আলমগীর হোসেন (৪৮)। লেখাপড়া একদমই করেননি। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া এক টুকরো জমিতে ঝুপড়িঘরে স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে বসবাস করেন তিনি। অবলম্বন বলতে শুধু আছে একটি ভ্যান আর রেললাইনের ধারে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান।
স্ত্রী দেলোয়ারা বেগম (৪৫) রেললাইনের ধারে ওই ছোট্ট চায়ের দোকান চালান। আর ভ্যান চালান আলমগীর হোসেন। এখান থেকে উপার্জিত অর্থে চলে তাদের সংসার।
তবে স্বেচ্ছা শ্রমে নীলফামারী সদরে সোনারায় ইউনিয়নের দারোয়ানী স্টেশনের অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে যাত্রী পারাপারে কাজ করেন আলমগীর হোসেন।
জানা গেছে, প্রায় একমাস আগে ওই অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে অটোরিকশার চার যাত্রী নিহত হয়। নিহতরা উত্তরা ইপিজেডের নারী শ্রমিক। এ সময় চালকসহ আহত হন চারজন। ট্রেন দুর্ঘটনায় চোখের সামনে এত মানুষের মৃত্যু মনে দাগ কাটে আলমগীর হোসেনের।
এরপর স্বেচ্ছায় মানুষের পারাপারের দায়িত্ব নেন আলমগীর। ঘটনার পরদিন ট্রেন আসার আগে বাঁশ দিয়ে রেলক্রসিংয়ের দুপাশে ব্যারিকেডের ব্যবস্থা করেন তিনি। প্রতিদিন ট্রেন আসার আগে ব্যারিকেড দিয়ে রেলক্রসিং পাহারা দেন আলমগীর। তার এমন দায়িত্ব পালনে সন্তুষ্ট নিজের পরিবার ও এলাকার মানুষ।
আলমগীর বলেন, ‘চোখের সামনোত ইজিবাইকে ট্রেনের ধাক্কায় উত্তরা ইপিজেডের চারজন নারী শ্রমিক মইল, আরো চাইর জনের ট্যাং পাও ভাঙ্গিয়া পঙ্গু হয়া পড়ি আছে। সেটা চোখে দেখে নিজের আড়াবাড়ী (বাঁশঝাড়) থাকি দুইটা বাঁশ কাটি আনি, পরদিন ভোর থাকি গেটোত পাহারা দেওয়া শুরু করনু।’
অভাবের সংসার হলেও স্বেচ্ছায় ওই কাজে আপত্তি নেই আলমগীরের। তিনি বলেন, ‘সবার উচিত সরকারকে সহযোগিতা করা। মানুষে কয় দেশে অসংখ্য ল্যাংটা রেলক্রসিং আছে, এসব রেলক্রসিং পারাপারে এলাকার মানুষ দায়িত্ব পালন করলে রক্ষা পাবে অনেক জীবন।’
আলমগীর জানান, ভোর ৫টার দিকে খুলনা থেকে চিলাহাটিগামী সীমান্ত একপ্রেস ট্রেন ওই রেলক্রসিং পেরিয়ে চলে যায় চিলাহাটির উদ্দেশে, তখন রেলক্রসিং পারাপারে উত্তরা ইপিজেড শ্রমিকদের ভিড় হয়। এরপর সকাল ৭টার দিকে নীলফামারী থেকে রাজশাহীর উদ্দেশে বরেন্দ্র এক্সপ্রেস, সকাল ৮টার দিকে খুলনার উদ্দেশে খুলনা মেইল, সাড়ে ৮টার দিকে একই উদ্দেশে রূপসা এক্সপ্রেস, দুপুর ১২টার দিকে রাজশাহী থেকে চিলাহাটির উদ্দেশে তিতুমীর এক্সপ্রেস চলে।
অপরদিকে ওই রেলগেট দিয়ে বিকেল ৩টার দিকে রাজশাহীর উদ্দেশে ফিরতি তিতুমীর, বিকেল ৪টা থেকে সাড়ে ৪টার দিকে ঢাকা থেকে চিলাহাটির উদ্দেশে নীলসাগর এক্সপ্রেস, রাত ৯টার দিকে রাজশাহী থেকে চিলাহাটির উদ্দেশে বরেন্দ্র এক্সপ্রেস এবং এর আগে-পিছে ঢাকার উদ্দেশে নীলসাগর এসপ্রেস ট্রেনটি চলাচল করে।
আলমগীর বলেন, ‘হাতোত ঘড়ি নাইতা কি হইছে, লাইনের ধারত বাড়ি, যেইঠে থাকো না কেন ট্রেনের হুইসেল পাইলে হাজির হও রেলগেটোত। ওইটা শুনিয়া মুই বাঁশ দিয়া গেট বন্ধ করো। ট্রেন যাওয়ার পর খুলি দেও। এলাকার মানুষ ভালোই কয়। এতে কারো কোনো আপত্তি নাই।’
স্ত্রী দেলোয়ারা বেগম বলেন, ‘মোর স্বামী রেলগেটের পাহাড়ারাত যেয়া ভ্যানের ভাড়া নিয়া এখন শহরোত যাবার পারে না। এতে কিছুটা কামাই (আয়) কমেছে। এ জন্য ছেলেদের নিয়ে বাড়ির কাজের পাশাপাশি ট্রেন লাইনের ধারোত চায়ের দোকান করি।’
সোনারায় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম শাহ বলেন, ‘ওই গেটটি মানুষ মারার ফাঁদ। নিঃসন্দেহে আলমগীরের এটি একটি মানবিক কাজ। তার মতো একজন ভ্যানচালক নিজের ইচ্ছায় এ কাজ করছে। এটি সমাজের উদাহরণ। এ জন্য পরিষদের পক্ষে সার্বিক সহযোগিতা থাকবে।’
সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শাহিদ মাহমুদ বলেন, ‘রেলগেটের দুই পাশের সড়কে আরসিসি পিলারের জন্য আবেদন করা হয়েছিল। সেটি উপজেলা পরিষদ থেকে দেওয়া হবে। আর আলমগীর নিম্নআয়ের মানুষ হওয়ায় সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কর্মসূচি থেকে নিয়মিত সহযোগিতার জন্য সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানকে বলা হয়েছে।’
নীলফামারী স্টেশনের মাস্টার ওবায়দুল রহমান রতন বলেন, ‘ওই রেলক্রসিং অতিক্রম করে চিলাহাটি থেকে রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা পর্যন্ত প্রতিদিন ১২টি ট্রেন চলাচল করে। দুর্ঘটনা রোধে দারোয়ানী স্টেশনের কাছে অরক্ষিত একটি রেলগেটে আলমগীর নামে এক ব্যক্তির দায়িত্ব পালনের কথা শুনেছি। তিনি নিজ দায়িত্বে সে কাজটি করছেন।’
রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল পাকশী ডিভিশনের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিইএন-২) আব্দুর রহিম জানান, দারোয়ানীতে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে গেট কিপারের দায়িত্ব পালনে ভ্যানচালক আলমগীর হোসেনের এমন মানবিক দায়িত্ববোধ সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। অরক্ষিত ওই লেভেল ক্রসিংয়ে ব্যারিয়ার স্থাপনসহ নির্বিঘ্নে পথচারী ও যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা গ্রহণ করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।
নীলফামারী জেলায় রেলপথ রয়েছে ৬৩ কিলোমিটার। এ পথে মোট রেলক্রসিং আছে ৩৮টি। এসব রেলক্রসিংয়ের মধ্যে বৈধ ৩৬টি। এর মধ্যে গেটম্যান আছে ১২টিতে। বাকি ২৪টি অরক্ষিত। ফলে জেলায় দুর্ঘটনায় একের পর এক বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল।