logo
আপডেট : ২৮ মার্চ, ২০২২ ০৯:৫৩
হরতালের সমর্থনে শাহবাগ-পল্টন মোড় অবরোধ বাম জোটের
নিজস্ব প্রতিবেদক

হরতালের সমর্থনে শাহবাগ-পল্টন মোড় অবরোধ বাম জোটের

শাহবাগ মোড়ের বিভিন্ন স্থানে দেওয়া হয় আগুন, বসানো হয় ব্যরিকেড। ছবি- ভোরের আকাশ

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে আজ ২৮ মার্চ সোমবার সারা দেশে অর্ধদিবস হরতাল পালন করেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। কর্মসূচির অংশ হিসেবে সকালে টায়ার জ্বালিয়ে ও রাস্তার পাশের ব্যানার-পোস্টারে অগ্নিসংযোগ করে ব্যারিকেড তৈরির মাধ্যমে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন হরতাল সমর্থকরা। সকাল পৌনে ৭টার দিকে তারা এ এলাকার সব রাস্তা বন্ধ করে দেন। একই সময়ে পল্টন মোড়েও অবস্থান নেন হরতাল সমর্থকরা। এ কারণে শাহবাগ ও পল্টন মোড় দিয়ে কোনো যানবাহন চলাচল করতে দেখা যায়নি। আশপাশের সড়কে দেখা দেয় যানজট।

হরতাল কর্মসূচির শেষ দিকে পল্টন মোড় এলাকায় নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশি হামলার অভিযোগ তুলে প্রতিবাদে মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় পল্টনে বিক্ষোভ সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। একই দিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সমাবেশ করবে জোটের জেলা কমিটিগুলো।

রাজধানী ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জে বাম গণতান্ত্রিক জোটের হরতালে বাধা দিয়ে নেতাকর্মীদের ওপর লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ। বাম জোটের এ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এ ছাড়া এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত দেশের কোথাও থেকে অপ্রীতিকর কোনো ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। 

বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক সাইফুল হক বলেন, পল্টনে সমাবেশের শুরু থেকেই পুলিশের আচরণ উসকানিমূলক ছিল। শেষ মুহূর্তে কর্মসূচি ঘোষণার আগে পুলিশ ব্যারিকেড তুলে দিয়েছে; হামলা চালিয়েছে। তার দাবি, হামলায় ২০ জনের মতো নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। তাদের কয়েকজনকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

পুরান পল্টনে হরতাল কর্মসূচীর সময় পুলিশের হামলায় গণসংহতি আন্দোলনের সম্পাদকমন্ডলী সদস্য বাচ্চু ভুইয়া (৪৯) ও ও কামরাঙ্গীরচর থানা কমিটির সদস্য সচিব নিজাম হোসেন (৩৫) আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য মনির উদ্দিন পাপ্পু।

তিনি আরো জানান, তারা শান্তিপূর্ণ ভাবে হরতাল কর্মসূচী পালন করছিলেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশ সদস্যরা তাদের ওপর চড়াও হয়। তারা টিয়ার শেল, ফাঁকা গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। ইটপাটকেলও নিক্ষেপ করে তারা। এতে বাচ্চুর থুতনিতে ও নিজামের হাতের কব্জিতে আঘাত লাগে। পরে তাদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।

হাসপাতালটির পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ (ইন্সপেক্টর) মো. বাচ্চু মিয়া জানান, তাদের অবস্থা গুরুতর নয়। জরুরি বিভাগে তাদের দুজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

রাজধানীর পল্টন মোড়ে হরতাল সমর্থকদের অবরোধ। ছবি- ফেসবুক থেকে নেওয়া

 

বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক সাইফুল হক জানান, সারা দেশে অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এসবের প্রতিবাদেই মঙ্গলবার সমাবেশের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এ সমাবেশ থেকে পরবর্তী দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।

শাহবাগ মোড়ে অচলাবস্থা

ঢাবি প্রতিনিধি জানিয়েছেন, হরতালের সমর্থনে সকাল সাড়ে ৬টার দিকে শাহবাগ মোড় অবরোধ করে সমাবেশ করে বাম জোটের নেতাকর্মীরা। বেলা ১১টার দিকেও তারা শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিয়ে ছিলেন। তাদের এ অবস্থানের কারণে আশপাশের সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়, ভোগান্তিতে পড়েন অনেকে।

হরতালের সমর্থনে অবরোধ ও সমাবেশে অংশ নেন ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন, প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতাকর্মীরা। শাহবাগ মোড়ের বিভিন্ন স্থানে দেওয়া হয় আগুন, বসানো হয় ব্যরিকেড। ফলে যানবাহন চলাচল একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়।

সমাবেশে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জয়দীপ ভট্টাচার্য বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন আজ কিশোররা, যুবকরা রাস্তায় নেমেছে। আমাদের অধিকার আদায়ে আমাদেরই রাস্তায় নামতে হবে। আমরা দেখেছি, সরকার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় নাই। এই পরিবর্তন ঘটাতে আমাদের সকলকে ঐক্যবধ্য হয়ে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে।’

ঢাকা মহানগর ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লাভলি হক বলেন, ‘আপনারা দেখবেন এখন মধ্যবিত্ত ও কম আয়ের পরিবারগুলো হিমশিম অবস্থার মধ্যে যাচ্ছে। এর জন্য আমাদের সমাজ ব্যবস্থা দায়ী। আমরা এই সমাজ, এই দেশ তো চাই নাই। এই স্বাধীনতার মানে কী? স্বাধীন দেশে আমি না খেয়ে থাকি, আমরা এই স্বাধীনতা চাই নাই।’

ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক জাহিদ সুজন বলেন, ‘এই হরতাল জনগণের ন্যায্য দাবি আদায়ের হরতাল। আমরা সবার সহযোগিতা কামনা করছি। বিভিন্ন ধরনের আইনের মাধ্যমে এই সরকার জমিদারি ব্যবস্থা কায়েম করতে চায়। আমি বলে দিতে চাই, দেশের জনগণ একটি বিপ্লবের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এবং যারা ভোটাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে অংশ নেবে তারাই বিপ্লবের অংশ। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ না করা হলে আমরা গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লড়াই অব্যাহত রাখব।’

হরতালের সমর্থনে শাহবাগ মোড়ে অবরোধ ও সমাবেশে অংশ নেন ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন, প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতাকর্মীরা। ছবি- ভোরের আকাশ

 

নারায়ণগঞ্জে লাঠিচার্জ, ককটেল বিস্ফোরণ

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, বাম গণতান্ত্রিক জোটের হরতালে বাধা দিয়ে নেতাকর্মীদের ওপর লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ। এতে কয়েকজন আহত হয়েছেন। সোমবার সকালে নগরীর চাষাঢ়া ও ২নং রেল গেট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পরে বঙ্গবন্ধু সড়কে একটি ককটেল বিস্ফোরণ হয়।

নারায়ণগঞ্জে বাম জোটের হরতালে পুলিশের লাঠিচার্জ। ছবি- ভোরের আকাশ

 

বাম গণতান্ত্রিক জোট সোমবারের হরতাল এই কর্মসূচি সফল করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানায়। জোটের বাইরে থাকা বিভিন্ন বাম রাজনৈতিক দল, শ্রমিক পার্টি, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী হরতালের প্রতি সনমর্থন জানায়। তবে হরতালে বাস চালানোর ঘোষণা দেয় ঢাকা সড়ক পরিবহণ সমিতি। সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে হরতাল আমরা সমর্থন করি না। তাই জনস্বার্থে বাস পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পরিবহণ মালিক ও শ্রমিক নেতারা।

বাম গণতান্ত্রিক জোটের ডাকা আজকের হরতাল কোনো দলের নয়, দেশের সব মানুষের হরতাল বলে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। সিপিবি সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স অর্ধদিবস দেশব্যাপী হরতাল পালনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, সরকার লুটেরা ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করে চলছে। এর বিরুদ্ধে জনগণের রায় দিতে হবে। তিনি হরতাল বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হুমকির সমালোচনা করে বলেন, সব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এরকম মুখস্থ কথা বলেন। এসব কথা পুরোনো ফাইল দেখে বলে, জনগণকে বিভ্রান্ত করা যাবে না।

হরতালে সমর্থন দিয়ে সর্বাত্মকভাবে হরতাল সফল করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। এক বিবৃতিতে উদীচী সভাপতি অধ্যাপক সফিউদ্দিন আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন বলেন, আয়ের তুলনায় দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উল্লম্ফনের মাধ্যমে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের জীবনে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে।

গতকাল রোববার পুরানা পল্টনের মৈত্রী মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাম জোটের সমন্বয়ক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক সরকার ও সরকারি দলের সব উসকানি ও সহিংসতা এড়িয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বাম জোট আহূত অর্ধদিবস হরতাল সফল করার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ভোজ্যতেল-চাল-ডাল-পেঁয়াজসহ খাদ্যদ্রব্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি প্রতিরোধ এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির মূল্যবৃদ্ধির তৎপরতা বন্ধে গত ১১ মার্চ আমরা দেশব্যাপী অর্ধদিবস (৬টা-১২টা) হরতাল আহ্বান করেছি।

সাইফুল বলেন, গণদাবির এ হরতালের পক্ষে আমরা দেশের মানুষের ব্যাপক সমর্থন ও সাড়া প্রত্যক্ষ করেছি। দলমত-নির্বিশেষে দেশের মানুষকে রক্ষা করার এ হরতালের প্রতি আমরা মানুষের মধ্যে এক ধরনের স্বতঃস্ফূর্ততাও লক্ষ করেছি। তিনি বলেন, হরতালের সমর্থনে আমাদের শান্তিপূর্ণ প্রচার মিছিল, গণসংযোগ ও প্রচার কার্যক্রম দেশের নানা স্থানে সরকারি দল ও ছাত্রলীগ কর্তৃক হামলা-আক্রমণের শিকার হয়েছে; বহু স্থানে পুলিশ কোনো উসকানি ছাড়াই প্রচার মিছিলে বাধা দিয়েছে। এসব হামলা-আক্রমণে জোটের অনেক নেতাকর্মীরা আহত হয়েছেন। এসব সন্ত্রাসী হামলা-আক্রমণের পুরো দায়দায়িত্ব সরকার ও সরকারি দলের।

সাইফুল হক বলেন, বাম জোটের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেক বাম প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল, সংগঠন এবং ছাত্র, শ্রমিক, নারী, পেশাজীবীসহ নানা স্তরের সংগঠন ও নেতা এ হরতালের প্রতি তাদের সমর্থন ও একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ নিজেরাও হরতাল ডেকেছেন। হরতাল সফল করতে তারা কিছু কর্মসূচিও গ্রহণ করেছেন। তাদের সবাইকে আমরা ধন্যবাদ জানাই।

তিনি বলেন, আমরা আশা করি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকার ও সরকারি দল এ হরতাল কর্মসূচিতে কোনোরকম উসকানি সৃষ্টি করবে না, বাধা প্রদান করবে না বা সহিংসতা সৃষ্টির কোনো প্রচেষ্টা চালাবে না। এ ধরনের যেকোনো অনভিপ্রেত ঘটনার দায়দায়িত্ব সরকার ও সরকারি দলকেই বহন করতে হবে।

সাইফুল হক আশাবাদ ব্যক্ত করেন, ভোর ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত মানুষকে রক্ষার এ হরতালে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, শপিংমল, সব ধরনের পরিবহন চলাচল বন্ধ রাখা হবে। শুধু হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি পরিষেবা হরতালের আওতামুক্ত থাকবে। তিনি বলেন, ২৮ মার্চ (আজ) ভোর ৬টা থেকে বাম জোটের কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতারা পুরানা পল্টনসহ ঢাকা মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোয় অবস্থান নেবেন এবং হরতালের পিকেটিং এ যোগ দেবেন।

এ সময় বক্তব্য রাখেন কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি শাহ আলম, বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবদুস সাত্তার, বাসদ-মার্কসবাদীর সমন্বয়ক মাসুদ রানা, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আবদুল আলী, ওয়ার্কার্স পার্টি-মার্কসবাদীর বিধান দাস প্রমুখ।