logo
আপডেট : ২৬ মার্চ, ২০২২ ১১:৩৩
বঙ্গবন্ধু, ৭ মার্চ ও স্বাধীনতা
নিজস্ব প্রতিবেদক

বঙ্গবন্ধু, ৭ মার্চ ও স্বাধীনতা

কেবলই ৯ মাস নয়; সুদীর্ঘ ২৩ বছরের আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু মুজিবের নেতৃত্বে বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষ স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছে

দেখতে দেখতেই কেটে গেল আমার জীবনের অর্ধশত বছর। আমি আর আমার দেশটা যে সমবয়সী! মুক্তিযুদ্ধের কথা এলেই যার নাম আগে নিতে হয় তিনি সেই মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর রয়েছে অনেক ত্যাগ, ত্যাগ রয়েছে বীর বাঙালির। শুধু ’৭১-এ এই যুদ্ধ হয়নি। স্বাধীনতার জন্য আরো বহু আগে থেকেই যুদ্ধে নামতে হয়েছে বাঙালি জাতিকে। যাদের বয়স ষাটোর্ধ্ব তারা দেখেছেন আর আমরা শুনেছি ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগকে বেশ ভালোভাবেই প্রস্তুত করে নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সাধারণ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হতে পারে সম্ভবত এ আশঙ্কা থেকেই ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন ইস্কান্দার মীর্জা। কিন্তু সামরিক জান্তার পুতুল ইস্কান্দার মীর্জাকে ক্ষমতা দখলের ২০ দিনের মাথায় দেশ থেকে বিতাড়ন করে প্রধান সেনাপতি জে. আইয়ুব খান সামরিক আইন জারির মাধ্যমে সর্বময় ক্ষমতা করায়ত্ব করেন। সে সময় শেখ মুজিবসহ পূর্ব পাকিস্তানের আরো অনেককে জেলে নেয়া হয়। নির্যাতন করা হয়। জেল থেকে মুক্তি লাভের পর সামরিক আইনের বেড়াজালের মধ্যেও মুজিব দলকে গোছাতে থাকেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৬৪ সালের ৫ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দলকে পুনরুজ্জীবিত করেন। শেখ মুজিব এ সময় একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি লাহারে পাকিস্তানের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি ৬ দফা পেশ করেন। মুজিব জানতেন, পাকিস্তান সামরিক চক্র ৬ দফা দাবি মেনে নেবে না। আর এ ৬ দফা দাবি এক দিন এক দফা অর্থাৎ স্বাধীনতার দাবিতে পরিণত হবে। মুজিবের ৬ দফা ১৯৬৬-এর মার্চে অনুষ্ঠিত দলীয় সম্মেলনে ইশতেহার হিসেবে গ্রহণ করা হয়। শেখ মুজিব এবং তার দলের নেতারা ৬ দফা দাবি প্রচারের জন্য সারাদেশ চষে বেড়ান। ৬ দফা পেশের পর প্রেসিডেন্ট আইয়ুব হুমকি দেন। শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে সামরিক জান্তা। ৬ দফা প্রচারকালে শেখ মুজিবকে বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় সারাদেশে আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগের শত শত নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হন। নির্যাতনের কাছে মাথা নত না করায় শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে।


১৯৬৪ সালের ১ জানুয়ারি নয়া ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হয়। ১৭ জানুয়ারি গভীর রাতে শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে এ ষড়যন্ত্র মামলায় নতুনভাবে গ্রেপ্তার দেখিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হলো। রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় ৩৫ জন আসামির ১ নম্বর আসামি করা হয় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে হত্যা করাই ছিল শাসকচক্রের মূল লক্ষ্য। আইয়ুব-মোনায়েম চক্রের এই উপর্যুপরি ষড়যন্ত্র ও নির্যাতনের কারণে আপসহীন শেখ মুজিব জেলে থেকেই বাংলার মুক্তিকামী মানুষের একক নেতায় পরিণত হন। এ সময় শেখ মুজিব ও রাজবন্দিদের মুক্তিসহ ১১ দফা দাবিতে ছাত্র-জনতা আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। জনতার কাছে নতি স্বীকার করে ১৯৬৯ এর ২২ জানুয়ারি তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের মাধ্যমে শেখ মুজিবসহ রাজবন্দিদের মুক্তি দেয়া হয়।


২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ সংবর্ধনা সভায় শেখ মুজিব ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হলেন। ১৯৬৯-এর ২৫ মার্চ দশ বছরের স্বৈরশাসনের ইতি ঘটিয়ে আইয়ুব খান পদচ্যুত হন এবং জে. ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারির মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতা দখল করেন। বাঙালির পূঞ্জীভূত ক্ষোভ ও চাপের মুখে জে. ইয়াহিয়া নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। ১৯৭০-এর ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন পেয়ে সারা পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ। ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি পায় বঙ্গবন্ধুর দল। পূর্ব বাংলার জনগণের প্রায় ৯৫ শতাংশ ভোট পেয়ে মুজিবের আওয়ামী লীগ নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করল। নির্বাচনের পর ৩ জানুয়ারি জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের রেসকোর্স ময়দানে শপথ গ্রহণ করান বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি শুরু করে। ২৬ মার্চ রাত ১টা ১০ মিনিটের দিকে একটি ট্যাংক, একটি সাঁজোয়া গাড়ি এবং কয়েকটি ট্রাক বোঝাই সৈন্য শেখ মুজিবের বাড়ির ওপর দিয়ে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে রাস্তা ধরে এগিয়ে আসে এবং তাকেসহ ৪ জন চাকর এবং একজন দেহরক্ষীকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তারা বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সীমানার পাশে লুকিয়ে থাকা এক সৈন্য প্রহরীকে খুন করে।


কেবলই ৯ মাস নয়; সুদীর্ঘ ২৩ বছরের আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু মুজিবের নেতৃত্বে বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষ স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছে। মূলত ১৯৭১ সালের ১ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত- এই ২৬ দিনেই বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছিল। ফলে কখন স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল বা কে তা ঘোষণা করেছিল এ প্রশ্নটি অবান্তর, অপ্রাসঙ্গিক এবং ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করার যে প্রবণতা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনাকে গ্রাস করেছে এটা তারই আরেকটি দৃষ্টান্ত; সত্যানুসন্ধান চিরায়ত ও সর্বজনীন প্রক্রিয়া। সত্যকে জানবার ও উদ্ঘাটনের প্রয়াসে মানুষ নিরন্তর নিয়োজিত, কিন্তু সত্যানুসন্ধান অত্যন্ত কঠিন কাজ। এ প্রয়াস প্রায়ই বিপথগামী হতে পারে আবেগ ও বিশ্বাসের কারণে। আর তাই হচ্ছে আমাদের দেশে। স্বাধীনতার এতটা বছর পরও চলছে স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে দ্বন্দ্ব। ঘোষণা তো ৭ মার্চেই হয়েছে। তবুও স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের।


১৯৭১-এ জাতি অর্জন করেছিল একটি জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত। স্বাধীনতা মানে ইচ্ছার স্বাধীনতা, রাজনীতির স্বাধীনতা এবং অবশ্যই অর্থনৈতিক মুক্তি। বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে স্পষ্টভাবেই উচ্চারণ করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’। এই মুক্তির সংগ্রামে জয়ী হওয়ার লক্ষ্যে আমাদের তরুণ প্রজন্ম একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামীদের মতোই স্বপ্ন ও সাহস নিয়ে এগিয়ে আসুক এটাই প্রত্যাশা।


লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক