রাজধানীর শাহজাহানপুরে বৃহত্তর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু ও কলেজছাত্রী সামিয়া আফরান জামান প্রীতি হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ডদের খুঁজছে পুলিশ। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে শুটার মাসুম মোহাম্মদ আকাশ যেসব তথ্য দিয়েছেন, সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এছাড়া প্রযুক্তির ব্যবহার ও স্থানীয় সোর্সের সহায়তায় তদন্ত কাজ এগিয়ে যাচ্ছে বলে দাবি করেছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। তবে কাটআউট পদ্ধতিতে কন্ট্রাক্ট কিলারের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ায় পুলিশ ও গোয়েন্দাদের অনেক প্রশ্নের উত্তরই অধরা থাকছে।
এছাড়া হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রটি কোথায় আছে- গত ৫ দিনেও জানতে পারেননি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অস্ত্র ও মোটরসাইকেল উদ্ধারে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে- এমন বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। এদিকে গতকাল সোমবার আওয়ামী লীগ নেতা টিপু ও কলেজছাত্রী প্রীতি হত্যায় জড়িত শুটার মাসুমকে ৭ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন আদালত। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের অতিরিক্ত অ্যাডিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট (এসিএমএম) তোফাজ্জল হোসেন এ আদেশ দেন। আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হেমায়েত উদ্দিন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এর আগে মাসুমকে আদালতে হাজির করে ১৫ দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। আদালত উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে আসামিকে ৭ দিন রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দেন। ডিবি বলেছে, এ মাসুম ছিলেন ‘শুটার’, (যিনি জাহিদুলকে গুলি করেন)। তাকে ভাড়া করা হয়েছিল।
ডিবি জানায়, মুগদা-গোড়ান এলাকার শরীফ হত্যাসহ চার-পাঁচটি মামলার আসামি এ মাসুম। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ডিবিকে বলেছেন, শুধু টাকার জন্য তিনি এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত হন। গ্রাফিকস আর্টস নিয়ে লেখাপড়া করে মুগদা এলাকায় ক্যাবল টিভির ব্যবসা করতেন মাসুম। তার স্ত্রী ও সন্তান আছে। তার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে। গত বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ১০টায় রাজধানীর ব্যস্ততম সড়ক শাহজাহানপুরের আমতলা মসজিদ এলাকায় টিপুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ সময় এলোপাতাড়ি গুলিতে রিকশা আরোহী কলেজছাত্রী সামিয়া নিহত হন। তদন্তসংশ্লিষ্টরা দাবি করেন, আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ, স্থানীয় রাজনীতির বিরোধ এবং ব্যক্তিগত প্রতিহিংসাÑ এ তিনটি বিষয় এ হত্যার পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করেছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাহিদুলকে হত্যার নেপথ্যের ব্যক্তিরা যুবলীগকর্মী রিজভী হাসান ওরফে বোঁচা বাবু হত্যা মামলার আসামিদের ক্ষোভকে কাজে লাগান। বোঁচা বাবুকে ২০১৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর মতিঝিল এজিবি কলোনিতে গুলি করে হত্যা করা হয়। বাবুর বাবা আবুল কালাম হলেন জাহিদুল ইসলামের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। আর্থিকভাবে দুর্বল কালামকে সবসময় সহযোগিতা করতেন জাহিদুল। দুজন সবসময় একসঙ্গে থাকতেন। এমনকি জাহিদুলকে যখন হত্যা করা হয়, তখনো তার সঙ্গে গাড়িতে ছিলেন কালাম। বোঁচা বাবু হত্যা মামলার খরচও চালাতেন টিপু। এ কারণে আসামিরা ক্ষুব্ধ ছিলেন জাহিদুলের ওপর।
ওই মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিদের মধ্যে ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক ওরফে কানা ফারুক, তার সহযোগী নাসির উদ্দিন ও সুমন শিকদার ওরফে মুসা অন্যতম। কানা ফারুক, মুসাসহ অন্য আসামিরা জামিনে বেরিয়ে এসে মামলা মিটমাট বা বাদীর সঙ্গে আপস করার জন্য টিপুকে ধরেন। তিনি এতে রাজি না হওয়ায় তারা ব্যাপক ক্ষিপ্ত ছিলেন। এর মধ্যে ওমর ফারুক ওরফে কানা ফারুক মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতার মাধ্যমে তদবিরও করছিলেন। কানা ফারুকের ধারণা, এ হত্যা মামলার কারণে তিনি থানা কমিটির নেতা হতে পারছেন না এবং টিপুও সেটা চান না, তাই মামলা মিটমাট হচ্ছে না।
মুসা একসময় শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রকাশ-বিকাশ গ্রুপের ‘কিলার’ বা পেশাদার খুনি ছিলেন। পরে শাহজাহানপুর-খিলগাঁও এলাকার পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ ওরফে মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিকের হয়েও কাজ করতেন। কারাগারে যাওয়ার পর মুসার সঙ্গে কানা ফারুকের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মুসা ও নাসিরকে প্রথম উদ্বুদ্ধ করা হয় টিপুকে হত্যার জন্য। এ হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দুজনের ভূমিকা রয়েছে বলে তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাকে খুঁজছে র্যাব ও পুলিশ। টিপু হত্যার পরিকল্পনা, খুনি ভাড়া করা ও অস্ত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে কাইল্যা পলাশের ভূমিকা ছিল বলে তথ্য পেয়েছে তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র।
ওই সূত্র আরো জানায়, জাহিদুলকে হত্যার পরপর কাইল্যা পলাশ মুঠোফোনে মানিকের সঙ্গে প্রায় আধাঘণ্টা কথা বলেন। এরপর আরো কয়েক দফায় মোট প্রায় ২ ঘণ্টা তাদের মধ্যে কথোপকথনের তথ্য পাওয়া গেছে। হত্যা পরিকল্পনার পর জাহিদুলের গতিবিধি অনুসরণ করতেন বোঁচা বাবু হত্যার আরেক আসামি নাসির উদ্দিন। তিনি ঘটনার দিন কিছুক্ষণ পরপর মুসাকে জাহিদুলের অবস্থান জানান, তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে সে তথ্যও পাওয়া গেছে বলে জানা যায়। বোঁচা বাবুর হত্যার অন্যতম কারণও ছিল কুরবানির পশুর চামড়ার ব্যবসা নিয়ে নাসিরের সঙ্গে বাবুর বিরোধ। এখন কানা ফারুক, কাইল্যা পলাশ, নাসির ও মুসাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টায় আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ বিষয়ে অগ্রগতি আছে বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা।
পুলিশ জানায়, আওয়ামী লীগ নেতা টিপু ও কলেজ শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় অভিযুক্ত শুটার মাসুম মোহাম্মদ আকাশ গ্রেপ্তার হয়েছে। কিন্তু হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত পিস্তলটি এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ‘কাটআউট পদ্ধতিতে’ খুনি ভাড়া করে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হওয়ায় গ্রেপ্তার মাসুম এখন পর্যন্ত এ হত্যাকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে কিছু জানাতে পারেননি। তবে গোয়েন্দারা এরই মধ্যে এ ঘটনার পেছনে ইন্ধনদাতাদের বিষয়ে জানতে পেরেছেন। একাধিক ব্যক্তি গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছেন। গোয়েন্দা সূত্রে আরো জানা গেছে, গ্রেপ্তার মাসুম অস্ত্রটি কাদের কাছ থেকে পেয়েছে, সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত বিস্তারিত কিছু জানাতে পারেনি। তবে ঘটনার আগের দিন হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও পিস্তল মতিঝিলের এজিবি কলোনি থেকে সংগ্রহ করেন তিনি। ঘটনা ঘটানোর পর গোড়ান এলাকায় মোটরসাইকেল ও পিস্তল অজ্ঞাত ব্যক্তির কথামতো রেখে আসেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা দাবি করেন, গ্রেপ্তার মাসুমকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডে প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করা হবে এবং এ ঘটনার পেছনের ইন্ধনদাতাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মাসুম জানান, যাদের জন্য তিনি এ ঘটনা ঘটিয়েছেন, তাদের কাউকেই সে চেনে না। ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় অপেক্ষমাণ মোটরসাইকেল চালকের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের কন্ট্রাক পান তিনি। তিনিই মোটরসাইকেল চালকের পরিচয় শনাক্ত করে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে এখনই মোটরসাইকেল চালকের পরিচয় সম্পর্কে কিছু বলছেন না কর্মকর্তারা।
মাসুমের বরাতে গোয়েন্দারা বলছেন, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রটি অত্যাধুনিক। পিস্তলটিতে ১২ রাউন্ড গুলি ছিল। ঘটনার সময় জাহিদুল ইসলাম টিপুকে উদ্দেশ করে ম্যাগাজিন ভর্তি ১২টি গুলি ছুড়ে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান তিনি। পিস্তলটি কাদের মাধ্যমে তার হাতে এসেছে, এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এছাড়া মাসুম মোটরসাইকেল ও পিস্তল অজ্ঞাত ব্যক্তির কথা মতো এজিবি কলোনির যে জায়গা থেকে সংগ্রহ করেছিল, সে জায়গার আশপাশের এলাকায় খোঁজখবর নিচ্ছেন গোয়েন্দারা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মাসুম গোয়েন্দাদের কাছে এ ঘটনার জন্য অনুতপ্ত বলে জানিয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিএমপি মতিঝিল গোয়েন্দা বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার রিফাত রহমান শামীম বলেন, হত্যায় ব্যবহৃত পিস্তলটি উদ্ধারে তৎপর রয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। মতিঝিল গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার পদমর্যাদার চারজন কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজন এ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে কাজ করে যাচ্ছেন।