logo
আপডেট : ২৯ মার্চ, ২০২২ ০৯:০৮
বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে অনিয়ম
কামরুজ্জামান মিন্টু, ময়মনসিংহ ব্যুরো

বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে অনিয়ম

মুক্তাগাছা কুমারগাতা ইউনিয়নের আয়মন নদীর তীরে একটি ময়লার ভাগাড় ভরাট করে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় একটি বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের নামে টাকা হরিলুট করার অভিযোগ উঠেছে। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দেওয়াসহ টাইলস উঠে গেছে।

ফলে পুনরায় প্রকল্পের মাধ্যমে তড়িঘড়ি করে আবারো সংস্কার করা হচ্ছে। এতে ক্ষোভে ভাসছেন স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

মুক্তাগাছা উপজেলার কুমারগাতা ইউনিয়নের আয়মন নদীর তীরে ডৌয়াখোলার একটি ময়লার ভাগাড় ভরাট করে নির্মিত হয়েছে এই স্মৃতিস্তম্ভ। গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধানে মেসার্স নাঈমা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাজ শেষ করে গণপূর্তকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এরপর কাজটি বুঝে নিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে চিঠি দেয় গণপূর্ত বিভাগ।

চিঠি পেয়ে ইউএনও গিয়ে দেখেন নির্মাণ শেষ করা হয়নি। অথচ চিঠিতে উল্লেখ করা হয় কাজ শেষ। এমতাবস্থায় কাজটি বুঝে নেননি ইউএনও। তখনই প্রায় ৫৬ লাখ টাকা উত্তোলন করেছে ঠিকাদার।

এরপর সম্প্রতি স্মৃতিস্তম্ভটির বিভিন্ন অংশে ফাটল দেখা দেওয়াসহ টাইলস উঠে যায়। এতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন স্মৃতিসম্ভ নির্মাণকাজের বিস্তর অভিযোগ তোলেন। দ্রুত নির্মাণের দাবি জানান তারা।

বর্তমানে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়েছে গণপূর্ত। ফলে আবারো অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে কাজ করছে ঠিকাদার।
স্থানীয়রা জানান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই স্থানে প্রায় তিন শতাধিক মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। সেইসব শহীদের স্মরণে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে নির্মিত হয় স্মৃতিস্তম্ভটি।

নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে কোনোরকমে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাণের নামে সরকারি টাকা হরিলুট করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের তদারকির অভাবেই এমনটি হয়েছে।

স্থানীয় আব্দুর রহমান নামে একজন বলেন, ‘এটি নির্মাণে কোনো আন্তরিকতা ছিল না। শুরু থেকেই নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করার অভিযোগ তোলা হয়েছে। কিন্তু কেউ কর্ণপাত করেনি। ইচ্ছামতো কাজ করে টাকা উত্তোলন করেছে ঠিকাদার।’

এই বিষয়ে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাসেম বলেন, ‘নকশা অনুযায়ী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়নি। যেখানে টাইলস দেওয়ার কথা, সেখানে দেওয়া হয়নি। কাজের মধ্যে যথেষ্ট ত্রুটি রয়েছে। আবারো শুরু হওয়া সংস্কার কাজ ভালোভাবে সমাপ্ত না করলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাসহ এলাকার লোকজন আন্দোলনে নামবে।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নাঈমা এন্টারপ্রাইজের পরিচালক আব্দুল মোমেন খান দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, ‘আমি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাজ শেষ করে গণপূর্তকে বুঝিয়ে দিয়েছি। তখন প্রায় ৫৬ লাখ টাকা উত্তোলন করেছি। আমার কাজে কোনো অনিয়ম হয়নি।’

তা হলে এখন আবার সংস্কারের কারণ কি? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকার কারণে স্মৃতিস্তম্ভটি মাদকসেবীদের নিরাপদ স্থানে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তারা আড্ডা দেয়। এতে টাইলসসহ স্তম্ভের বিভিন্ন ক্ষতি হয়েছে। গণপূর্ত থেকে বলার কারণে শ্রমিক দিয়ে সেগুলো মেরামত করা হচ্ছে।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল্লাহ আল মনসুর বলেন, ‘গণপূর্ত থেকে চিঠি পাওয়ার পর আমি স্মৃতিস্তম্ভটি দেখতে যাই। তখন দেখি গেট ভাঙা, টাইলস লাগানোই হয়নি। বিভিন্ন জায়গায় পলেস্তার করা হয়নি। এমতাবস্থায় স্মৃতিস্তম্ভটি বুঝে নেওয়া সম্ভব ছিল না।’

তিনি বলেন, ‘তখন কোনো কর্মকর্তা সেটি বুঝিয়ে দিতে আমার কাছে আসেনি। তবুও আমি গণপূর্তকে বলেছি, নকশা ও প্রাক্কলন অনুযায়ী স্তম্ভটি আমাকে বুঝিয়ে দিন। আমি বুঝে নেব। কিন্তু তারা প্রকল্পের ব্যয়সহ কিছু জানায়নি।’

ইউএনও আরো বলেন, ‘অসমাপ্ত কাজটি আমি বুঝে না নিয়ে ভালোই করেছি। ইতোমধ্যে জানতে পেরেছি প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তা হলে বোঝা গেল কাজটি অসমাপ্তই ছিল।’

প্রকল্পটি তদারকির দায়িত্বে ছিলেন গণপূর্ত বিভাগের সহকারী ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাক আহমেদ। এসব অভিযোগের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে দৈনিক ভোরের আকাশকে তিনি বলেন, ‘কাজটি সম্পূর্ণ শেষ করেই উপজেলা প্রশাসনকে বুঝে নিতে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বুঝে নেয়নি।’

নির্মাণ শেষ হলে আবারো কিসের কাজ করা হচ্ছে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন,‘ স্তম্ভটি বুঝে না নেওয়াতে অরক্ষিত থাকায় গেটগুলো ভেঙে গেছে। এগুলোসহ আরো কিছু কাজের জন্য ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। ফলে এখন এটি ঠিকঠাক করা হচ্ছে।’

নির্মাণ সম্পূর্ণ শেষ করার আগেই টাকা উত্তোলনের বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘তখন কাজ শেষ হওয়ার কারণে ঠিকাদার টাকা উত্তোলন করতে পেরেছে। এর চেয়ে বেশি কিছু আমার মনে নেই। নির্বাহী প্রকৌশলী স্যার সব বলতে পারবেন।’

এ বিষয়ে গণপূর্ত ময়মনসিংহ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদ আহসান দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, ‘আমি এখানে নতুন এসেছি। কি কারণে এমন হয়েছে তা জানার চেষ্টা চলছে। যদি নির্মাণকাজে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়ে থাকে তা হলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’