আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার মতোই লাক মিয়ার উত্থান। বৈধ-অবৈধ নানা পথে হেঁটে নিজের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করেছেন রাতারাতি। নুন আনতে পানতা ফুরানো সংসারের লাক মিয়া এখন আড়াইহাজারের নব্য ধনকুবের।
ক্ষমতার স্বাদ নিচ্ছেন সবসময়। স্থানীয় রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য কোনো নেতা না হলেও উপজেলা পর্যায়ে রয়েছে তার ব্যাপক প্রভাব। তার কথার বাইরে যান না প্রভাবশালী কেউ। তার কথা মেনেই রাজনীতি করতে হয় নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে, এমনটিই জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের উজান গোপন্দী গ্রামের এক হতদরিদ্র পরিবারে লাক মিয়ার জন্ম। পিতা সাবেদ আলী ছিলেন দিনমজুর। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা ছিল সংসারে। তাই স্কুলের গণ্ডি পেরুনো হয়নি লাক মিয়াসহ তাদের পাঁচ ভাই-এক বোনের।
এলাকার লোকজন জানান, একটি ঝুপড়ি ঘরে থাকতেন তাদের আট সদস্যের পরিবার। দুবেলা ঠিকমতো খাবারও জুটত না। শুধু সাবেদ আলীর মজুরির টাকায় সংসার চালানো ছিল কঠিন। প্রতিবেশীদের সহযোগিতা আর চেয়ে-চিন্তে জুটত লাক মিয়াদের খাবার।
এই তো সেদিনের গল্প। বছর কুড়ি আগেও দিনমজুর হিসেবেই কাজ করতেন সাবেদ আলী। বাবার সঙ্গে কাজ করতেন বড় ছেলে জয়নালও। কৃষিকাজ করার মতো নিজেদের তেমন কোনো জায়গা ছিল না। অন্যের জমি চাষ করেই সংসার চলত তাদের।
ওই সময়ে বড় ভাই জয়নাল শুরু করেন কাপড়ের ব্যবসা। জয়নাল, রুপ মিয়া রুহুলের সঙ্গে ওই সময়ে কাজে যোগ দেন লাক মিয়া। তাঁতিদের সুতা কিনে দিয়ে কাপড় বুনতে দিতেন। তারপর সেই সাদা কাপড় বিক্রি করতেন কারখানায়। অভিযোগ রয়েছে, ওই সময় থেকেই বেপরোয়া ছিলেন লাক মিয়া। তার হাত ধরেই নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠে মাদক বাণিজ্য। তার স্ত্রী ফারহানা সরকার নিজেই এই অভিযোগ করে জানান, লাক মিয়া নিজেও ফেনসিডিল সেবন করেন। সুসম্পর্ক থাকাকালে অনেক চেষ্টা করেও তাকে মাদক সেবন থেকে বিরত রাখা যায়নি।
আরো পড়ুন: মূর্তিমান আতঙ্ক লাক মিয়া
এলাকাবাসী জানান, শুরু থেকেই পাঁচ ভাইকে ভয় পেতেন এলাকার সাধারণ মানুষ। কথায় কথায় ঝগড়া-ফ্যাসাদে জড়াতেন তারা। অল্পসময়ে বৈধ-অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে পরিবারে সচ্ছলতা আসে। সমৃদ্ধ হতে থাকে তাদের আর্থিক অবস্থা। ওই সময়ে জমি জবরদখল শুরু করেন লাক মিয়া। এলাকার কিছু তরুণ ও জাল-জালিয়াতিতে অভিজ্ঞদের সমন্বয়ে গড়ে তোলেন একটি চক্র। একে একে গড়ে তোলেন সাবেদ আলী স্পিনিং মিল, ভাই ভাই মিলসহ অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান।
ব্রাহ্মন্দী এলাকার উজান গোপন্দী ও আশপাশের এলাকায় যতদূর চোখ যায়- শুধু লাক মিয়া ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে রাখা জমি। ২০১১ সালে প্রথমবার ব্রাহ্মন্দী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দাঁড়িয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন লাক মিয়া। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবার পর লাক মিয়া হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। তখন নিজেদের বাড়ি ও মিলের আশপাশে কোনো গরিব লোককে রাখতে চাইতেন না লাক মিয়া। এতে নিজের বিলাসবহুল বাড়ির সৌন্দর্য প্রকাশ পাবে না বলেই মনে করেন তিনি। এমনটিই জানিয়েছেন এলাকার লোকজন।
টানা তিনবার ব্রাহ্মন্দী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন লাক মিয়া। গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় আবারো চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। অনেকেই প্রার্থী হতে মাঠে নেমেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাঠে কেউ থাকতে পারেননি। নির্বাচন থেকে কেন সরে গেলেন এমন প্রশ্নের জবাব দিতেও ভয় পান তারা।
তবে এলাকার লোকজন জানান, কাউকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে, কাউকে হুমকি-ধমকি দিয়ে নির্বাচনের মাঠ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন লাক মিয়া। তার রয়েছে ক্যাডার বাহিনী। রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার এমনকি নরসিংদী, মাধবদী, ভেলানগর এলাকায়ও রয়েছে তার বাহিনীর লোকজন।
লাক মিয়ার ক্যাডারদের মধ্যে অন্যতম তার ভাতিজা নাঈম হাসান (২৯)। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে স্কুলছাত্রী ধর্ষণ মামলায় তাকে সম্প্রতি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেছেন আদালত। একইভাবে তার ক্যাডার হিসেবে পরিচিত ফারুক মিয়া, শুভ বিশ্বাস, আব্দুল মজিদ, সন্দিপ চন্দ্র দাস, শফি উল্লাহ, খালেকুজ্জামান ভূইয়া, মধাবদীর রাজনসহ আরো অনেকের নামে রয়েছে মামলা। এমনকি প্রতারণা-চেক ডিজঅনার মামলায় একবার কারাবন্দি হয়েছেন লাক মিয়া নিজেও।
আরো পড়ুন: মদ, নারী ও সম্পদের নেশা লাক মিয়ার
২০০৭ সালের আগে বিএনপির রাজনীতি করতেন লাক মিয়া। এক-এগারোর পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে বদলে যান তিনিও। ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এবার বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হিসেবে পরিচয় দেন এবং নতুন করে গড়ে তোলেন নিজেকে। লাক মিয়া এখন আওয়ামী লীগের আড়াইহাজার উপজেলার কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য।
ব্রাহ্মন্দী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লাক মিয়া তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমার বাবা ব্যবসায়ী ছিলেন। আমরা কোনো অবৈধ পথে হাঁটিনি।’