logo
আপডেট : ২৭ মার্চ, ২০২২ ১০:২৯
রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগার
পাইলিং করতেই ৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা শেষ!
তারেক মাহমুদ, রাজশাহী ব্যুরো

পাইলিং করতেই ৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা শেষ!

তিন বছর ধরে রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগার ভবন নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে আছে

ভারত সরকারের অনুদানের ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা খরচ তো হয়েছেই। তার সঙ্গে সিটি করপোরেশনের আরো ৭০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। তার পরও ভবন নির্মাণ সম্ভব হয়নি। ৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা শেষ হয়ে গেছে শুধু পাইলিং করতে গিয়েই! যার কারণে প্রায় তিন বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারের ভবন নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে পড়ে আছে।

তবে সিটি করপোরেশন বলছে, নতুনভাবে আবার নকশা করা হয়েছে। সিটি করপোরেশন থেকে বরাদ্দও দেওয়া হয়েছে। আগামী এক মাসের মধ্যে আবার কাজ শুরু হবে।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখা সূত্রে জানা যায়, ভারত সরকারের অনুদানে নগরীর মিয়াপাড়ায় অবস্থিত প্রাচীন রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারটি ভেঙে নতুনভাবে নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৭ সালে। ভারত সরকার এ ভবন নির্মাণের জন্য অনুদান দেয় ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।

প্রকল্পের নাম ছিল ‘সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবেশ এবং প্রত্নতত্ত্ব অবকাঠামো উন্নয়ন সাধন ও সংরক্ষণের মাধ্যমে রাজশাহী ও রাজশাহী মহানগরীর টেকসই উন্নয়ন প্রকল্প’।

এ প্রকল্পের অধীনে রাজশাহীর পুরানো গ্রন্থাগারের জায়গায় ৫২ ফুট উঁচু পাঁচতলা ভবনের সমান কমপ্লেক্স নির্মাণের কথা। যেখানে গ্রন্থাগারের পাশাপাশি ৩০০ আসনের একটি আধুনিক মিলনায়তন নির্মাণের কথা রয়েছে। ঐতিহাসিক এই ভবনের একটি রেপ্লিকা তৈরিরও কথা রয়েছে- যেন পরবর্তী প্রজন্ম সেখানে গিয়ে জানতে পারে আগের ‘রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারটি’র অবয়ব কেমন ছিল।

প্রকল্প অনুযায়ী, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ১৩৮ বছরের পুরানো রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগার ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত। তার পর তিন বছর পেরিয়ে গেছে; কিন্তু ভবন নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি।

প্রকল্পের মেয়াদ পার হলেও মূল পাঠাগার কমপ্লেক্স ভবনের কাজ শুরুই করতে পারেনি ঠিকদারি প্রতিষ্ঠান ‘আরসিসি এল-আরইএমসি জেভি’। এর মধ্যে শুধু পাইলিং করতে গিয়েই অনুদানের সব টাকা শেষ হয়ে গেছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নতুন এই কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণকাজের চুক্তিমূল্য ছিল ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।

রাজশাহী সিটি করপোরেশন বলছে, এরই মধ্যে ভারত সরকারের অনুদানের ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা শেষ হয়ে গেছে। এর সঙ্গে সিটি করপোরেশন আরো ৭০ লাখ টাকা দিয়েছে। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকল্পটির মোট ব্যয় ৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। কিন্তু এর পরও মূল কমপ্লেক্স ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করা যায়নি।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রিথিন এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী তৌহিদ আল মাসুদ রনি বলেন, ‘দরপত্র অনুযায়ী কাজ শুরুর পর ভবনের নকশার পরিবর্তন করা হয়। দরপত্র অনুযায়ী শুধু একটি সাধারণ ভবন নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু পরে নকশায় পরিবর্তন করে হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের কথা বলা হয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘পাইলিং করার কথা না থাকলেও করতে হয়েছে। এ জন্য চুক্তিমূল্যের সব টাকাই শেষ হয়ে গেছে। সেই কাজের ৬০ লাখ টাকা এখনো পাওনা রয়েছে আমার। প্রথম দফার কাজ শেষ। আমরা আর সেই কাজের সঙ্গে যুক্ত নই। এখন দ্বিতীয় দফায় যারা কার্যাদেশ পাবে তারাই কাজ করবে।’

রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ভবনটি নির্মাণ করতে গিয়ে ৮ ফুট গর্ত করে মাটি তোলা হয়। মাটি তোলার পর দেখা যায়, মাটি কাঁপছে। তখন মাটি পরীক্ষা করে জানা যায়, মান খুব খারাপ। তখন পাইলিং করেই ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অথচ নকশায় পাইলিং করার কথা ছিল না।’

তিনি আরো জানান, ৪২টি পাইলিং করা হয়। তারপর আবার মাটির গর্ত ভরাট করা হয়। মাটি ভরাট করার পর পাইলিংয়ের ওপর কলাম নির্মাণ করা হয়েছে। কলাম কিছুদূর উঠতেই সব টাকা শেষ হয়ে গেছে। দ্রুতই কাজ শুরু হবে বলে সিটি করপোরেশন থেকে জানানো হয়েছে।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নূর ইসলাম তুষার বলেন, ‘শুরুতে নকশায় পাইলিং করার কথা ছিল না। মূল কমপ্লেক্স ভবনটি শুধু কলামের ওপর ভিত্তি করেই নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু মাটির মান ভালো না হওয়ায় প্রকল্পের সব টাকা গেছে পাইলিং করতে।’

তিনি আরো বলেন, ‘নতুনভাবে সিটি করপোরেশন থেকে আবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নগরীর উন্নয়নে যে তিন হাজার কোটি টাকার প্রকল্প চলমান রয়েছে সেই প্রকল্প থেকে আবার ২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। নতুনভাবে আবার নকশাও করা হচ্ছে।’

নকশা পেলে আগামী এক মাসের মধ্যে দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে আবার কাজ শুরু হবে। নতুন নকশায় পাঁচতলা কমপ্লেক্স ভবন ও অডিটোরিয়াম নির্মাণের বিষয়টি থাকছে কিনা তা বলতে চাননি তিনি।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, দিঘাপতিয়ার জমিদার রাজা প্রমদানাথ রায়ের দান করা জমিতে কাশিমপুরের জমিদার রায়বাহাদুর কেদারনাথ লাহিড়ী গ্রন্থাগারের বর্তমান ভবনটি ১৮৮৪ সালে নির্মাণ করেন।

তবে গ্রন্থাগারটির মূল প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রানী ভবানীর বংশধর রাজা আনন্দনাথ। কাগজে-কলমে ১৮৮৪ সাল থাকলেও প্রকৃত সূচনাকাল ১৮৫০-এর দশকে বলে বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায়। ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের ‘স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট’ বইতে এই লাইব্রেরির কথা বলা হয়েছে। মূলত ১৮৮৪ সালে ভবন এবং জমি পাওয়ার পর গ্রন্থাগারটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়।

গ্রন্থাগারের অধিকাংশ বই দুষ্প্রাপ্য ও দুর্লভ। গ্রন্থাগারের বয়স খাতা-কলমে ১৩৮ বছর হলেও ১৮৫০ সালের দিকে প্রতিষ্ঠিত হয় বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। গ্রন্থাগারে ২০০ বছরের পুরনো বইও সংরক্ষিত আছে। স্কটল্যান্ড থেকে প্রকাশিত শেকসপিয়রের গ্রন্থাবলি প্রথম সংস্করণ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘একেই কি বলে সভ্যতা’র প্রথম সংস্করণ, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’র প্রথম সংস্করণ, ব্রিটিশ আমলের পত্রিকা, বসুমতি, রিভিউ প্রভৃতি দুষ্প্রাপ্য বই ও পত্রিকা থাকার কারণে অনেক গবেষকের আগমন ঘটে এই গ্রন্থাগারে। বর্তমানে প্রায় ৩৬ হাজার বই রয়েছে এই গ্রন্থাগারে।

রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারের সহ-সভাপতি ড. তসিকুল ইসলাম রাজা বলেন, ‘ভবনটি পুরাতন হওয়ায় বৃষ্টির পানিতে অনেক দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ নষ্ট হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার স্বাক্ষর করা বেশ কয়েকটি বই এই লাইব্রেরিতে দিয়েছিলেন সেসব নষ্ট হয়ে গেছে। লাইব্রেরি ভাঙার পরে বইগুলো সরিয়ে নিয়ে রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের তিনতলায় বিশাল বড় একটি হলরুমে বইগুলো সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে।’