‘সেদিন বিকেলে হাজার দুয়েক মাদ্রা সাছাত্র এসে অতর্কিতভাবে রেলওয়ে স্টেশনে হামলা চালায়। তারা রেললাইন উল্টে ফেলে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলে সিগন্যালিং সিস্টেম। এক এক করে স্টেশনের সবকিছু আগুনে পুড়িয়ে দেয় হামলাকারীরা।’ কথাগুলো বলছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার শোয়েব আহমেদ।
গত বছরের ২৬ মার্চ হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের চালানো তাণ্ডবে প্রথম আক্রমণের শিকার হয় রেলওয়ে স্টেশনটি। এর আগেও ২০১৬ সালে এক মাদরাসা ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে রেলওয়ে স্টেশনটিতে হামলা-ভাঙচুর করেছিল মাদ্রাসাছাত্ররা।
শুধু রেলওয়ে স্টেশনই নয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে গত বছরের ২৬-২৮ মার্চ পর্যন্ত তিনদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর, আশুগঞ্জ ও সরাইলে ব্যাপক তাণ্ডব চালায় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মী ও তাদের অনুসারীরা।
আলোচিত ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাগুলোতে হেফাজতের নেতৃত্ব স্থানীয় যে কয়জন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তাদের সবাই এখন জামিনে কারামুক্ত। এছাড়া তাণ্ডবের এক বছরেও কোনো মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিতে পারেনি পুলিশ। ফলে তাণ্ডবে জড়িতদের বিচার হওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত বছরের ২৬ মার্চ ঢাকায় আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার আগমনের বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মী এবং অনুসারীরা ২৬-২৮ মার্চ পর্যন্ত ব্যাপক তাণ্ডব চালায়।
এ সময় তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন, পুলিশ সুপারের কার্যালয় ও সদর মডেল থানার ২নং ফাঁড়ি, সিভিল সার্জনের কার্যালয়, জেলা পরিষদ কার্যালয় ও ডাকবাংলো, পৌরসভা কার্যালয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাব ভবন, আলাউদ্দিন খাঁ পৌর মিলনায়তন ও সুর সম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন, সদর উপজেলা ভূমি অফিস ও জেলা গণগ্রন্থাগার, খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানা এবং শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরসহ সরকারি-বেসরকারি বেশ কিছু স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। তিনদিনের ওই তাণ্ডবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ১১ জন নিহত হয়।
জেলা পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, তাণ্ডবের ঘটনায় ৩৫ হাজারের বেশি মানুষকে আসামি করে ৫৬টি মামলা দায়ের করা হয়। আসামিদের মধ্যে ৪১৪ জন এজাহারনামীয়, বাকিরা সবাই অজ্ঞাত। ঘটনার পর এজাহারনামীয় ৪৬ জন এবং সন্দেহভাজন ৭১২ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এদের মধ্যে হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্ব স্থানীয় কয়েকজন নেতাও ছিলেন। তবে তাদের সবাই জামিনে আছেন। বর্তমানে কারাগারে আছেন ১২০ জন।
৫৬ মামলার মধ্যে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ১০টি, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ৯টি, জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) ৪টি, সদর মডেল থানা পুলিশ ২৭টি, আশুগঞ্জ থানা ৩টি ও সরাইল থানা পুলিশ ২টি এবং আখাউড়া রেলওয়ে থানা পুলিশ একটি মামলা তদন্ত করছে।
তবে তাণ্ডবের এক বছরেও কোনো মামলারই তদন্ত কাজ শেষ করতে পারেনি তদন্ত কর্মকর্তারা। অধিকাংশ মামলার বাদিদের সঙ্গে তদন্ত কর্মকর্তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। ফলে মামলার অগ্রগতি সম্পর্কেও জানতে পারছেন না বাদিরা।
হেফাজত তাণ্ডবের একটি মামলার বাদি শফিকুল ইসলাম জানান, তার অফিস ভাঙচুরের মামলাটির তদন্তভার আছে সদর মডেল থানা পুলিশের কাছে। ঘটনার পর তার সঙ্গে তদন্তকারী কর্মকর্তা কয়েকবার যোগাযোগ করে মামলা সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন। এরপর থেকে তার সঙ্গে তদন্ত কর্মকর্তা আর কোনো যোগাযোগ করেননি। ফলে তার মামলাটি কোন পর্যায়ে আছে, সেটি জানতে পারছেন না। দ্রুত মামলার তদন্ত কাজ শেষ করে দোষীদের গ্রেপ্তার করে শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
হেফাজত তাণ্ডবের শিকার জেলা পরিষদ কার্যালয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ মামলার বাদি আব্দুল হামিদ জানান, জেলা পরিষদ ভবন ও ডাকবাংলোর সংস্কার করে এখন পরিষদের সব কাজ স্বাভাবিকভাবে চলছে। তবে তার করা মামলা নিয়ে প্রথমদিকে পুলিশের যে তৎপরতা ছিল, সেটি এখন আর নেই।
বিশিষ্টজনরা বলছেন, তাণ্ডবে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে। সেজন্য দ্রুত মামলাগুলোর তদন্ত শেষ করে দোষীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তারা।
জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক আব্দুন নূর বলেন, ‘২০১৬ সালেও এক মাদ্রাসাছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় শহরজুড়ে তাণ্ডব চালানো হয়েছিল। একই বছর নাসিরনগরে হিন্দুপল্লীতে হামলা হয়। ওই দুই ঘটনায় জড়িতদের বিচার হলে তাণ্ডবের পুনরাবৃত্তি হতো না। আলোচিত এ সব ঘটনার বিচার নিয়ে আমরা শঙ্কিত। আমরা চাই দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মোল্লা মোহাম্মদ শাহীন বলেন, ‘কয়েকটি ছাড়া বাকি সব মামলার বাদি পুলিশ। জেলা পুলিশের হাতে থাকা মামলাগুলো গুরুত্ব দিয়েই তদন্ত করা হচ্ছে। আরও অনেক আসামি গ্রেপ্তারের বাকি আছে। গ্রেপ্তার অভিযানও চলমান। কিছু মামলার চার্জশিট হয়তো তিন-চার মাসের মধ্যে আদালতে জমা দেওয়া হবে। তবে সবগুলোর চার্জশিট দিতে কিছুটা সময় লাগবে। সেই সময়টা কতদিন, সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।’