logo
আপডেট : ৩০ মার্চ, ২০২২ ১০:২২
ইস্তাম্বুল বৈঠক যুদ্ধবিরতির আশা জাগাচ্ছে

ইস্তাম্বুল বৈঠক যুদ্ধবিরতির আশা জাগাচ্ছে

ইস্তাম্বুলে শান্তি আলোচনা শুরুর আগে উভয় দেশের প্রতিনিধিদের উদ্দেশে ভাষণ দেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান। ছবি- সংগৃহীত

ইউক্রেন সংকট নিরসনে বহুল প্রতীক্ষিত বৈঠক শুরু হয়েছে তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে। রাশিয়া ও ইউক্রেন প্রতিনিধিদের মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার দুই দিনব্যাপী এই বৈঠক শুরু হয়। এর আগে দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে একাধিকবার বৈঠক হয়। কিছু কিছু বৈঠক ভার্চুয়ালিও হয়। কিন্তু সেসব বৈঠকে আশরানুরূপ কোনো ফল আসেনি। এবার তুরস্কের উদ্যোগে সংকট নিরসনে দুই দেশ বৈঠকে বসেছেন। প্রায় তিন সপ্তাহ পর শুরু হওয়া মুখোমুখি এই বৈঠক যুদ্ধ বিরতির আশা জাগাচ্ছে বিশ্ববাসীর মনে। কারণ বৈঠক শুরুর পর মস্কো জানিয়েছে, তারা ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ ও চেরনিহিভে সামরিক কার্যকলাপ হ্রাস করবে। রুশ উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী আলেকজান্ডার ফোমিন বলেন, কিয়েভ এবং চেরনিহিভের আশপাশে সামরিক তৎপরতা একবারেই কমিয়ে আনা হবে। এই ঘটনাকে দুই দেশের মধ্যে আস্থা বাড়ানোর প্রথম পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে। খবর: বিবিসি, সিএনএন ও আলজাজিরার।

এদিন সকালে বৈঠকের উদ্বোধন করেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান। ইস্তাম্বুলের বসফোরাস প্রণালি তীরবর্তী দপ্তর দলমাবাচে প্রাসাদে দুই দেশের প্রতিনিধিরা লম্বা একটি টেবিলের দুই পাশে মুখোমুখি বসেন। বৈঠক শুরুর আগে উভয় পক্ষকেই বেশ শীতল মনে হয়েছে। এমনকি বৈঠকের আগে কোনো ধরনের করমর্দনও করেননি তারা।

তাদের উদ্দেশে এরদোগান বলেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি- উভয়েই আমার গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু। আশা করছি, এই শান্তি আলোচনার অগ্রগতি ওই দুই নেতার বৈঠকের পথ প্রস্তুত করবে। আমরা সেই বৈঠকেরও আয়োজন করতে চাই। আমরা জানি, সংকট নিরসনে উভয় পক্ষেরই যথাযথ উদ্বেগ আছে। কিন্তু আমরা এমন একটি মুহূর্তে পৌঁছেছি যখন আলোচনার মাধ্যমে বাস্তব ফল আসা জরুরি।

ইউক্রেন যুদ্ধ পঞ্চম সপ্তাহে প্রবেশ করায় তিনি গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন। বলেন, উভয় দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব তুরস্কের জন্য মধ্যস্থতার বাধ্যবাধকতা তৈরি করেছে। উভয়পক্ষ ইচ্ছা করলেই এই শোচনীয় পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে পারে। একটি ন্যায্য শান্তিকে হারতে দেওয়া যাবে না। লড়াই চলতে থাকলে কেউ লাভবান হবে না। এমন সংকটময় সময়ে আপনাদের স্বাগত জানাতে পেরে এবং আপনাদের শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে অবদান রাখতে পেরে আমরা আনন্দিত। এ বৈঠক ও আলোচনা আপনাদের দেশ, এই অঞ্চল জন্য এবং পুরো মানবজাতির জন্য শুভ হবে। আশু যুদ্ধবিরতির জন্য দুই পক্ষের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। তুরস্ক ন্যাটোর সামরিক জোটের সদস্য হলেও রাশিয়ার সঙ্গে দৃঢ় মিত্রতা ধরে রেখেছে। মস্কোর বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের ঢালাও নিষেধাজ্ঞার মিছিলে যোগ দেননি দেশটি। এখনো ন্যাটোর সদস্য যে কয়েকটি দেশ এমন অবস্থান ধরে রেখেছে তুরস্ক তাদের অন্যতম।

টানা এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর অভিযান চলছে। এক মাসেই কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে পূর্ব ইউরোপের এই দেশটির অনেক শহর। অনেকগুলো শহর রুশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। অভিযান শুরুর পর থেকে রাশিয়া যে শহরটির দখল নিতে মুখিয়ে ছিল, সেই মারিউপোলের পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ আর অল্প কয়েক দিনের মধ্যে রুশ সেনাদের হাতে চলে যাবে বলে মনে করছেন ব্রিটেনভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক রয়াল ইনস্টিটিউট সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের এক বিশ্লেষক। প্রতিষ্ঠানটির স্থলযুদ্ধ-সংক্রান্ত গবেষক জ্যাক ওয়াটলিংয়ের মতে, মারিউপোলের দখল পেলে রুশ সেনারা ডনবাসের অন্যত্র থাকা ইউক্রেনের ইউনিটগুলোকে চেপে ধরবে। দীর্ঘসময় ধরে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো ইউক্রেনের সেরা ইউনিটগুলোর কয়েকটি ওই অঞ্চলেই আছে।

রুশ বাহিনী কিয়েভের দিকে অগ্রসর হওয়ার পর থেকে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে হাজার হাজার বাসিন্দা দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাবওয়ে স্টেশনে আশ্রয় নিয়েছেন। রাশিয়া দেশটিতে হামলা শুরুর পর থেকেই বিভিন্ন শহরের লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে শুরু করে। যারা অন্য কোনো দেশে যেতে পারেননি তারা বিভিন্ন সাবওয়ে স্টেশনে আশ্রয় নিয়েছেন। এদিকে উত্তেজনার পারদ বাড়তে থাকায় বাড়ছে রুশ পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারের আশঙ্কাও। যদিও মস্কো বলছে, রাশিয়ার অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়লেই কেবল পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কথা চিন্তা করা হবে বলে জানান ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ।

পুতিনের হয়ে ইস্তাম্বুলে আব্রামোভিচ

রুশ ধনকুবের রোমান আব্রামোভিচ মস্কোর মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ইস্তাম্বুলে আছেন বলে নিশ্চিত করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ইব্রাহিম কালিন। গতকাল মঙ্গলবার সিএনএনকে তিনি এ একথা বলেন। যদিও কালিন নিশ্চিত করার আগেই তাস ইস্তাম্বুলে আব্রামোভিচকে দেখতে পাওয়ার কথা জানায়। কালিন জানান, আব্রামোভিচ মধ্যস্থতাকারী দলের অংশ হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট পুতিন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যাদের মনোনয়ন দিয়েছেন, তাদের একজন হিসেবে তিনি এসেছেন।

আব্রামোভিচ ইউক্রেনের সঙ্গে আলোচনার একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে অংশ নিয়েছিলেন। গতকাল আলোচনাস্থলে উপস্থিত হওয়া আব্রামোভিচের ছবি প্রকাশ করে রাশিয়ার গণমাধ্যম আরআইএ। ছবিতে তাকে সুস্থ মনে হয়েছে। শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতা করতে গিয়ে কিয়েভে অবস্থানের সময় মস্কোর কট্টরপন্থিরা রুশ এ ধনবুবেরকে বিষ প্রয়োগ করেছিল বলে তার মুখপাত্রের দাবি করে। এ বিষয়ে ক্রেমলিন জানিয়েছে, এসব পশ্চিমাদের তথ্য যুদ্ধের অংশ।

খাবারে কিয়েভের নিষেধাজ্ঞা

তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি বৈঠকে যোগ দিতে যাওয়া প্রতিনিধিদের আলোচনার টেবিলে কোনো কিছু খাওয়া, পান করা এবং বিশেষ করে কোনো কিছু স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকার বিষয়ে সতর্ক করেছে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবা। ইউক্রেনের নিউজ চ্যানেল ইকপাইহা ২৪ কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব সতর্কতা উচ্চারণ করেন। এই মাসের শুরুতে ইউক্রেন-বেলারুশ সীমান্তে শান্তি আলোচনায় রুশ ধনকুবের রোমান আব্রামোভিচ এবং ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের ওপর বিষপ্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে। এরপরই নতুন আলোচনা শুরুর আগে এসব সতর্কতা উচ্চারণ করেন কুলেবা। তবে ওই বিষপ্রয়োগের বিষয়টি নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তা জানান, গোয়েন্দা তথ্যে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে ওই ব্যক্তিদের যেসব লক্ষণ দেখা যায় সেগুলো সম্ভবত পরিবেশগত কারণে, বিষক্রিয়ায় নয়।

মেট্রো স্টেশনে কাটছে দিন

রুশ বাহিনী ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর থেকেই দেশটির বাসিন্দারা সাবওয়েতে দিন কাটাচ্ছেন। রাজধানী কিয়েভের দিকে রুশ বাহিনী অগ্রসর হওয়া শুরু করলে হাজার হাজার বাসিন্দা দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাবওয়ে স্টেশনে আশ্রয় নিয়েছেন। এখনো সংঘাত চলছেই। দেশটিতে হামলা চালানোর পর থেকেই বিভিন্ন শহরের লোকজন বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালাতে শুরু করে। যারা অন্য কোনো দেশে পালাতে পারেননি তারা বিভিন্ন সাবওয়ে স্টেশনে আশ্রয় নিয়েছেন। এখন পর্যন্ত কয়েক মিলিয়ন মানুষ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন বলে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার নিশ্চিত করেছেন।

এদিকে রুশ বাহিনী ইউক্রেনের এক সাংবাদিককে আটক করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। তিনি ইউনিয়ান নিউজ এজেন্সির হয়ে কাজ করছিলেন। দিমিত্রি খিলিয়াক নামের ওই সাংবাদিক মার্চের শুরুতেই নিখোঁজ হন। কিয়েভের বাইরের একটি শহরে তাকে আটকে রাখা হয়েছে বলে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের এক পোস্টে তার সহকর্মী নাতালিয়া বোগোতা জানান।

১৭ হাজার রুশ সেনা হত্যার দাবি

ইউক্রেনে প্রায় পাঁচ সপ্তাহ ধরে রুশ বাহিনীর অভিযান চলছে। ইতোমধ্যে রুশ বাহিনী দেশটির বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের দখল করে নিয়েছে। কিন্তু এখনো দেশটির রাজধানী কিয়েভ দখল করতে সক্ষম হয়নি। চলমান যুদ্ধে ১৭ হাজারেরও বেশি রুশ সৈন্য নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছে ইউক্রেন। দেশটির সশস্ত্র বাহিনী জানিয়েছে, হামলা শুরুর পর ১৭ হাজার ২০০ রুশ সেনা নিহত হয়েছে। এ ছাড়া রাশিয়া ৫৯৭টি ট্যাংক, ১ হাজার ৭১০টি সাঁজোয়া যান, ১২৭টি যুদ্ধবিমান, ১২৯টি হেলিকপ্টার ও ৭টি যুদ্ধজাহাজ হারিয়েছে। যদিও রাশিয়া বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধে ১ হাজার ৩৫১ রুশ সেনা নিহত হয়েছে। রুশ সেনা হতাহতের বিষয়ে উভয় দেশের দাবিই নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।