logo
আপডেট : ২৮ মার্চ, ২০২২ ০৯:১১
আড়াইহাজারে ত্রাসের রাজত্ব: পর্ব-১
মূর্তিমান আতঙ্ক লাক মিয়া
রুদ্র মিজান ও ইদ্রিস আলম

মূর্তিমান আতঙ্ক লাক মিয়া

সহযোগীসহ লাক মিয়া। ফাইল ছবি

যার নাম শুনলেই ভয় পান এলাকার লোকজন- তার নাম লাক মিয়া। স্থানীয়দের কাছে ‘লাক মিয়া’ এক আতঙ্কের নাম। ভিটেমাটি কেড়ে নিলেও প্রতিবাদ করার সাহস পান না ভুক্তভোগীরা। ক্ষমতাসীনদের নাম ভাঙিয়ে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী দিয়ে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় গড়ে তুলেছেন তার ত্রাসের রাজ্য!

প্রভাবশালী এই লাক মিয়া আড়াইহাজার উপজেলার উজান গোপন্দী গ্রামের বাসিন্দা, সাধারণ এক ইউপি চেয়ারম্যান। অথচ কুকীর্তি আর কুখ্যাতির কারণে ‘লাক মিয়া’ নামটি এখন সাধারণের কাছে মূর্তিমান আতঙ্কের। ত্রাসের ওই রাজ্যে ‘লাক মিয়া’ই যেন একক অধিপতি!

লাক মিয়ার জবর-দখলের স্টাইলও ভিন্ন। যখন যে জমির প্রতি নজর পড়ে, ফিল্মি কায়দায় সেখানেই হাজির হন তিনি। সঙ্গে থাকে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। আর কয়েক ট্রাক বালু ও কিছু শ্রমিক। নিজের জমির মতোই বালু ফেলে ভরাট করেন অন্যের জমি। করেন- স্থাপনা নির্মাণ। বাধা দেওয়ার সাহস থাকে না কারো। তারপরও যারা মুখ খোলেন তাদের নামমাত্র মূল্য বা হুমকি-ধমকি দিয়ে উচ্ছেদ করেন।

এভাবেই নিজের দখলে নিয়েছেন শত শত বিঘা জমি। আবার যে জমির দখল নিতে বেগ পেতে হবে বলে মনে হয়, সেখানে তিনি নেন ভিন্ন কৌশল। ভুয়া দলিল তৈরি করে মালিক সাজান ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের। তারপরই শুরু করেন দখল তৎপরতা।

আড়াইহাজারের প্রায় ৪ লাখ মানুষের জনপদে ‘লাক মিয়া’ নামটি যেন চরম বেপরোয়া, ভয়ংকর আর অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার প্রভাব উপজেলা থেকে জেলা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে রয়েছে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতেও। লাক মিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলার মতো সাহস নেই কারো। ওই এলাকায় রয়েছে তার নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। যে কারণে গত ইউপি নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ব্রা‏হ্মন্দী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হয়েছেন তিনি।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ব্রা‏হ্মন্দী ইউনিয়নের ছোট গোপন্দি, বড় গোপন্দি, ছোট বিনাইরচর, বড় বিনাইরচর এলাকার বিপুল সংখ্যক মানুষের জমি জবরদখল করেছেন এই লাক মিয়া। গোপন্দি এলাকায় রয়েছে তার মালিকানাধীন সাবেদ আলী স্পিনিং মিল ও ভাই ভাই মিল। পেছনে ব্রহ্মপুত্র নদের বিনাইরচরে বাঁশের খুঁটি পুঁতে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে বালু ভরাটের মাধ্যমে প্রায় ৬৭ শতাংশ সরকারি জায়গা দখল করেছেন এই লাক মিয়া। সেখানে আধাপাকা ঘর ও ১০০ ফুট বাউন্ডারি দেয়ালও তৈরি করা হয়। কয়েক দফা উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে দখলমুক্ত করতে পারেনি সেখানকার জেলা প্রশাসন।

২০১৩ সালে জেলা প্রশাসনের তৎকালীন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. রিফাত ফেরদৌসের নেতৃত্বে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। অভিযানের পর আবার একই কায়দায় দখল করা হয় সরকারি সেই জায়গা। জমি জবর-দখলের জন্য রয়েছে লাক মিয়ার ক্যাডার বাহিনী। এই বাহিনী দিয়ে আড়াইহাজার ও পার্শ্ববর্তী উপজেলা রূপগঞ্জে শুরু করেন জমি দখলের অভিনব কায়দা।

ছোট গোপন্দির এক বাসিন্দা অভিযোগ করে জানান, তার বাপ-দাদার বসবাস ছিল এই গ্রামে। প্রায় ছয় বছর আগে লাক মিয়া চেয়ারম্যান তার বাপ-দাদার বসতভিটার ৬ শতাংশ জমিতে জোর করে বালু ভরাট শুরু করেন। তিনি বাধা দিয়ে ব্যর্থ হন। লাক মিয়া ও তার ক্যাডার বাহিনী তাকে হুমকি-ধমকি দিয়ে ওই জমি দখলে নিয়েছেন। একইভাবে ওই এলাকার জহিরুল ফকিরের ২৮ শতাংশ জমিতে হঠাৎ করেই বালু ভরাট করেন লাক মিয়া। বাধা দিয়ে ব্যর্থ হয় জহিরুলের লোকজন। শেষ পর্যন্ত এই জমিও দখলে নিয়েছেন লাক মিয়া চেয়ারম্যান।

ওই গ্রামের হাসান ঢালীর অভিযোগ, তার ৬ শতাংশ জমিতে জোর করে বালু ফেলা শুরু হলে তিনি বাধা দেন। কিন্তু লাক মিয়া ও তার লোকজন তাকে উল্টো হুমকি দেয়। এছাড়া বড় বিনাইরচরের সাহিদার পরিবারের ৫১ শতাংশসহ আশপাশের কয়েক বিঘা জমি বালু দিয়ে ভরাট করেছেন লাক মিয়া। ওইসব পরিবারের সদস্যরা জানান, রাত ১০টা থেকে ফজরের আজানের আগ পর্যন্ত ১২ থেকে ১৪টি ট্রাক দিয়ে এসব জমিতে বালু ফেলা হয়েছে।

ওই সময়ে অভিযোগ পেয়ে ইউএনও ও সহকারী কমিশনার ফকিরবাড়ী ফাউসা সড়কের উজান গোবিন্দীর ফসলি জমিতে বালু ভরাট এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় গ্রামবাসী অভিযোগ করেন, কয়েক সপ্তাহ ধরে ট্রাক দিয়ে বালু এনে এসব জমি ভরাট করা হচ্ছে। ব্রাহ্মন্দী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি বশির আহমেদ মাসুদ ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান মনির যৌথভাবে এই বালু ভরাটের কাজ করাচ্ছিলেন। অভিযোগের সত্যতা পেয়ে ওই সময়ে কাজ বন্ধ রাখতে পুলিশকে নির্দেশ দেন ইউএনও ও সহকারী কমিশনার (ভূমি)। অভিযোগ রয়েছে পরবর্তী সময়ে প্রভাব খাটিয়ে জমি দখলে নেন লাক মিয়া।

জোরপূর্বক স্বাক্ষর নিয়ে জমি দখলের অভিযোগে লাক মিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা রয়েছে রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার ও নরসিংদীতে। নরসিংদীর যুগ্ম জেলা জজ এক নম্বর আদালতে একটি দেওয়ানি মামলা (৩৩২/২০১২) রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

মামলা সূত্রে জানা গেছে, তপশিল-ক-তে নরসিংদীর ভেলানগরে ৪.৫০ শতাংশ, তপশিল-খ-তে সাটিরপাড়ায় একটি দাগে ৩.২৫ শতাংশ, আরো একটি দাগে ৩ শতাংশ এবং ভবনসহ ৬.২৫ শতাংশের ভুয়া দলিল তৈরি করেছেন লাক মিয়া। এসব দলিলে জোরপূর্বক স্বাক্ষর আদায় করে দখলের চেষ্টা করছেন তিনি।

সম্প্রতি প্রকাশ্যে বড় গোপন্দি গ্রাম এলাকার ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করেছেন ইউপি চেয়ারম্যান লাক মিয়া। প্রতিদিন বালু পরিবহণের কাজে ব্যবহৃত হয়েছে অনেকগুলো ট্রাক। তদরকিতে যারা ছিলেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের একজন জানান, প্রতিদিন পাঁচ-ছয় লাখ টাকার বালু বিক্রি করা হয়েছে। এভাবে প্রায় মাসব্যাপী ব্রহ্মপুত্র নদের বালু বিক্রি করে প্রায় দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন লাক মিয়া।

এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন, অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগের নামেও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এই ইউপি চেয়ারম্যান। ব্রা‏হ্মন্দী ইউনিয়নের বড় গোপন্দি, ছোট গোপন্দি, বড় বিনাইরচড়, ছোট বিনাইরচড় গ্রামে গ্যাস সংযোগ দেবেন বলে প্রতি বাড়ি থেকে ২০ থেকে ২৫ হাজার করে নিয়ে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এতে খোয়া যায় সরকারের মোটা অঙ্কের শুল্ক। তিতাস গ্যাস কোম্পানির কিছু অসাধুদের সঙ্গে মিলে ২০১০ সালে অবৈধ গ্যাস সংযোগের নামে রমরমা ব্যবসা করেছেন তিনি। সেই থেকে সরকারি দলের নাম ব্যবহার করে প্রভাব বিস্তার শুরু করেন লাক মিয়া।

সরেজমিনে সেসব এলাকার বাসাবাড়িতে গিয়ে দেখা মিলে অবৈধ গ্যাস সংযোগের নমুনা। সংযোগ পেতে গ্রামভিত্তিক কোটি কোটি টাকা লাক মিয়া চেয়ারম্যানের হাতে অন্ধ বিশ্বাসে তুলে দিয়েছেন ওই এলাকার অনেক মানুষ, যারা এখন দিশাহারা। ‘লাক মিয়া’ এই নামটি নিয়ে এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করে সবসময়। অত্যাচারের শিকার হয়েও মুখ খুলতে সাহস পায় না এসব এলাকার মানুষ।

ভোরের আকাশের অনুসন্ধানী দল খুঁজে বের করে লাক মিয়ার পক্ষে সেসময়কার অবৈধ গ্যাসসংযোগের জন্য টাকা উত্তোলনকারীদের অন্যতম একজনকে। নিরাপত্তার কথা ভেবে ভোরের আকাশ তার নাম প্রকাশ করছে না। অনুসন্ধানী দলের সঙ্গে ওই ব্যক্তির কথা হয় প্রায় ঘণ্টাখানেক। তিনি বলেন, ‘আমি নিজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা নিয়ে লাক মিয়ার হাতে তুলে দিয়েছি। সব মিলিয়ে কয়েক ধাপে প্রায় ৩ কোটি টাকা দেওয়া হয় গ্যাসসংযোগের জন্য। এরপর গ্রামে গ্যাসসংযোগ আসে। কিন্তু তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। এক বছরের মধ্যেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে তিতাস।

এভাবে দুই বছরে তিতাস কোম্পানি পর পর তিন বার গ্যাসসংযোগ কেটে দেয়। গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, এখন আর গ্যাস নেই, মাটির চুলায় রান্না করছেন গৃহিণীরা। গ্যাসের চুলা পড়ে আছে অকেজো অবস্থায়। এভাবেই একের পর এক জমি আর অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন লাক মিয়া। এসব বিষয় নিয়ে লাক মিয়া কোনো কথা বলতে চাননি। প্রশ্ন জেনেই ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি।

(আগামীকাল দ্বিতীয় পর্বে থাকবে- মদ, নারী ও সম্পদের নেশা লাক মিয়ার)