জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০২তম জন্মবার্ষিকী পালিত হলো ১৭ মার্চ। এ দিনটি ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবেও পালিত হয়ে থাকে। আর বঙ্গবন্ধুর জীবনের ইতিহাস মানেই স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস। জীবনে তিনি যা কিছু করেছেন সবকিছু দেশের জন্যই করেছেন। মাত্র ৫৫ বছর তিনি বেঁচে ছিলেন। সময়ের বিচারে এটি সংক্ষিপ্ত হলেও তার জীবনের দৈর্ঘ্যরে আকারে তার কর্মের প্রস্থ ছিল অনেক বেশি। তার জন্ম না হলে আজ আমরা স্বাধীনতা পেতাম না।
এদেশের রাজনীতির ইতিহাসে দেশের সুসন্তানগণকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করা হয়। যেমন চিত্তরঞ্জনকে দেওয়া হয়েছিল ‘দেশবন্ধু’ এবং ফজলুল হককে দেওয়া হয়েছিল ‘শেরে বাংলা’ খেতাব। বঙ্গবন্ধু শব্দটির অর্থ হলো বাংলার বন্ধু। বন্ধু তাকেই বলা যায় যে প্রয়োজনের কথাটি বুঝতে পারে, তা মেটানোর জন্য চেষ্টা করে, বিপদে-আপদে পাশে থাকে। যখন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বড় বিপদ, সেই বিপদ থেকে উদ্ধারের পথনির্দেশনা দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাই তো তার নামকরণ বা উপাধি দেওয়া হয়েছিল ‘বঙ্গবন্ধু’।
১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে বিজয়ী হয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে না দিয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে শুরু করে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেপ্তারের আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার একটি ঘোষণাপত্র ওয়ারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা হান্নান চৌধুরীর কাছে পাঠান। এ ঘোষণাপত্রটি হান্নান চৌধুরী কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করেন। শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ।
বাংলা ভূ-খণ্ডের একটি সময়ে পরিচয় ছিল বিদেশি জাতির একটি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র হিসেবে। ইতিহাসের পাতায় এক নজর চোখ বুলালেই আমরা দেখতে পাই জাতি হিসেবে আমাদের প্রতিটি পদে ব্যর্থতা। শক, তুন, মগ, পর্তুগিজ, ফরাসি, ওলন্দাজ, ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানিরা নানা সময় নানাভাবে আমাদের শোষণ করেছে। ভোগ করেছে আমাদের সম্পদ। শুধু ১৯৭১ সালের যুদ্ধে আমরা বিদেশি পরাশক্তিকে রুখতে পেরেছিলাম। এর পেছনে সবটুকু ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান। তিনি নিজের স্বার্থকে সম্পূর্ণভাবে বিসর্জন দিয়ে লড়েছেন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য। জাতি হিসেবে আমাদেরকে প্রথম বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এই মহাপ্রাণ বাঙালি। তাই তিনি জাতির জনক।
মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে তিনি ছিলেন অত্যন্ত আন্তরিক। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আদি স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি স্বপ্ন দেখতেন শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ একটি বিশ্ব ব্যবস্থার। আন্তর্জাতিক সম্পর্কোন্নয়নে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত তৎপর। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মাত্র সোয়া দুই বছরের মধ্যে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের ১২১টি দেশের পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক স্বীকৃতি অর্জন করে। এর মাঝে মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি এবং তার নেতৃত্বে বেশ কিছু মুসলিম দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর ইসলামপ্রীতি বিষয়ক কিছু ছবি- বঙ্গবন্ধু একজন ইসলাম প্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ইসলাম ধর্মসহ সব ধর্মকে তিনি শ্রদ্ধার নজরে দেখতেন এবং একজন মুসলিম হিসেবে তিনি ইসলাম ধর্মের নানাবিধ আনুষ্ঠানিকতায় অংশগ্রহণ করতেন। বঙ্গবন্ধু তার পুত্র শেখ রাসেলকে নিয়ে ঈদের জামাত শেষে মোনাজাত করছেন, নামাজান্তে মুসলিমদের সাথে কোলাকুলি করছেন এবং ধর্মীয় স্থাপনা দর্শনকালে মোনাজাত করছেন- এসবই আমরা বিভিন্ন চিত্রপটে দেখতে পাই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামের সম্প্রসারণ এবং ইসলামী মূল্যবোধ প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। যেমন- ১. বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা। ২. বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন (আগে পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসিত কোনো মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ছিল না)। ৩. বেতার ও টিভিতে কোরআন তিলাওয়াত প্রচার। ৪. কাকরাইল মসজিদের জন্য অতিরিক্ত জায়গা বরাদ্দ। ৫. টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার জন্য স্থান নির্ধারণ। ৬. হজযাত্রীদের জন্য ভ্রমণ কর রহিতকরণ। ৭. বাংলাদেশ সিরাত মজলিস প্রতিষ্ঠা ও ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন। ৮. ঈদে-মিলাদুন্নবী (স), শব-ই-কদর, শব-ই-বরাত উপলক্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণা। ৯. সুশীল সমাজ গঠনে মদ ও জুয়া নিষিদ্ধকরণ এবং শাস্তির বিধান। ১০. রাশিয়াতে প্রথম তাবলীগ জামাত প্রেরণের ব্যবস্থা। ১১. বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা নিষিদ্ধকরণ। ১২. হজ্জ পালনের জন্য সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা। ১৩. ওআইসি সম্মেলনে যোগদান ও মুসলিম বিশ্বের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন। এছাড়া তৎকালীন প্রায় সব বিজ্ঞ আলেম-উলামার সাথে বঙ্গবন্ধুর সুসম্পর্ক ছিল ভালো।
বাংলাদেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি আনন্দের দিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু একজনই জন্মেছিলেন। যার জন্ম না হলে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হতো না। যারা বাংলাদেশকে বিশ্বাস করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধারণ করে তাদের মাঝেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকবেন চিরকাল।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি