১৯৭৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ভূতত্ত্ব বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র বীরেন্দ্র হত্যার ঘটনার মামলার নিষ্পত্তি হয়নি ৪৪ বছরেও। আলোচিত এ মামলাটির বিচার থেমে আছে নিদারুন অবহেলায়।
মামলার নথিপত্র ও আদালতের কর্মচারীদের কাছ থেকে জানা গেছে, বীরেন্দ্র কুমার সরকার হত্যা মামলায় বিচার শুরুর পর গত ৪৪ বছরে বিচারপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছেন ৩৪ জন বিচারক।
মামলাটি পাঁচটি আদালত ঘুরে এ আদালতে এসেছে। এর মধ্যে মামলার আট সাক্ষীর মধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনজন। বাদীসহ বাকি পাঁচ সাক্ষীকে আদালতে হাজির করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ।
বছরের পর বছর রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করার জন্য আদালতের কাছে সময় চেয়ে আবেদন করে চলেছে। আর সাক্ষী হাজির করতে অন্তত ছয়বার পুলিশ মহাপরিদর্শকসহ সংশ্লিষ্ট থানায় চিঠি পাঠিয়েছেন আদালত।
অনুপস্থিত সাক্ষীদের বিরুদ্ধে অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে। ২০১৪ সালে এক আদেশে আদালত বলেছেন, সাক্ষীদের হাজির করতে রাষ্ট্রপক্ষ আন্তরিক নয়। এভাবে চলতে পারে না।
এর আগে এ মামলার বিচারের দায়িত্বে থাকা বিচারক বাসুদেব রায় সাক্ষী আনার জন্য এবং মামলার গতি সচল করার জন্য অনেক মতামত ও উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে মামলার নথিতে দেখা যায়।
মামলার বিচার এখন থেমে আছে ঢাকার ৩ নম্বর বিশেষ জজ মো. আলী হোসাইনের আদালতে । বিশেষ দায়রা মামলা ০৫/২০১২ নম্বরের এ মামলাটিতে গত তারিখ নির্ধারিত ছিল ১২ জানুয়ারি আর পরের তারিখ ২১ এপ্রিলে।
মামলার নথি সূত্রে জানা যায়, প্রেমসংক্রান্ত বিরোধের জেরে রণজিৎ কুমার মজুমদার নামে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের তারই আবাসিক হলের এক ছাত্র তাকে হত্যা করেন। ওই ঘটনায় হত্যা মামলা হলেও আসামি কখনো গ্রেপ্তার হননি। শেষ হয়নি বীরেন্দ্র হত্যার বিচারও।
মামলার অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, শিলা নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী তখন রোকেয়া হলে থাকতেন। রণজিতের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। পরে বীরেন্দ্রর সঙ্গে শীলার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি রণজিত।
তাই পরিকল্পনা করে একদিন জগন্নাথ হলে বীরেন্দ্রকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যান রণজিৎ। তার বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে। খুনের পর ভারতে পালিয়ে যান তিনি। রনজিতের বাবা ছিলেন তার এলাকায় প্রতিষ্ঠিত একজন চিকিৎসক। হত্যাকাণ্ডের পর তারাও সবাই ভারতে চলে যান।
হত্যাকাণ্ডের পর রণজিতের নামে জগন্নাথ হলের আবাসিক শিক্ষক অধ্যাপক জপব্রত রায় চৌধুরী রমনা থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ১৯৭৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় হলের উত্তর পাশের দোতলায় সিঁড়িতে সন্ধ্যার সময় বীরেন্দ্রকে ছুরিকাঘাত করা হয়।
তখন গুরুতর জখম বীরেন্দ্র চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘রণজিৎ আমাকে মেরে ফেলল।’ পরে হলের তৎকালীন আবাসিক ছাত্র স্বপন কুমার রায় বীরেন্দ্রকে রিকশায় করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। কর্তব্যরত চিকিৎসক বীরেন্দ্রকে মৃত ঘোষণা করেন।
বীরেন্দ্র খুন হওয়ার মাত্র দুই মাস পর (১৯৭৭ সালের ১ ডিসেম্বর) রণজিতের নামে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় রমনা থানা-পুলিশ। মামলার নথিপত্রে দেখা যায়, এর ১১ বছরের মাথায় ১৯৮৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রণজিতের বিরুদ্ধে আদালত অভিযোগ গঠন করে মামলাটিতে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন।
অভিযোগ গঠনের ২১ বছর পর (২০০৯ সালের ৩ আগস্ট) মামলার দুজন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দেন। তারা হলেন জগন্নাথ হলের তৎকালীন আবাসিক ছাত্র সজল কান্তি মণ্ডল ও আশিস কুমার পাল।
এই দুজন সাক্ষ্য দেওয়ার পাঁচ বছর পর (২০১৪ সালের ৩ জুলাই) মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই খোরশেদ আলম আদালতে সাক্ষ্য দেন। এরপর গত ছয় বছরে একজন সাক্ষীকেও আদালতে হাজির করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা মামলার বিচারের হাল নিয়ে দায় চাপান পুলিশ প্রশাসনের ওপর। তারা বলেন, পুলিশ আন্তরিক হলে সাক্ষী আনা যেত , অথবা সাক্ষী আনা না গেলে তার কারণ জানা যেত।
এ মামলার বিচারের নাজুক অবস্থা নিয়ে ঢাকার ফৌজদারি মামলার অভিজ্ঞ জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা বলেছেন, মামলার ভারে ভারক্রান্ত ঢাকার আদালতে এ মামলাই আমাদের জানা মতে সবচেয়ে পুরানো যার ভাগ্য এখানো নির্ধারিত হয়নি।
এ মামলার থেকে বয়সে কম আরো হত্যা মামলা বিশেষত এর আগে সরকার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে রয়েছে আরো অনেকগুলো মামলা যেগুলোও যুগের পর যুগ চলে গেলেও বিচারকাজের নিষ্পত্তি হয়নি। এভাবে চললে বিচার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে পারে।
২০১২ সালের ১ নভেম্বর সর্বশেষ ঢাকার চতুর্থ মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে এ আদালতে মামলাটি বিচারের জন্য স্থানান্তরিত হয়। নথিতে দেখা যায়, ৩৭ বছর বিচার চলাকালীন সময়ে রাষ্ট্রপক্ষ মামলার কেইস ডকেট পিপির কার্যালয় থেকে সংগ্রহ করেননি।
১৯৯৯ সালে মহানগর দায়রা জজ আদালত গঠনের পর থেকে যেসব কেইস ডকেট সংগ্রহ করা হয়েছে তার মধ্যে বীরেন্দ্র হত্যা মামলা নেই বলে ঢাকার বর্তমান মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান কৌশুলি আবদুল্লাহ আবুর স্বাক্ষরিত বিচারকের কাছে দাখিল করা একটি আবেদন থেকে জানা গেছে।
এ মামলার কচ্ছপ গতি নিয়ে মতামত দানকারী আইনজীবীরা বলেছেন , এগুলো অবহেলার নিকৃষ্ট নজির। মামলায় যে পাঁচজন সাক্ষ্য দেননি তারা হলেন, জগন্নাথ হলের তৎকালীন আবাসিক শিক্ষক জপব্রত চৌধুরী, হলের তৎকালীন আবাসিক ছাত্র স্বপন কুমার রায়, সচিন্দ্র চন্দ্র ঘোষ, শীষ মোহাম্মদ ও রমনা থানার তৎকালীন এএসআই ও মামলার রেকর্ডিং অফিসার আবদুল বারী।
পুলিশ আদালতে দাখিল করা প্রতিবেদনে বলেছে, বাদী যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। বাকি সাক্ষীদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এ আদালতের সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রপক্ষে কৌশুলি রফিক উদ্দিন ভোরের আকাশকে বলেন, সাক্ষীদের ঠিকানায় পাওয়া গেল কিনা অথবা তারা মৃত, জীবীত কোনো তথ্যই পুলিশ প্রশাসনের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। এটা খুব দুঃখজনক।
ভোরের আকাশের একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মামলা নিষ্পত্তিতে বিচারিক প্রক্রিয়া মানতে হয়। সে কারণে কিছু করা যাচ্ছে না।
অ্যাক্টিভিস্ট ও আইনজীবী জীবনানন্দ চন্দ জয়ন্ত বলেন, 'মামলাটি নিস্পত্তিতে রাষ্ট্রপক্ষের আন্তরিকতা আছে কি না সেটিই এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য। আন্তরিকতা থাকলে এমন একটি হত্যা মামলা যুগের পর যুগ চলতে পারেনা।
১৯৮৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রণজিতের বিরুদ্ধে আদালত অভিযোগ গঠন করে মামলাটিতে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন। অভিযোগ গঠনের ২১ বছর পর (২০০৯ সালের ৩ আগস্ট) মামলার দুজন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দেন।
পরবর্তীতে মামলাটি বদলী হয়ে আসে বিশেষ জজ আদালতে ইতোমধ্যে সেখানেও কেটে গেছে এক যুগ। এখনো মামলার পাঁচ সাক্ষির সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়নি। কাজেই রাষ্ট্রপক্ষের আন্তরিকতা প্রশ্নসাপেক্ষ। এ ধরনের প্রবণতা
বিচারহীনতার সংস্কৃতিকেই হৃষ্টপুষ্ট করছে যুগ যুগ ধরে। এই মুহূর্তে দ্রুততার সাথে নিষ্পত্তি করা গেলে আইনাঙ্গণের প্রতি মানুষের যে আস্থার সঙ্কট তৈরি হচ্ছে তা কিছুটা হলেও প্রশমিত হবে। একইসঙ্গে সকল ঘটনায় সমান বিচারিক মনোভাব প্রয়োগ করতে হবে, যা সচরাচর দেখা যায় না- এ গল্পের শেষ হওয়া প্রয়োজন।"
ফৌজদারী মামলা বিষয়ে জেষ্ঠ্য আইনজীবী আমিনুল গণী টিটো বলেন, "পুলিশ আন্তরিক হলে সাক্ষী আদালতে আনা তেমন কোন ঘটনা নয়। এ মামলাটির বিচারের এ কাহিনী বিচারাঙ্গণে কোন শুভ লক্ষণ নয়।"
এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ ও তথ্য বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. জাফর হোসেন বিষয়টি তিনি খোঁজখবর নেবেন। আদালতের আদেশ অনুযায়ী সাক্ষীদের হাজির করানোর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। তিনি এ প্রতিবেদকের কাছ থেকে মামলার নম্বর সংগ্রহ করেন।
মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান কৌশুলি আবদুল্লাহ আবু মামলাটির বিচার নিয়ে ভোরের আকাশের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, "আমি দায়িত্বে অবহেলা করি না।
আমাকে এ বিষয়ে কেউ কিছু জানায়নি। আর জানালেও ভুলে গেছি।" অথচ এই আইনজীবী এর আগে সাক্ষ্য নিয়ে বিচারকের অনুসন্ধানের উত্তর দিয়েছিলেন।