক্রমণ শুরু করে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে। সেই রাতে ব্যারাকে ঘুমাচ্ছিলেন তিনিসহ অনেকেই। পাকিস্তানি সেনাদের হামলার সময় মানুষের চিৎকার ও পাগলা ঘণ্টার শব্দে ঘুম ভাঙল। সবাই প্রতিরোধের জন্য তৈরি। দৌড়ে অস্ত্রাগার থেকে থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে তিনিসহ সহকর্মী ছালাম, জাহাঙ্গীরসহ কয়েকজন পুলিশ লাইনসের রেশন গেট এলাকায় অবস্থান নেন।

তখন পুরো এলাকা কাঁপছিল পাকিস্তানি সেনাদের অস্ত্রের দাপটে। তিনি বলেন, দূর থেকে দেখলাম আর্মিরা গুলি করতে করতে সামনের দিকে আসছে। আমাদের গেটের কাছে আসার পর আক্রমণ শুরু করি। চোখ বন্ধ করে গুলি। ১০টি গুলির বেশি থ্রি নট থ্রি রাইফেলে ভরা যেত না। অল্প সময়ের মধ্যে গুলি শেষ হয়ে যেত। আবারো ভরতাম।

এক পর্যায়ে রাজারবাগের টিনশেড ভবনে ওরা গান পাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে আমরা ভয় পাই। সবাই জীবন বাঁচাতে ছুটতে থাকে। দীর্ঘ সময় চলে যুদ্ধ। আগুন দেওয়ার পর মসজিদের দিকে যাই। সেখানেও আগুন দেখে ফ্যামেলি কোয়ার্টারের দিকে গেলাম। সেখানে ও অস্ত্রাগারের সামনে শক্তিশালী বোমা ছোড়ে পাকিস্তানি সেনারা। সবাই আতঙ্কিত তখন।

সেদিনের স্মৃতি থেকে তিনি আরো বলেন, হঠাত দেখতে পাই পুলিশ ব্যারাকের সামনের মাঠে নিহত পুলিশ সদস্য, সাধারণ মানুষ ও বাবুর্চিদের লাশ এনে জড়ো করছে পাঞ্জাবিরা। ভোরের আগে আগে দেয়ালের ওপর তাঁরকাটার বেড়া ডিঙিয়ে কোন রকমে পালাই। সেখান থেকে চামেলীবাগ পুলিশের রিজার্ভ অফিসে গিয়ে দেখি লোক নেই। পাকিস্তানিাক খুলে স্থানীয় একজনের দেয়া ছেঁড়া জামা ও লুঙ্গি পরি।

অস্ত্র ফেলে সেগুনবাগিচা হয়ে আলাউদ্দিন রোড দিয়ে হাজারো মানুষের লাইনে হাঁটতে থাকি। অনিশ্চিত গন্তব্য। হাতে কোনো টাকা নেই। রাস্তায় রাস্তায় মানুষের দেওয়া খাবার খেতাম। তখন বড়লোকরা খুব একটা এগিয়ে আসেনি। সাধারণ ও গরিব মানুষই বেশি সহযোগিতা করত। হেঁটে আটদিন পর মুন্সীগঞ্জ গেলাম।
হেলালসহ আরো দুই সিপাহী আমার সঙ্গে ছিলেন।

নদীতে মাঝিকে গিয়ে বললাম আমরা তিনজন বিপদে পড়েছি। তিন আনাও হাতে নেই। আমাদের পার করে দাও। মন গলল মাঝির। বলল সব মাপ। টাকা লাগবে না। তিনি আমাদের নদী পার করে বেলতলী উঠিয়ে দিলেন। সেই মাঝির কথা এখনো ভুলতে পারেননি ফারুক। এ কথা মনে হতেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন তিনি।

বললেন, মাঝির দেনা শোধ করা হোল না। দেখাও হলো না তার সঙ্গে। কানে বারবার ধ্বনিত হয় ‘মাপ’ কথাটি। তারপর আবারো পায়ে হেঁটে বাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার জমশেদপুরের বর্ণিল গ্রামের নিজ বাড়িতে গেলাম।

এবার ভিন্ন রকম বিপদ আবুল ফারুকসহ গ্রামবাসীর। স্থানীয় রাজাকাররা আক্রমণ করতে আসল। অনেকেই ভয় পেলেন। এগিয়ে গেলাম। সাহসি মানুষদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুললাম। সেদিন গণপিটুনিতে ছয়জন দেশীয় রাজাকারকে হত্যা করি।

কিছুদিন বাড়িতে থাকার পর ভারতের কৃষ্ণনগরে পুলিশ হেড কোয়ার্টারে চলে যাই। সেখানের পুলিশ কর্মকর্তা এম আই তালুকদার আমাদের জিজ্ঞেস করলেন যুদ্ধে যাব কিনা। সবাই হ্যাঁ বললাম। আমরা এক প্লাটুন লোক ট্রেনিং শেষে এক নম্বর সেক্টরে যোগ দেই। জুন-জুলাই মাসে নোয়াখালীর বেলুনিয়াসহ আশপাশের এলাকায় যুদ্ধ করি।

নভেম্বর মাসে ফেনী নদীর ওপর ঝুলন্ত ব্রিজ রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমাদের এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীকে খুব একটা প্রবেশ করতে দেইনি। এই এলাকা কার্যত মুক্ত ছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারে যারা গ্রাম ছেড়েছিলেন ১৬ ডিসেম্বর দেখি তারা ফিরে আসছেন। পাকিস্তানি সেনারা গাড়ি নিয়ে ঢাকার দিতে যাচ্ছিল। মুখে মুখে রটে গেল পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণ ও দেশ স্বাধীন হওয়ার কথা।

তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের পর চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে অস্ত্র জমা দেই জানুয়ারি মাসে। ২১ জানুয়ারি ঘোষণা আসে ১০ দিন ছুটি শেষে পুলিশে যোগ দেওয়ার। ফেব্রুয়ারিতে যোগ দেই। ১৯৯৮ সালে ইন্সপেক্টর পদে অবসরে যান আবুল ফারুক।

যুদ্ধের সময় বহুবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। বিশেষ ঘটনা হিসেবে তিনি বলেন, ছাগলনাইয়া এলাকার ফরিমাটিলা এলাকায় একবার সাধারণ মানুষের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম অত্যাচার চলছিল। মানুষের আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে উঠছিল আকাশ বাতাস।

বাঁচার আকুতি করছিলেন অনেকে। তখন পাষণ্ডরা হাসছিল। এসব দেখে সহ্য করতে পারিনি। গোয়েন্দাগিরির সময় এ চিত্র চোখে পড়ে। একা চললেও শরীরে অস্ত্র লুকিয়ে রাখতাম। এক পর্যায়ে পাকিস্তানিদের ওপর গুলি চালাতে শুরু করি। বুলেট দিয়ে ওদের ঝাঁজরা করে দেই। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসি সেদিন।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আরো আগেই মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার শুরুর প্রয়োজন ছিল। বিলম্ব হয়ে গেছে। এতে ক্ষতিও হয়েছে অনেক। দেশবিরোধী শক্তির শেকড় এখন অনেক গভীরে। তিনি বলেন, যতদিন সব রাজাকারের বিচায় না হয়; ততদিন পর্যন্ত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কাজ চালিয়ে যেতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে কোনো রাজাকারের ঠাঁই হবে না।

ওদের সবাইকে খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। রাজাকারদের সন্তানদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বাতিলেরও দাবি জানান এই মুক্তিযোদ্ধা।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা মনে পড়লে উত্তরার বাসা থেকে ছুটে আসেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে। সবকিছু মনে করার চেষ্টা করেন। ব্যবসায়ী তিন ছেলের সঙ্গে রাজধানীর উত্তরার সাত নম্বর সেক্টরের সাত নম্বর বাসায় থাকেন তিনি। বছরে এক থেকে দুবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যান।

শহীদ পুলিশের রক্তের ঋণ বইয়ে বলা হয়েছে, ‘সেদিন আট শ পাকিস্তানি সেনা পুলিশ লাইনস আক্রমণ করে। রাজারবাগে পুলিশেরা প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করে থ্রি নট থ্রি দিয়ে। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনী একটু থমকে গেলেও ট্যাংক, মর্টার ও হেভি মেশিনগান নিয়ে গুলিবর্ষণ করে পুলিশ সদস্যদের হত্যা করতে থাকে।
একপর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের গুলি শেষ হয়ে গেলে জীবিত পুলিশ সদস্যরা যে যেভাবে পারে পালিয়ে যায়।’
অভিযান শেষে পরদিন ভোরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কক্ষ যখন ওয়্যারলেস বার্তায় রাজারবাগে পুলিশের মৃতের সংখ্যা জানতে চাইছিল, তখন বলা হয়, এখনো গোনা শেষ হয়নি। তবে সংখ্যা অনেক।

রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে সম্প্রতি পুলিশের একটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তৈরি করা হয়েছে। এতে ২৫ মার্চের ওই গণহত্যার নানা স্মৃতিচিহ্নসহ মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের অবদানের স্মারক স্থান পেয়েছে। ‘১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত ৩৩ হাজার ৯৯৫ জন পুলিশের মধ্যে প্রায় ১৪ হাজার সদস্য কর্মস্থল ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন ১১শ জনেরও বেশি পুলিশ সদস্য।