বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তীকে কেন্দ্র করে ১০ দিনব্যাপী উৎসব আয়োজন চলছে। এই উৎসব আয়োজনের একটি অভূতপূর্ব অভিনব ও অসাধারণ দিক হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সংযুক্তি। দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি বন্ধুরাষ্ট্রে সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সরাসরি বাংলাদেশ সফর ও চীন থেকে শুরু করে কানাডা পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রসমূহের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ৫০ বছরপূর্তিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি এক বিরল সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও বাঙালির বীরত্ব একসূত্রে গাঁথা। এর স্বীকৃতি যেমন গোটা বিশ্ব ১৯৭১ সালে দিয়েছিল এবং তেমনি ২০২২ সালেও অবারিত ও টুপি খোলা অভিনন্দন জ্ঞাপন করছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতির জন্য উৎসব আয়োজন অনন্যসাধারণ গুরুত্ব বহন করে। ১৯৭৩ সালে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিডেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছিলেন, আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বে, সাহসিকতায় ও নেতৃত্বে হিমালয়ের প্রতিফলন দেখতে পাই। ফিডেল ক্যাস্ট্রোর এই অকপট ও অবনত উচ্চারণ বঙ্গবন্ধুর প্রতি বৈশি^ক স্বীকৃতির প্রকাশ। ইউনেসকো কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের বিশ্ব ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিলের অন্তর্ভুক্তি বঙ্গবন্ধুকে সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসে অন্যতম প্রেরণাদায়ী, সাহসী, সফল ও মানবতাবাদী নেতা হিসেবে উপস্থাপিত করে। তাই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে করেছে আরো মহিমান্বিত, আরো স্মরণীয়। এই উৎসব আয়োজনে বিশ্বনেতাদের বাংলাদেশ সফর ও সংযুক্তি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কটি এক নতুন ব্যঞ্জনা ও বহুমাত্রিকতার মাধ্যমে আমাদের সামনে উপস্থাপিত বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান ঐতিহাসিক ও গৌরবময়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুকে গান্ধী শান্তি পুরস্কাওে ভূষিত করে সম্প্রতি ভারত আবারো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বঙ্গবন্ধুর বিশালতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। স্বাধীনতার উৎসব আয়োজনের সঙ্গে ভারতের সংযুক্তির এক নতুন মাত্রা উপহার দিল। ইতোমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল ও ভুটানের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা স্বাধীনতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উৎসব আয়োজনে সরাসরি উপস্থিত থেকে নিজ নিজ দেশে ফেরত যান। বিশ্বের অন্যান্য দেশের নেতৃবৃন্দ ভিডিও মাধ্যমে বক্তব্য দেন, অভিনব ও অনন্যসাধারণ এ উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশ উৎসব কূটনীতির এক নতুন দিক উন্মোচিত করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বিষয়ে মতবিনিময় সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা ও জ্ঞান বিনিময়, জ্বালানি সহযোগিতা, আঞ্চলিক কালেকটিভিটি ও পর্যটনসহ বিভিন্ন খাতে পারস্পরিক সহযোগিতার এক নতুন সুযোগ তৈরি করেছে। উৎসবের এই কূটনীতির একটি বলিষ্ঠ দিক হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নতুন যাত্রাপথ, নতুন ঠিকানা।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর এবং দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন মাইলফলক। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর একাধিকবার শীর্ষ বৈঠক ও সাক্ষাতের ঘটনা ঘটেছে। জাতিসংঘের করিডর কূটনীতি থেকে শুরু করে দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক আগমন ও দুই প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ ঘটেছে এক মাহেন্দ্রক্ষণে, যা একদিকে বাঙালি জাতির ইতিহাসে অবিস্মরণীয়, অন্যদিকে বাংলাদেশের বৈশ্বিক কূটনীতিতে সীমাহীন তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক গত প্রায় এক যুগ ধরে গভীর থেকে গভীরতর ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হয়েছে এবং উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হয়েছে। বাণিজ্য, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, অবকাঠামো, সীমান্ত সংযোগ, সাংস্কৃতিক, বিনিয়োগ, পর্যটন ও প্রতিরক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারত ব্যাপক অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতার নজিরবিহীন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সমঝোতা স্মারক ও ঘোষণাপত্রসমূহ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্রমাগত শক্তিশালী করেছে। দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কাঠামোকে করেছে বহুমাত্রিক। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভাষায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সমসাময়িক বিশ্বের প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের জন্য একটি সফল উদাহরণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ২০১৫ সালে মুজিব-ইন্দিরা স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন দুই দেশের সমুদ্রসীমানা বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ব্যাপক প্রসার দ্বিপক্ষীয় ও উপ-আঞ্চলিক সংযোগ বৃদ্ধি, বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে ভারতের অর্থঋণ সহায়তা, জ্বালানি বাণিজ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে সম্পর্কের ব্যাপক উন্নয়ন। সম্প্রতি ফেনী নদীতে ১.৯ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে ত্রিপুরার সব্রুম ও বাংলাদেশের রাজগড়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে। পারস্পরিক সহযোগিতার ব্যাপক উন্নয়ন ও প্রসারের প্রেক্ষাপটে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফর করেন।
প্রধানমন্ত্রী মোদির এই সফরের উপলক্ষ আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে যুক্ত হলেও দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠক বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের জন্য অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে। করোনাকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রথম বিদেশ সফর করেন বাংলাদেশে। উপলক্ষটি হলো বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে উৎসব আয়োজনে যোগদান। অর্থাৎ বাংলাদেশের উৎসব কূটনীতির অন্যতম আকর্ষণ হয়ে ওঠে ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সফরটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধুর ভারতনীতিতে ফিরে যাওয়ার উপলক্ষ তৈরি করে। মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের নানামুখী অবদান সামনে উঠে আসে একে ঘিরে। ২৫ মার্চের পাকিস্তানি সামরিক জান্তা কর্তৃক গণহত্যার ব্যাপক নিন্দা জানিয়ে ভারতীয় লোকসভায় প্রস্তাব গ্রহণ, ১ কোটির বেশি বাঙালি শরণার্থীদের আশ্রয়দান, বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতের রাজ্যসমূহের জনমানুষের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি একাত্মতা, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি বিষয়ে শক্তিশালী কূটনৈতিক তৎপরতা ভারতীয় সৈন্যদের মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগ এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পূর্বেই স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সৈন্য প্রত্যাহার ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে সহায়তা বাংলাদেশের জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ইতিহাসের ভিত্তিমূলে দাঁড়িয়ে এবং বর্তমানের অংশীদারিত্বের সম্পর্কের বহমানতায় বাংলাদেশ ও ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ একটি অনন্যসাধারণ ঘটনা। বাংলাদেশের গত এক দশকে অর্থনীতি ও সামাজিক খাতে বিস্ময়কর সাফল্য ও দক্ষিণ এশিয়া ও বঙ্গোপসাগর অঞ্চলকে কেন্দ করে নয়া ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের কূটনীতির নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয়। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে শুধু দ্বিপাক্ষিকতার বেড়াজালে কিংবা কাঠামোতে আবদ্ধ রাখলে চলবে না। বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে সম্পকর্কে আরো শক্তিশালী ও গতিময় করার জন্য সীমান্ত সমস্যা, পানি বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা, রোহিঙ্গা সংকট, উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ ও বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং ভারতীয় ঋণ-সহায়তার দ্রুত অর্থ ছাড়াসহ বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো তুলে ধরে। তবে দ্বিপক্ষীয় কূটনীতির সীমানা পেরিয়ে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিম-লে বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার ও বন্ধুরাষ্ট্রসমূহের জন্য বিশেষ বার্তা বহন করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বঙ্গবন্ধুর টুঙ্গিপাড়াস্থ সমাধিস্থল পরিদর্শন ও একাধিক মন্দির দর্শন দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সম্প্রীতির এক অপূর্ব মেলবন্ধন হিসেবে কাজ করে। অসাম্প্রদায়িকতা, উদার মূল্যবোধ ও ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বিশ্বব্যাপী সুনাম রয়েছে। উগ্রবাদী ও মৌলবাদী গোষ্ঠীসমূহের শত উসকানি কিংবা হুমকি সত্ত্বেও বাংলাদেশ শান্তি ও সহযোগিতার কূটনীতিকে সবার ঊর্ধ্বে তুলে ধরছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের চ্যালেঞ্জগুলো সফলভাবে মোকাবিলা করে আরো শক্তিশালী অংশীদারিত্বমূলক ভিত্তি রচনা করতে হবে। বিশ্বব্যাপী নয়া ঠান্ডা লড়াইয়ের ডামাডোল, দক্ষিণ এশিয়া ও বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে চীন ও অন্য দেশসমূহের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের গুরুত্বকে বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত কূটনৈতিক মন্ত্র ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’- এর ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এগিয়ে চলছে।
অর্থনীতি, সামাজিক, কৃষিসহ বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ খাতে ব্যাপক সাফল্যের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে ঈর্ষণীয় কূটনৈতিক সাফল্য, বিশেষ করে বিশ্বের সব শক্তিশালী রাষ্ট্র ও সংস্থার সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশের ভারসাম্যপূর্ণ ও অর্থবহ দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্ক। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিক সাফল্যের সঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে বাংলাদেশ ও ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরো শানিত, গতিশীল ও আস্থাপূর্ণ করে তুলবে। কূটনৈতিক বোঝাপড়া, পারস্পরিক বন্ধুত্ব এবং শান্তি ও উন্নয়নের পথে একসঙ্গে এগিয়ে চলার প্রেরণা জোগাবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসব আয়োজন এবং উৎসবের কূটনীতি।
লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের সদস্য