একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বের জন্য অনেকে অনেক খেতাব পেয়েছেন। কেউ বীরশ্রেষ্ঠ, বীর-উত্তম, বীরবিক্রম, বীরপ্রতীক সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। কিন্তু মেহেরপুরের কোটপাড়ার জাহানারা, একই পাড়ার সুরমান হকের স্ত্রী সাজিরন বেগম ও মেহেরপুর সদর উপজেলার মুনজুরা খাতুনসহ কাউকেই বীরাঙ্গনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি।
এদের মধ্যে জাহানারা ও মুনজুরা খাতুন মারা গেছেন। সাজিরন বেগম বিভিন্ন বাড়িতে এখন ঝিয়ের কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি মেলেনি এদের কারো ভাগ্যে। বর্তমানে শহরের তাহের ক্লিনিকপাড়ার একটি মাঠের পাশে একাই থাকেন বীরাঙ্গনা সাজিরন বেগম। জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো একাকিত্বে কাটছে তার।
দৈনিক ভোরের আকাশকে তিনি বলেন, ‘আমরা জীবনের মায়া ত্যাগ করে পাকিস্তানি বাহিনীর তথ্য সংগ্রহ করতাম। নিজেদের সম্ভ্রমের চিন্তা করিনি। মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করাই ছিল আমাদের লক্ষ্য। অনেক বাঙালিকে বাঁচাতে আমরা মুনজুরা খাতুনের নেতৃত্বে কাজ করতাম। কিন্তু স্বাধীনতার পরে যাদের জন্য কাজ করলাম, তারাই ধিক্কার দিত। নানা কটুবাক্য শুনতে হতো। আমরা দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছি। সেই দেশেই আমাদের মূল্যায়ন (স্বীকৃতি) না পেলে মরেও শান্তি পাব না।’
এদিকে পাকসেনাদের আদিম উন্মত্ততার ফসল বীরাঙ্গনা মুনজুরার মেয়ে ছেপি খাতুন। বর্তমানে অভাব-অবহেলায় বেঁচে আছে তার পরিবার।
যদিও ইতিহাস থেকে জানা যায়, স্বাধীনতার পর বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ১৯৭২ সালে প্রতিটি জনসভায় বীরাঙ্গনাদের উদ্দেশে বলেন, ‘কেউ যদি বীরাঙ্গনার সন্তানদের পিতার নাম জিজ্ঞেস করে, তবে বলে দিও তাদের পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। আর তাদের ঠিকানার পাশে লিখে দিও ধানমন্ডি ৩২ নম্বর।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় লাঞ্ছিত, নির্যাতিত নারীদের বীরাঙ্গনা খেতাব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। অথচ মেহেরপুরের বীরাঙ্গনাদের স্থানীয় সমাজ তথা রাষ্ট্র মূল্যায়ন করেনি। স্বাধীনতা-পরবর্তী এদের জীবন চলছে কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে।
বর্তমানে মেহেরপুর শহরের ক্যাশবপাড়ায় ছোট্ট একটি জরাজীর্ণ ঘরে ঠাঁই হয়েছে ছেপি খাতুনের। জীবনের চাকা ঘোরাতে অসুস্থ শরীরেও তাকে কাজ করতে হয়। কিন্তু এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। মা মুনজুরা খাতুন দেশের জন্য নিজের সম্ভ্রম বিলিয়ে দিয়েছিলেন। বাঁচিয়েছিলেন শত শত নারী-পুরুষের জীবন।
মুনজুরাসহ আরো কয়েকজন বীরাঙ্গনা মিলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে শত্রুদের খবর পৌঁছে দিতেন। দেশের জন্য এত আত্মত্যাগের পরও তাকে নিভৃতে জীবন কাটাতে হয়েছে। কলঙ্ক নিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। আর এখন অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়ে বেঁচে আছে তার সন্তানরা।
অশ্রুসিক্ত যুদ্ধশিশু ছেপি খাতুন বলেন, ‘আমি যুদ্ধের সময় জন্মগ্রহণ করেছি। এতে আমার কী দোষ? বঙ্গবন্ধু আমাদের পিতা বলে ঘোষণা দিয়েছেন। সকলে ধিক্কার দিলেও বঙ্গবন্ধু আমাদের মর্যাদা দিয়েছেন। কিন্তু এখনো আমাদের অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে দিন যায়। আমাদের দুই ভাই-বোনকে এখনো সরকারি কোনো সহযোগিতা দেওয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে হয়তো আজ আমাদের অপমানের গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকতে হতো না। মানুষের দুয়ারে গিয়ে হাত পেতে চাইতে হতো না।’
মুনজুরা খাতুনের ছেলে রাজন হোসেন বলেন, ‘আমি রিকশা চালাই। যতক্ষণ কাজ করি, ততক্ষণ সংসারের চাকা ঘোরে। সরকার যদি আমাদের পাশে দাঁড়াত, তাহলে আমরা সুখে থাকতে পারতাম।’
অন্যদিকে বীরাঙ্গনা জাহানারা খাতুন গত হয়েছেন গেল বছর। শেষ বয়সে তিনি সমাজ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিলেন। পৈতৃক সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত হয়েছিলেন। শেষ বয়সে একটা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও তা মেলেনি।
মূলত ৩০ লাখ শহীদের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে জীবনবাজি রেখে যারা নিজেদের সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছেন, তারা হলেন বীরাঙ্গনা। এমনই ২ লাখ মা-বোনদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি কষ্টার্জিত বাংলাদেশ। কিন্তু এখনো নিজেদের ত্যাগের স্বীকৃতি মেলেনি মেহেরপুরের বীরাঙ্গনাদের।
এখনো জীবিত অনেক বীরাঙ্গনা অভাব-অনটনে মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের কথা ভেবে বিভিন্ন উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও আলোর মুখ দেখেনি সেগুলো। মেলেনি আলাদা সরকারি কোনো সুবিধা।
একুশে পদকপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক রফিকুর রশিদ রিজভী ভোরের আকাশকে বলেন, ‘বীরাঙ্গনাদের তালিকা করে মুক্তিযোদ্ধাদের সমমর্যাদায় ভূষিত করার এখনো সময় রয়েছে। তবেই তাদের ত্যাগের যতসামান্য ঋণ শোধ হবে।’
বীরাঙ্গনাদের তালিকা ও স্বীকৃতির বিষয়ে মেহেরপুর জেলা প্রসাশক ড. মনসুর আলম খান বলেন, ‘জেলায় বীরাঙ্গনাদের কোনো তালিকা করা হয়েছে বলে জানা নেই। তাদের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে সরকারিভাবে এখনো কোনো নির্দেশনা আমরা পাইনি। সরকার কোনো নির্দেশনা দিলে আমরা যথাযথ তা পালন করব।’
গাংনী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সাবেক কমান্ডার আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর চলাচলের খবর ও তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। ৮নং সেক্টরের আওতায় মেহেরপুর মহকুমায় যুদ্ধ চলাকালীন জাহানারা, সাজিরন বেগম, মুনজুরা খাতুনসহ আরো অনেক বীরাঙ্গনা আমাদের এসব তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে তাদের সহযোগিতা অসামান্য।’