মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে বিশেষ অবদান রাখা ভারতের আরেক বন্ধুর সন্ধান মিলেছে। যুদ্ধের পর ভারতীয় সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর (বিএসএফ) অবদান বিশেষ কারণে দেশটির সরকার গোপন রেখেছিল। ৫০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর এবারই প্রথম তা জনসমক্ষে এসেছে। যুদ্ধের সময় তিনি বিএসএফ কর্মরত ছিলেন। তৎকালীন তরুণ কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন পরিমল কুমার ঘোষ, বন্ধুমহলে যিনি ‘পি কে ঘোষ’ নামে পরিচিত এবং ’৭১-এর রণাঙ্গনে পরিচিত ছিলেন ক্যাপ্টেন আলী নামে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি বলছে, ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে ঐতিহাসিক বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী বাংলাদেশের মতো ভারতেও আড়ম্বরের সঙ্গে উদযাপন করা হয়েছে, যেখানে বিএসএফের অবদান বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। ২০২১ সালে প্রকাশিত বিএসএফের বার্ষিক জার্নাল ‘Bordermen 2021’-এ প্রকাশিত হয়েছে মেজর পি কে ঘোষের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ- যার শিরোনাম-“BSF made history in 1971”।
এই জার্নালে প্রকাশিত লেখা দেখেই পি কে ঘোষকে আবিষ্কার করা হয়েছে। ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ স্বাধীনতার প্রথম প্রহরে ত্রিপুরায় ভারত-বাংলাদেশ (তখন পাকিস্তান) সীমান্তে শ্রীনগর ‘বিওপি’র কোম্পানি কমান্ডার বিএসএফের ৩২ বছর বয়সি তরুণ ক্যাপ্টেন পি কে ঘোষ কীভাবে বাংলাদেশের তরুণদের নিয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রথম দল গঠন করেছিলেন। যারা ফেনী-চট্টগ্রাম সীমান্তের শুভপুর ব্রিজে যুদ্ধ করে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে পরাজিত করে সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেতুটি দখল করেছিলেন। নিজের লেখায় এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেন পি কে ঘোষ।
নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবীর বলেন, ভারতে গিয়ে তাঁর লখাটি পড়ে অভিভূত হলাম। তিনি বলেন, কীভাবে বাংলাদেশের তরুণদের সঙ্গে নিয়ে ফেনী-চট্টগ্রাম সীমান্তের শুভপুর ব্রিজে যুদ্ধ করে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে পরাজিত করে সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেতুটি দখল করেছিলেন, তারই অত্যন্ত রোমাঞ্চকর ও চিত্তাকর্ষক বর্ণনা রয়েছে মেজর পি কে ঘোষের নাতিদীর্ঘ রচনায়।
মুক্তিযুদ্ধের ৫১ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ওয়েবিনারে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশের পক্ষে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জীবনবাজি রেখে কাজ করা সেই অকৃত্তিম বন্ধু পি কে ঘোষ।
স্বাধীনতার দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের বিএসএফের কোম্পানি কমান্ডার মেজর পি কে ঘোষ (অব.) বলেন, ‘অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমি ডাক্তার হতে চেয়েও সেনাবাহিনীতে যোগদান করি এবং ১৯৭০ সালে সেনাবাহিনী থেকে বিএসএফে বদলি হয়ে ত্রিপুরায় যোগদান করি।
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ’৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘পাশেই ছিল ফেনী নদী ও চট্টগ্রাম শহর যা মুক্তিযুদ্ধের খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচিত ছিল। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী চট্টগ্রামের পোর্টে পৌঁছলে আমরা ওপরের নির্দেশে ত্রিপুরায় সতর্ক অবস্থান নিই। সেদিন দুপুরে বাংলাদেশের সীমান্তের ওপার থেকে ইপিআরের হাবিলদার নূরুদ্দিন, আওয়ামী লীগের এমএনএ অধ্যাপক ওবাইদুল্লাহ মজুমদার ও ডা. আমির হোসেন আমার কাছে এসে বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনী হত্যাযজ্ঞের কথা জানান।
সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে পি কে ঘোষ আরো বলেন, সেই গ্রামে পাকিস্তান বাহিনীর নানা অত্যাচারের কথা জানিয়ে তাদের কাছ থেকে বাঙালিদের রক্ষা করার জন্য আমাকে অনুরোধ জানান। আমি ওপরের নির্দেশপ্রাপ্ত না হওয়ার কারণে তাদের কাছে অপারগতা প্রকাশ করে কিছু আত্মরক্ষামূলক পরামর্শ দিই। কিন্তু তারা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে মানবতার দোহাই দিলেন। আমি তাদের যুক্তি মেনে নিলাম।
সমস্যা হলো বিএসএফের উর্দি পরে আমি সীমান্ত অতিক্রম করতে পারব না। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি অধ্যাপক ওবায়দুল্লাহ মজুমদার বললেন, আমি পটিয়া কলেজের অধ্যক্ষ। আমি আপনাকে গ্রামবাসীর কাছে আমার সহকর্মী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেব। তখন আমি প্রফেসর আলী ছদ্মনাম গ্রহণ করে তাদের সঙ্গে সীমান্ত অতিক্রম করে গ্রামে গেলাম। গ্রামের মানুষ তাদের নেতা অধ্যাপক মজুমদারকে কাছে পেয়ে আবেগাক্রান্ত হয়ে উচ্চ কণ্ঠে স্লোগান দিল- ‘জয় বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলা, জয় বাংলাদেশ...।’
‘স্লোগানের তাৎক্ষণিক জবাবে পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রামের দিকে তাক করে মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করল। তবে এতে কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। সঙ্গে সঙ্গে আমি শত্রুর অবস্থান জানার উদ্যোগ গ্রহণ করলাম। বিকেল ৫টা নাগাদ আমি হাবিলদার নূরউদ্দিনের নেতৃত্বে ইপিআরের ছয়জন তরুণকে নিয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রথম দল গঠন করলাম। তাদের দুটি গ্রুপে ভাগ করে উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তে ব্রিজের তলায় অবস্থান নিতে বললাম।’
তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানি সৈন্যদের অবস্থান ছিল ব্রিজের ঠিক ওপরে। তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলাম। গেরিলা যুদ্ধের কৌশল তো বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ভাষণেই বলেছিলেন। যার যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। শত্রুকে ভাতে মারতে হবে, পানিতে মারতে হবে। আমি ইপিআরের তরুণদের বললাম, তারা পাকিস্তানি সৈন্য গ্রামে প্রবেশ থেকে বিরত রাখবে, কোনোভাবে তাদের নদীর দিকে নামতে দেবে না এবং একবারে এক রাউন্ডের বেশি গুলি ছুঁড়বে না। কারণ সেই সময় আমার কাছে মাত্র ৩০০ রাউন্ড গুলি ছিল, যা তাদের ভাগ করে দিয়েছিলাম।
‘সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমি শ্রীনগর পোস্টে ফিরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পাঠালাম, আমার সীমান্ত অতিক্রম করার বিষয়টি গোপন রেখে। পরদিন সকালে আমার কমান্ডিং অফিসার কর্নেল অরুণ কুমার ঘোষ এলেন। আমার রিপোর্টের জন্য সন্তোষ প্রকাশ করে ধন্যবাদ জানালেন। একজন শৃঙ্খলাপরায়ন সৈনিক হিসেবে আমার সীমান্ত অতিক্রমের কথা তাকে বললাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার সিও-র মেজাজ পাল্টে গেল। ক্রুদ্ধ গলায় তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘কোন সাহসে তুমি আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করেছ?... তোমাকে কোর্ট মার্শালের সম্মুখীন করা হতে পারে,’ এই বলে ক্রুদ্ধ মেজাজ নিয়েই তিনি চলে গেলেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আচরণের জন্য আমার খারাপ লাগলেও আমি বিন্দুমাত্র দুঃখিত ছিলাম না- সীমান্তের ওপারের হতভাগ্য নিরাপরাধ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তের জন্য। আমি স্বামী বিবেকানন্দের ভক্ত। তিনি বলেছেন, ‘বিপন্ন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে, অসহায় প্রতিবেশীকে সাহায্য করতে’।
আমি অবশ্যই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে চাই হাবিলদার নুর উদ্দনকে। সেই সময় সে ও তার বাহিনী যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল তা অভাবনীয়। সে সময়ে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়েছি। ‘জীবন মানেই যুদ্ধ। আজ আমি ৮৩ বছর বয়সে এসে কর্কট রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করছি। এ রোগের সঙ্গে লড়াই করার অনুপ্রেরণা একাত্তরের লড়াই থেকে পেয়েছি।’
শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যুক্ত ভারতীয় নায়কদের সন্ধানে আমার ৩০ বছরের অভিযানে বহুজনকে পেয়েছি, যারা মুক্তিযুদ্ধের এক একটি অধ্যায়কে এক একভাবে আলোকিত করেছেন। তিরিশ বছর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জীবিত ছিলেন না। তবে ১৯৭১-এ এই মহান নেত্রীর সহযোগী যারা মুক্তিযুদ্ধের বাইশ-তেইশ বছর পরও বেঁচেছিলেন তাদের সাক্ষাৎকার আমি গ্রহণ করেছি। ফিল্ড মার্শাল মানেকশ, জেনারেল অরোরা, জেনারেল জ্যাকব, জেনারেল উবান, জেনালে থাপান, জেনারেল লছমন সিং, মন্ত্রী করণ সিং, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর উপদেষ্টা পিএন হাকসার, পররাষ্ট্র সচিব টি এন কল, গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর প্রধান আরএন কাও ও বিএসএফ প্রধান রুস্তমজীসহ ভারতের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরো অনেকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে।
এই তালিকার সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে ভারতের বিএসএফের তৎকালীন তরুণ কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন পরিমল কুমার ঘোষ, বন্ধুমহলে যিনি ‘পি কে ঘোষ’ নামে পরিচিত এবং ’৭১-এর রণাঙ্গনে পরিচিত ছিলেন ক্যাপ্টেন আলী নামে।’