logo
আপডেট : ২৭ মার্চ, ২০২২ ০৯:৫৫
টিপুকে যেভাবে হত্যা করা হয় 
রুদ্র মিজান ও ইদ্রিস আলম

টিপুকে যেভাবে হত্যা করা হয় 

জাহিদুল ইসলাম টিপু। ফাইল ছবি

মাত্র ৩০ সেকেন্ডে ১০টি গুলির মধ্য দিয়ে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যা করা হয়। পুরো কিলিং মিশন দেড় মিনিটের মধ্যেই শেষ করে দুর্বৃত্তরা। শুটারদের মধ্যে একজন মোটরসাইকেলে ছিল, আরেকজন খুব কাছ থেকে গুলি করেছে। তাদের মিশনের অভিজ্ঞতাই বলে দেয় তারা পেশাদার শুটার।

নিরাপত্তার ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঘটনাস্থলের পাশের একটি বহুতল ভবনের বাসিন্দা জানান, তিনি তখন ছয়তলার বেলকুনিতে ধূমপান করছিলেন। শাহজাহানপুরের আমতলা মসজিদসংলগ্ন ওই এলাকায় গাড়ি আটকে ছিল ট্রেনের সিগন্যালের কারণে। ওই যুবকের ভাষ্যমতে, তখন রাত ১০টা ২০-২৫ মিনিট হবে। হঠাৎ গুলির শব্দ শুনতে পান। সাদা রঙের নোয়াহ মাইক্রোবাসটিতে একজন খুব কাছ থেকে গুলি চালায়। তিনি বলেন, ‘আমার চোখের সামনেই ঘটে গেল টিপু হত্যার ঘটনা। হামলাকারী দৌড়ে গাড়ির সামনে গিয়ে খুব কাছ থেকে সামনের আসনে বসে থাকা ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে পরপর কয়েকটি গুলি করেন। ওই সময় গাড়ির জানালা লাগানো ছিল।’

তিনি আরো বলেন, ‘ঘটনাস্থল থেকে কিছুটা দূরে টিপুর লোকজন আড্ডা দিচ্ছিলেন। গুলির শব্দ পেয়ে অনেকেই তাৎক্ষণিক ভয় পেয়ে আতঙ্কে সরে যায় আবার কেউ কেউ এগিয়ে যান। পরে দেখেন সেই গাড়িতে ছিলেন তাদের নেতা টিপু ভাই।’

ঘটনাস্থল শাহজাহানপুরের আমতলা মসজিদ ও মানামা ভবনসংলগ্ন সড়ক। ঘটনাস্থলেরই পাশের ভবনে সাউথ ইস্ট ব্যাংকের শাখা। ওই ভবনের সিসি টিভি ফুটেজে দেখা গেছে, হত্যাকাণ্ডের পুরো দৃশ্য। ইতোমধ্যে ফুটেজ সংগ্রহ করে হত্যাকারীদের শনাক্তের চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ফুটেজে দেখা যায়, টিপুর মালিকানাধীন সাদা রঙের নোয়াহ মাইক্রোবাসটি জ্যামে আটকা পড়েছে। এর ঠিক ১০ সেকেন্ড আগে বিপরীত দিকের রাস্তা ধরে উল্টো পথে একটি মোটরসাইকেল আসতে দেখা যায়। মোটরসাইকেলটি শাহজাহানপুর রেলওয়ে হাফিজিয়া সুন্নিয়া আলিম মাদ্রাসা ও এতিমখানার সামনে গিয়ে ইউটার্ন নিয়ে আবার রাজারবাগের দিকে দাঁড় করে রাখেন চালক। এরই মধ্যে মোটরসাইকেলের পেছনে থাকা মাথায় হেলমেট ও কালো জামা পরিহিত ব্যক্তি সড়ক বিভাজক পার হয়ে রাস্তার মাঝখানে অবস্থান নেয়। এ সময় রাস্তায় কিছুটা জ্যাম থাকায় অন্যান্য গাড়ি ধীরগতিতে চলছিল। এর মধ্যেই ঘটে ঘটনা।

ফুটেজে দেখা গেছে, ১০টা ২৪ মিনিট ৫০ সেকেন্ডে টিপুর গাড়ির বাম দিক দিয়ে একদম গাড়ির কাছে গিয়ে প্রথম গুলি ছোড়া হয়। হঠাৎ এমন হামলায় কিছু বুঝে উঠার আগেই গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেন চালক। সামনেই রিকশার জট থাকায় গাড়িটি বেশি দূর যেতে পারেনি। তবে গাড়ি থেকে কিছুটা পিছিয়ে পড়ায় হামলাকারী দৌড়ে সামনে এসে খুব কাছ থেকে সামনের আসনে বসে থাকা ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে পরপর কয়েকটি গুলি ছোড়ে। ১০ সেকেন্ড সময় ধরে গুলি করে। পরে আশপাশে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে টিপুর গাড়ির সামনে দিয়েই আবার সড়ক বিভাজক পার হয়ে রাস্তার উল্টো পাশে মাদ্রাসার সামনে দাঁড়ানো মোটরসাইকেলের দিকে চলে যায় হত্যাকারী।

এ সময় টিপুর গাড়ির পাশ দিয়ে রিকশায় যাচ্ছিলেন বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রী প্রীতি। তিনিও গুলিবিদ্ধ হন। তাদের রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জাহিদুল ও প্রীতিকে মৃত ঘোষণা করেন। গুলিবিদ্ধ হন গাড়িচালক মুন্নাও। ঢামেকে চিকিৎসাধীন মুন্না জানান, ট্রেনের সিগন্যালে আটকে ছিল তখন গাড়িটি। হঠাৎ বাঁ-পাশ থেকে গুলি করা হয়। প্রথম গুলিটি টিপুর বাঁ হাতে লাগে। এ সময় মুন্নার ডান হাত ও পিঠে গুলি লাগে। মুন্না বলেন, গুলিবিদ্ধ হয়ে গাড়ির সিট ভেঙে আমি শুয়ে মারা যাওয়ার ভান করি। তারা আমাকে মৃত ভেবে আর গুলি করেনি। পরবর্তী সময়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ওই গাড়ি চালিয়ে ঢাকা মেডিকেলে যান মুন্না।

এই হত্যাকাণ্ডের পরপরই তদন্ত শুরু করে পুলিশ, র‌্যাবসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘ সময় ধরেই টিপুকে অনুসরণ করছিল হত্যাকারীরা। মতিঝিল এজিবি কলোনিতে গ্রান্ড সুলতান নামে রেস্টুরেন্টে কাজ শেষে বাসার উদ্দেশে বের হন টিপু। মানামা ভবনস্থ বাটার দোকানের সামনে গেলেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। গাড়িতে তখন চালকসহ চারজন ছিলেন। এর মধ্যে ছিলেন নিহত টিপুর বন্ধু মিজানুর রহমান। তিনি জানান, তাদের মাইক্রোবাসটি ঘটনাস্থলে পৌঁছা মাত্রই টিপুকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে এক যুবক। এলোপাতাড়ি গুলি করে পালিয়ে যায় সে।

চাঞ্চল্যকর জোড়া খুনের এই ঘটনায় বেশ কিছু আলামত ও তথ্য পেয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গত শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, জোড়া খুনের ব্যাপারে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। সিসিটিভির ফুটেজ দেখে হত্যাকারীকে শনাক্ত করা হচ্ছে, দ্রুতই গ্রেপ্তার করা হবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে বেশ কিছু ফুটপ্রিন্ট সংগ্রহ করেছি। বেশ কিছু মোটিভও আমরা হাতে পেয়েছি। সেগুলো আমরা পর্যালোচনা করছি। ঘটনায় শুটারদের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণের মাধ্যমে শনাক্তের চেষ্টা করছি।

অন্যদিকে জোড়া হত্যাকান্ডের বিষয়ে মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. আ. আহাদ জানিয়েছেন, রাজধানীতে গত বৃহস্পতিবার রাতে ঘটে যাওয়া জোড়া খুনের ঘটনায় শার্প শুটার অংশ নিয়েছে। জাহিদুল ইসলাম টিপুকে কয়েকদিন আগে একটা নম্বর থেকে ফোন করে হুমকি দিয়েছিল। এ বিষয়ে তারা পুলিশকে জানায়নি। আর পালানোর সময় যে ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়েছিল, তাতে কলেজছাত্রী সামিয়া আফনান জামাল প্রীতি নিহত হয়েছেন।