logo
আপডেট : ২৯ মার্চ, ২০২২ ০৮:৩৫
অস্তিত্ব হারাচ্ছে বালু নদী
নাজমুল হাসান রাজ

অস্তিত্ব হারাচ্ছে বালু নদী

বালু উত্তোলন, দখল-দূষণের কবলে বালু নদী।

ঢাকার জনপদকে সুরক্ষিত রাখতে চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীগুলোই রাজধানীর লাইফলাইন। নাগরিক সভ্যতা গড়ে ওঠার মূলে এসব নদীর প্রবাহই প্রধান ভূমিকা রেখেছে বহুকাল ধরে। মাত্র কয়েক দশকের ব্যবধানে ঢাকার চারপাশের নদীগুলো সব উপযোগিতাই হারিয়ে ফেলেছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নে স্বাভাবিক গুণাগুণ হারাচ্ছে এসব নদীর পানি।

নদী ভরাট, অপদখল এবং নদী বিনাশী নানান তৎপরতা থামাতে চলছে কাগুজে কর্মযজ্ঞ। দখল, দূষণ, জলাবদ্ধতার ভোগান্তি কতটা থামানো গেছে এমন প্রশ্ন জনমনে। বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার মতোই অস্তিত্ব হারাতে বসেছে রাজধানীর উত্তর-পূর্ব এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া বালু নদী। এক পাড়ে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, অন্য পাড়ে ঢাকার খিলগাঁও বালুরপাড়। নাব্য সংকটে নদীর প্রবাহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি দখলের কারণে বিপন্ন হতে চলছে বালু নদী। দখলদাররা দখল করেছে নদীটির প্রায় ২২ কিলোমিটার তীরবর্তী এলাকা। সংকুচিত হয়ে যাওয়া নদীটি দেখলে মনে হবে যেন কোনো এঁদো ডোবা। প্রভাবশালীদের দখলের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে এই নদীটি।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী দখলমুক্ত, পিলার স্থাপন এবং ওয়াকওয়ে নির্মাণের একটি প্রকল্প চলমান আছে। এ ছাড়া ঢাকার চারপাশের নদী দখলমুক্ত করতে ২০ বছর মেয়াদি একটি মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে, এমনটাই জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

তথ্য বলছে, বালু নদী শীতলক্ষ্যার শাখানদী। রূপগঞ্জের ডেমরা এলাকার শীতলক্ষ্যা নদী থেকে বালু নদী টঙ্গীতে গিয়ে তুরাগ নদীর সঙ্গে মিশেছে। বালু নদী থেকে আবার দুটি ছোট নদী ‘নরাই’ ও ‘দেবধোলাই’ ঢুকেছে ঢাকায়। এ ছোট নদী দুটি দিয়ে ঢাকার মিরপুর, পল্লবী, উত্তরা, গুলশান, তেজগাঁও, সবুজবাগ, ডেমরা, মতিঝিলসহ বিশাল এলাকার শিল্প ও স্যুয়ারেজের বর্জ্য এসে পড়ছে বালু নদীতে। নদী তীরবর্তী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পচা পানির কারণে বালু নদী তীরের দু-তিন ফসলি জমি এক ফসলি হয়ে গেছে।

দূষণের কারণে বালু নদীর পানিতে এখন সেই দেশি নদীর মাছ আর দেখা যায় না। নদীর পাড়ের জেলেপাড়ার বেশির ভাগ মানুষই তাদের পেশা বদলেছেন। এমনটাই বলছেন এলাকার অনেকেই। নদীর দুই তীরের বেশির ভাগ জমি দখলে নিয়ে বহুতল ভবন, অবৈধ স্থাপনা ও ব্যবসাকেন্দ্র গড়েছেন এটা নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। আবার এখান থেকে মাসোহারা আদায় করছেন কেউ কেউ। বালু নদী টঙ্গীর আবদুল্লাহপুর থেকে শুরু হয়ে ডেমরা পর্যন্ত বিস্তৃত।

বালু নদীকে দখলমুক্ত ও দূষণমুক্ত করার পরিকল্পনা অনুযায়ী জাতীয় নদী কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য কামরুন নাহার আহমেদকে প্রধান করে ২১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিলো গত বছর অক্টোবরে। বালু নদীকে সম্পূর্ণভাবে দখল ও দূষণমুক্ত করা এবং নাব্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে গঠিত কমিটি মহাপরিকল্পনা তৈরির পর সেই অনুযায়ী কার্যক্রম তদারকিও চালিয়েছে কমিশন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেছেন, গত বছর ২৭ অক্টোবর এক বৈঠকের পরে একটা প্রতিবেদনও জমা দেওয়া হয়েছিল। তবে বিআইডব্লিউটিএ এ নিয়ে আগেই কাজ করছে। বালু নদীতে বেশ কয়েকবার সরেজমিনে পরিদর্শনে যায় কর্তৃপক্ষ। তবে নদী দখলমুক্ত করতে কাজ অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

ঢাকা ওয়াসার একটি সূত্র বলছে, বালু নদীর মোট দৈর্ঘ বাইশ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে দৈনিক ১০ লাখ ঘনমিটার পয়ঃবর্জ্য, বর্ষায় ৫৬ কোটি ঘনমিটার বর্জ্য মেশানো পানি, বিভিন্ন শিল্প-কারখানার সাড়ে চারশ’ ঘনফুট বর্জ্য প্রতিদিন নদীতে পড়ছে। এ ছাড়া বালু, নরাই ও দেবধোলাই নদীর ওপরে আছে সহস্রাধিক ঝুলন্ত পায়খানা। এসব থেকে আরো পাঁচশ ঘনফুট পয়ঃবর্জ্য নদীতে মিশছে। চনপাড়া এলাকার হেলাল উদ্দিন বলেন, নদীতে মাছ না থাকলেও আছে পোকা। নদীতে কত ধরনের যে পোকা তার হিসাব নেই। পোকায় নদীর পানি কিলবিল করে।

বালু নদী নিয়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী ও বারোগ্রাম উন্নয়ন সংস্থার সুরুজ মিয়া বলেন, ঢাকার মিরপুর, পল্লবী, উত্তরা, গুলশান, তেজগাঁও, সবুজবাগ, ডেমরা, মতিঝিলসহ বিশাল এলাকার শিল্প ও স্যুয়ারেজের বর্জ্য এসে পড়ছে এই বালু নদীতে। বছরের পর বছর আর্বজনা পড়তে পড়তে নদীর পানি নষ্ট হয়ে গেছে। পানি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় নদীপাড়ের ঢাকা ত্রিমোহনী, লায়নহাটি, নাসিরাবাদ, দাসেরকান্দি, বালুরপাড়, বেড়াইদ, ধীৎপুর, রূপগঞ্জের নগরপাড়া, পশ্চিমগাঁও, কামসাইর, নাওড়া, ইছাপুরাসহ বিশাল এলাকার দু-তিন ফসলি জমি এক ফসলি হয়ে গেছে। এ কারণে বালু নদীর দুই তীরের মানুষের আয় কমে গেছে।

ত্রিমোহনী এলাকার জেলে রমেশ অভিযোগ কর বলেন, দূষণের কারণে বালু নদীতে এখন সারা দিন জাল ফেলেও আর মাছ পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে আমরা ইছাপুরাসহ ১০-১২ কিলোমিটার দূরে গিয়ে বিল ও খালে মাছ ধরি। বারবার চেষ্টা করেও উচ্ছেদ করা যায়নি দখলদার উল্লেখ করে দুই পাড়ের একাধিক জনগণ বলেন, উচ্ছেদ করতে গিয়ে নানা ধরনের জটিলতার মধ্যে পড়তে হয় সরকারি সংস্থাগুলোকে। মেরাদিয়া, ডুমনি ও ছোলমাইদে গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় ৪ কিলোমিটার এলাকায় সাত শতাধিক বসতবাড়ি নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন স্থানীয় নেতা কুতুব আলী, সালাম ও রশিদ।

পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমাদের অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ড এ অবস্থা তৈরি করেছে। রাজধানীর পয়ঃবর্জ্য ও কারখানার বর্জ্য বালু নদীতে ফেলা বন্ধ না করলে এক সময় বালু নদী অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। এজন্য এখনই বাস্তব ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। এ ছাড়া হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে নদীগুলোর পরিস্থিতির আস্তে আস্তে উন্নতি হবে।

সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলেন, ঢাকার চারপাশের নদীকে রক্ষা করতে হলে উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি নদী রক্ষায় নৌ-পরিবহণ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া কার্যকর মনিটরিং-ব্যবস্থা চালু করতে হবে। নতুবা একদিকে উচ্ছেদ চলবে আর অন্যদিকে অবৈধ দখল চলতেই থাকবে।